logo ২০ মে ২০২৫
নৈতিকতা, ধর্ম ও জীবন
০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ১৬:০৫:৫২
image


ধর্মীয় বিধি-নিষেধ এবং শিক্ষাগুলো কি ব্যক্তি জীবনে কি সমাজ জীবনে উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের সঠিক পথের দিশা। ধর্মীয় শিক্ষা ও বিধিবিধান ব্যক্তি মানুষের অন্তরাত্মার ওপর যেমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলে তেমনি সমাজেও সুস্থ ও সঠিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। কিন্তু মানুষের অন্তরাত্মাকে নষ্ট করে দেয় যে দুষ্ট ক্ষত, সামাজিক সম্পর্ক ও শৃঙ্ক্ষলা ধ্বংস করে দেয় যে মানবীয় অসৎ গুণ তার নাম হলো গীবত। ইসলামে গীবত অসম্ভব নোংরা একটি প্রবণতা হিসেবে স্বীকৃত। গীবত বলতে বোঝায় কারো অনুপস্থিতিতে তার মন্দ দিকগুলো অন্যেদের কাছে বলে বেড়ানো। এমন ধরনের কথাবার্তা বলা যা তাঁর উপস্থিতিতে বললে তিনি নির্ঘাৎ বিরক্ত হতেন, কষ্ট পেতেন।

 

 

নবী কারিম (সা) গীবত সম্পর্কে বলেছেনঃ “গীবত হলো নিজের ভাইয়ের এমন কোনো দিক নিয়ে কথা বলা যা তার অসন্তুষ্টির কারণ হয়”।

 

একজন জিজ্ঞেস করলো: কিন্তু যা বলা হয়েছে তা যদি সত্যি সত্যিই তাঁর মাঝে থেকে থাকে,তাহলে?

 

নবীজী বললেন: “থাকলেও গীবত আর না থাকলে তো অপবাদ”

 

কিন্তু মানুষ কেন গীবত করে? গীবত চর্চার পেছনে বহু কারণ থাকতেই পারে। কখনো হিংসার কারণে মানুষ গীবত করে। কেউ কাউকে হিংসা করলে বিদ্বেষবশত অন্যদের কাছে তার ব্যাপারে আজেবাজে কথা বলে বেড়ায়। আবার রাগ-ক্রোধ উত্তেজনার কারণেও অনেকে এই বদ অভ্যাস চর্চা করে। রাগ প্রশমিত করার জন্যেই গীবত।

 

তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে পরিবেশ এবং আশপাশের মানুষজনের প্রভাবেও অনেক সময় গীবত করা হয়ে থাকে।  কোনো মজলিসে কিংবা আনন্দ উৎসবে মজা করতে করতে একেকজন একেকজনের দুর্নাম বা গীবত করতে শুরু করে দেয়। এটা অনেক সময় হাঁসতে হাঁসতে রঙ্গ-রসিকতার মধ্য দিয়েই শুরু হয়। ফলে মজলিসে উপস্থিত অন্যরাও সাথে মজা করেই সুর মেলায়। গীবত করা হারাম জেনেও নিজেকে অন্যদের সাথে অভিন্ন রঙে রঙীন করে তোলার জন্যে এই প্রবণতা দেখা দেয়।

 

আবার অনেক সময় দেখা যায় অন্যরা কী গীবত করছে, সেটা জানার জন্যে কৌতূহলী হয়ে কান পাতে। কিন্তু কৌতূহল এক সময় মিটে যায় এবং সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার স্বার্থে বা নিজেকে সবার সাথে মিলিয়ে ফেলতে গিয়ে সেও গীবত চর্চা শুরু করে দেয়।

 

