logo ৩০ জুন ২০২৫
তেলেঙ্গানাই এখন কংগ্রেসের পাখির চোখ
জাকিয়া সুলতানা, ঢাকাটাইমস
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ১৩:০৬:০৩
image


ঢাকা: ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিতর্কিত তেলেঙ্গানা বিল পেশ করতে গিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো, সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে তা চিহ্নিত হয়ে থাকবে ‘কালো দিবস’ হিসেবে। পিপার স্প্রে, ভাঙচুর, মারামারি, হাতাহাতি কী নয়?

বিতর্কিত তেলেঙ্গানা বিল পেশ করতে গিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে তেলেঙ্গানাপন্থি এবং সীমান্দ্রপন্থিদের মধ্যে রীতিমত খ-যুদ্ধ বেঁধে যায়। দীর্ঘ দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর বৃহস্পতিবার লোকসভায় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল শিন্ডে বিল পেশ করতেই শুরু হয় হৈ হট্টগোল ও হুলুস্থুল।  

এই অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির দরুণ ১৭জন সাংসদকে বহিষ্কার করা হয়। সংসদের অধিবেশন ১৭ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।

শিন্ডে বলেছেন, বিল পেশ করার পর এখন এটি সংসদের এক্তিয়ারে। স্পিকার যদি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেন, তাহলে বিলের ওপর আলোচনা হবে। স্পিকার চাইলে কণ্ঠভোটেও তা পাশ করাতে পারেন। লোকসভায় পাশ হলে উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করা হবে।  

তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, তেলেঙ্গানা বিল পাশ করানো সহজ হবে না৷

এখন প্রশ্ন আসতে পারে কেনো পৃথক হতে চায় তেলেঙ্গানা? ফিরে দেখা যাক তেলেঙ্গানার ইতিহাস।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে তেলেঙ্গানা ছিল তৎকালীন স্বাধীন হায়দ্রাবাদ সামন্ত রাজ্যের অন্তর্গত। ১৯৪৮'এ হায়দ্রাবাদ ভারতের অঙ্গীভূত হবার পর ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তেলেঙ্গানা ছিল পৃথক রাজ্য। তারপর ভাষা-ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন করা হলে তেলেগুভাষী তেলেঙ্গানা নিয়ে গঠিত হয় অন্ধ্রপ্রদেশ। মোট দশটি জেলা নিয়ে তেলেঙ্গানা অঞ্চলটি গঠিত।

গত ষাট বছর ধরে ঝুলে আছে তেলেঙ্গানা পৃথকীকরণ ইস্যু। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব। ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভায় পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন সংক্রান্ত সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছে।

পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিভিন্ন দল ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু কোন দলই কথা রাখেনি।

পৃথক রাজ্য হিসাবে বিবেচিত হওয়ার দাবি তেলেঙ্গানা অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের ইচ্ছা হলেও তা মঞ্জুর করার পক্ষে কোনও যুক্তি খুঁজে পায় না এর বিরোধীরা। তেলেঙ্গানার বাসিন্দারা অন্যান্য তেলেগুদের থেকে কোনও স্বতন্ত্র ভাষাভাষী নয়, কোনও স্বতন্ত্র জাতিসত্তাও নয়। এরপরেও অন্ধ্রপ্রদেশ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাজ্যের পরিচয় পেতে সেখানকার মানুষের আন্দোলনের পিছনে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির সুযোগবঞ্চিত ছাত্র সমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।

এই ইস্যুতে ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে বহুবার। ৬৯-এ ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে নিহত হয় ৩৬৯ জন। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রেপ্তার হয় হাজার হাজার ছাত্র।

তেলেঙ্গানাকে পৃথক রাজ্যে ঘোষণার দাবির আন্দোলন শুরু ইউপিএ-১ আমলে। তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির সাংসদদের সমর্থন পেতে কংগ্রেস পৃথক রাজ্যের দাবি মেনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত দিয়েছিলো। পরবর্তীতে কংগ্রেস নেতৃত্ব অবস্থান কঠোর করলে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি ইউপিএ ছেড়ে দেয়। এদিকে তেলুগু দেশম পার্টি রাজ্যে হারানো মর্যাদা ফিরে পেতে সমিতির সমর্থক হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় দফায় ইউপিএ আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরমের একটি ঘোষণা পৃথক রাজ্যের দাবিতে প্রায় স্থবির আন্দোলনকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই এই প্রশ্নে রাজ্য ও দেশের রাজনীতি সরগরম হয়েছে।

