ঢাকা: মানুষ চাইলে তার নিজের ভেতরটাকে নৈতিকতার বিচিত্র গুণে গড়ে তুলতে পারে। নিজের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে এমনকি তার আচার আচরণে যদি তার ওই গুণাবলি পরিলক্ষিত হয় তাহলে তা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তেমনিভাবে নৈতিক গুণাবলি ব্যক্তির ইহকালীন ও পরকালীন সৌভাগ্য নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নৈতিক গুণাবলির গুরুত্ব এতো বেশি যে একজন মানুষ যদি সকল জ্ঞান ও বিজ্ঞান অর্জন করে এমনকি প্রকৃতির সকল শক্তির ওপর নিজের আধিপত্য বিস্তারও করে তাতে কোনো লাভ নেই, যদি না ওই লোক নিজের ভেতরের শক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। নিজের নফসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে না পারলে প্রকৃত উন্নতি ও সৌভাগ্য অর্জন করা থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে।
জ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি সকল উন্নয়ন সত্ত্বেও আচরণগত সংস্কার করা না হলে ওই উন্নয়ন হবে সেই আকাশচুম্বী টাওয়ার বা প্রাসাদের মতো যে টাওয়ার গড়ে তোলা হয়েছে সুপ্ত আগ্নেয়গিরিময় পাহাড়ের ওপর। সুতরাং মানুষের নৈতিক এবং আত্মিক প্রশিক্ষণ এককথায় মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনা গ্রহণ প্রত্যেক সমাজের জন্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। পৃথিবীজুড়ে আজ যে অস্থিরতা, অশান্তি, গোলোযোগ, বিচ্ছৃঙ্ক্ষলা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মারামারি, হানাহানি, অরাজকতা-সবই ওই নৈতিক এবং আত্মিক প্রশিক্ষণহীনতা থেকেই উৎসারিত। বর্তমান বিশ্ব শিল্প ও জ্ঞানের ভুবনে অনেক উন্নয়ন অর্জন করেছে। এগুলোর সাহায্যে তারা মানুষের পার্থিব জগতের বিচিত্র চাহিদা মেটাতেও সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মানবীয় নীতিনৈতিকতার দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে এতোকিছুর পরও মানুষ পতনের অতল গহ্বরে পড়ে আছে কিংবা সেদিকেই অগ্রসর হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো শান্তি নেই।
নিঃসন্দেহে মানুষের মনোদৈহিক সুস্থতার জন্যে ইসলাম ধর্মে রয়েছে পরিপূর্ণ এবং যথার্থ দিক-নির্দেশনা। আধুনিক গবেষণাতেও দেখা গেছে জ্ঞানীগুণীরা বলতে বাধ্য হয়েছেন যে ধর্মীয় আচার আচরণ, নৈতিকতা এবং বোধ ও বিশ্বাসের সাথে মানুষের মনোদৈহিক সুস্থতার সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে এমন সব হুকুম আহকাম এবং নীতিমালা রয়েছে যেগুলো মানুষের আত্মার প্রশান্তি নিশ্চিত করে এবং শারীরিক সুস্থতাও বজায় রাখে।
সামগ্রিকভাবে ইসলামী নীতিমালাকে তিনটি পর্যায়ে শ্রেণীবিন্যস্ত করা যায়। একটি হলো উসূলে আকায়েদ বা বিশ্বাসের মূলনীতি। দুই. আহকাম অর্থাৎ আদেশ আর তিন নম্বর হলো আখলাক বা নৈতিকতা। এই তিনটি বিভাগ মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখন ধর্মীয় আদেশ বা নীতিমালা যদি বলে: পবিত্র খাবার খাও এবং অপবিত্র বা দূষিত খাবার পরিহার করো, তাহলে ধরে নিতে হবে মানুষের স্বাভাবিক চাহিদার সাথে এই আদেশই যথোপযুক্ত এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ইসলাম এভাবে আদেশ দিয়েছে। কিংবা যদি বলে তোমার স্রষ্টা আল্লাহর সামনে বিনয়ী ও অনুগত হও এবং তাঁর ইবাদত করো তাহলে বুঝতে হবে অবশ্যই মানবীয় প্রকৃতির সাথে তার গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