আমরা গীবত চর্চার নেপথ্য কারণগুলো নিয়ে কথা বলছিলাম। গীবতের আরেকটি কারণ হলো অপরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা বা কারো সাথে ঠাট্টা মশকরা করা-যার ফলে অন্যের সম্মান নষ্ট হয় এবং তার ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাত আসে। আবার কেউ কেউ অন্যদেরকে তুষ্ট করার জন্যে বা তাদেরকে হাঁসানোর জন্যেও গীবত করে। অনেকে আবার নিজের ভুল ত্রুটিগুলোকে ধামাচাপা দিতে এবং অন্যদের চেয়ে নিজেকে বড়ো করে প্রকাশ করার জন্যেও গীবত করে। যেমন অপরকে সহজ সরল এবং মূর্খ বলে অভিহিত করে মূলত নিজেকে খুব জ্ঞানী এবং বোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালায়। যাই হোক এরকমম বহু কারণে মানুষ গীবত চর্চা করে থাকে।

 

কিন্তু এই গীবত চর্চা একজন মানুষের জীবনে কী ধরনের পরিণতি বয়ে আনে, এবার বরং সেদিকে একটু মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করা যাক। একটি সমাজের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ বা অর্জন হলো ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মানসিকতা,পারস্পরিক ঐক্য এবং আন্তরিক সম্পর্ক। গীবত চর্চার ফলে এই মূল্যবান পুঁজির ওপর প্রচণ্ড আঘাত আসে। একটি সমাজের লোকজনের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতার যে মানসিকতা তৈরি হয়, তার মূলে থাকে প্রধানত বিশ্বাস। এই পারস্পরিক বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করে গীবত। গীবত অপরের প্রতি বিশ্বাসকে একেবারে নড়বড়ে করে দেয়।

 

গীবত চর্চার ফলে মানুষ অপরের লুকিয়ে থাকা অসৎ গুণগুলো সম্পর্কে জেনে যায়, যদিও সর্বাংশে তা সত্য নাও হয়। এই দোষগুলো জেনে যাবার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে এবং তারই জের ধরে তাকে আর কেউ বিশ্বাস করে না। গীবত বহুলাংশেই ফেতনা-ফাসাদের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দেয় যার ফলে শত্রুতাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেক সময় কারো গোপন অন্যায় অপরাধগুলোকে ফাঁস করে দেওয়ার ফলে উল্টো ফল হয়। অপরাধী ব্যক্তিটি আগে যেমন নিজেকে সংযত রেখে চলাফেরা করতো, অপরাধ ফাঁস হয়ে যাবার কারণে অগত্যা সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কেননা অন্যায় ফাঁস হয়ে গেলে তো তার আর রাখঢাক করার প্রয়োজন পড়ে না।

 

এই নেতিবাচকতার দিকটি সামনে রেখেই পবিত্র কুরআন গীবত চর্চা থেকে মানুষকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে। সূরায়ে হুজরাতের ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

হে ঈমানদাগণ! বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোন কোন ধারণা ও অনুমান গোনাহ। দোষ অন্বেষন করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে,যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো,তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ অধিক পরিমাণে তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু।

 

এই সূরারই ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “হে ঈমানদারগণ,পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম।আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রূপ না করে,হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম।তোমরা একে অপরকে বিদ্রূপ করো না এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না”।

 

এরকম পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে: যদি তুমি এমন কোনো জমায়েতে থেকে থাকো, যেখানে কারো পেছনে গীবত চর্চা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে যার গীবত করা হচ্ছে তার পক্ষে যাও এবং তার ব্যাপারে মন্দ কথাবার্তা বলা থেকে সবাইকে বিরত রাখো। তারপর সেখান থেকে চলে যাও।

 

চেহেল হাদিস গ্রন্থে ইমাম খোমেনী (রহ) চমৎকার একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে গীবত চর্চা পরিহার করার অনুরোধ করে বলেছেন কারো সাথে শত্রুতা থাকলেও তার গীবত করো না। কেননা হাদিসে এসেছে: যে ব্যক্তি গীবত করে তার পূণ্যগুলো যার গীবত করা হয় তার আমলনামায় লেখা হয়। সুতরাং গীবতকারী শত্রুর গীবত করতে গিয়ে মূলত নিজের বিরুদ্ধেই শত্রুতা করে”।