২০০৯ সালে মনমোহন সিং সরকারের জোটসঙ্গী তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি সরকার থেকে বেরিয়ে যায়। পরে তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির প্রধান কে.চন্দ্রশেখর রাও আমরণ অনশন শুরু করলে কেন্দ্রীয় সরকার পৃথক তেলেঙ্গানার দাবি নীতিগতভাবে মেনে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সহমতের কথা বলেন।

তেলেঙ্গানা বিল সংসদে উত্থাপনের আগে এই ইস্যু নিয়ে মন্ত্রীসভায় বৈঠক হয়। সেখানে অন্ধ্রপ্রদেশের বিভাজন নিয়ে বিভিন্ন মতামত উঠে আসে। সীমান্ধ্রের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা হায়দ্রাবাদকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার দাবি তোলেন। তার সঙ্গেই অন্ধ্রপ্রদেশকে তেলেঙ্গানা ও অবশিষ্ট অন্ধ্রপ্রদেশে ভাগ করতে বলেন তারা। যদিও তেলেঙ্গানাপন্থীরা এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেন।

বিল পাশ নিয়ে কংগ্রেস কেন এত মরিয়া?

২০০৯ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় ইউপিএ সরকার গঠনে অন্ধ্রপ্রদেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিলো ৩৭টি আসন। এখন অন্ধপ্রদেশকে ভেঙে সীমান্ধ্র এবং তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠিত হলে সীমান্ধ্রের সিংহভাগ যাবে জগন মোহন রেড্ডির ঝুলিতে। তাই তেলেঙ্গানাই এখন কংগ্রেসের পাখির চোখ।

অন্যদিকে অন্ধ্রপ্রদেশকে ভাগ করা নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যেই দেখা দিয়েছে তীব্র মতানৈক্য।  বিশেষ করে অন্ধ্রপ্রদেশের সাংসদ, বিধায়ক ও কংগ্রেস নেতাকর্মীদের মধ্যে। তেলেঙ্গানার নেতাকর্মীরা চাইছেন ভাগ হোক, আর অন্ধ্র নেতাকর্মীরা চাইছেন পৃথক তেলেঙ্গানা কখনই নয়। একটা সমৃদ্ধ রাজ্যকে ভাঙলে তা ইতিবাচক হতে পারেনা। এই নিয়ে তীব্র চাপের মধ্যে কংগ্রেস।

সোনিয়া গান্ধীর হিসেবে আগামী নির্বাচনে এতে নাকি দলের ফায়দা হবে। জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি আবার কংগ্রেস জোটে ফিরবে এবং আগামী নির্বাচনে সেই জোট অব্যাহত থাকবে।

এদিকে ভোটের কথা মাথায় রেখে বিজেপি আগেই ঘোষণা করেছে যে, কংগ্রেস যদি পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন না করে, তাহলে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলে তা অবশ্যই করবে।

বলা বাহুল্য তৃণমূল কংগ্রেস অন্ধ্রপ্রদেশ বিভাজনের তীব্র বিরোধী। কারণ সহজবোধ্য পৃথক গোর্খাল্যান্ড নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একই সমস্যা অখন্ড অন্ধ্রপ্রদেশের নেতারা তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতা প্রার্থী।

তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের ফলে ছোট ছোট রাজ্য গঠনের আন্দোলন আবার মাথা চাঙা দিয়ে উঠবে যেমন, আসামে বোড়োল্যান্ড, পশ্চিমবঙ্গে গোর্খাল্যান্ড, মহারাষ্ট্রে বিদর্ভ অঞ্চল এবং জম্মু-কাশ্মীরে জম্মু ও লাদাখ। বিল পাস হলে তেলেঙ্গানা হবে দেশের ২৯তম রাজ্য।

(ঢাকাটাইমস/ ১৮ ফেব্রুয়ারি/ জেএস/ এআর/ ঘ.)