একইভাবে সমজাতির প্রতি সদয় হওয়া,বাবা-মায়ের খেদমত করা, আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ রাখা, মিথ্যা পরিহার করা, গীবত না করা, অহমিকা প্রদর্শন না করা ইত্যাদিসহ এ ধরনের অন্যান্য নৈতিক অবক্ষয়মূলক প্রবণতা থেকে যদি বিরত থাকার কথা বলা হয়, তাহলে বুঝতে হবে মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সাথে এটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চাই হলো মানুষের আত্মবিশ্বাসের বিকাশ নিজস্ব মেধার বিকাশসহ মানসিক সুস্থতার মৌলিক চালিকাশক্তি। তাই মানুষের সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের জন্যে যা কিছুই ক্ষতিকর-চাই অল্প সময়ের জন্যেই হোক কিংবা দীর্ঘমেয়াদের জন্যেই হোক-সে সবই হারাম বলে ঘোষণা করেছে ইসলাম। আর যেসব জিনিস উন্নয়ন ও বিকাশের অনুকূল সে সবই মানুষের জন্যে হালাল ঘোষণা করা হয়েছে। এভাবেই দ্বীন তথা ইসলামের শিক্ষা ও নীতিমালাগুলো মানুষের সকল মনোদৈহিক সুস্থতা নিশ্চিত করেছে।
মানব জীবনে নৈতিকতার গুরুত্বটা কোথায়- এরকম প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে। এর জবাব হলো মানুষের ভেতরে ভালো এবং মন্দের লড়াই নিরন্তর চলতে থাকে। মনের কামনা বাসনা চরিতার্থ করতে মন্দ শক্তি সবসময় চেষ্টা করে মানুষকে বিপথে টেনে নিতে। সে সময়নীতি নৈতিকতার চিন্তা শুভবোধ হয়ে সারাক্ষণ মন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। এভাবেই নৈতিক গুণগুলো মানুষকে প্রবৃত্তির বিপরীত স্রোত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। মানুষকে কখনো বিপথগামী হতে দেখলে নৈতিকতা অশনি সংকেত হিসেবে সতর্ক করে তোলে। মূলত এই শক্তিশালী নৈতিকতাই হলো আল্লাহর প্রতি ইমান। কেবল এই ইমানই পারে মানব গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে এবং মানব অস্তিত্বের ওপর সমূহ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। অপরদিকে নৈতিকতার পূর্ণতা তখনই বিশ্বাসযোগ্যতা বা দৃঢ়তা লাভ করে যখন তা অর্জিত হয় আল্লাহর প্রতি দ্বন্দ্বহীন ইমানের ভিত্তিতে।
ইসলামে নৈতিকতার ভিত্তি একেবারেই তৌহিদি চিন্তা ও বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ এই নৈতিকতা গড়ে উঠবে আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগির মাধ্যমে। এই ইবাদত ও বন্দেগির মানেই হলো আল্লাহর প্রতি ইমান, একমাত্র স্রষ্টার প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে আত্মনিবেদিত হওয়া। বলা বাহুল্য যুগে যুগে যত নবী রাসূল এই পৃথিবীতে এসেছেন তাঁদের মৌলিকতম শিক্ষাই ছিল আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ইমান এবং তাঁর ইবাদত করা। আল্লাহ আমাদের দৃঢ় ইমান দিন, দৃঢ় নৈতিক গুণাবলি দান করুন-এই প্রত্যাশায় আজ এ পর্যন্তই।
(ঢাকাটাইমস/২০ জানুয়ারি/জেডএ.)