তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পর সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। সরকারও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছে একাধিকবার। কিন্তু ফল শূন্য প্রায়। নির্বাচনে সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, বিপক্ষ দলের ভোটারদের বাধা দেওয়ার সংস্কৃতি চলছেই। এগুলোর অবসানে নির্বাচন কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণার পর সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর আওয়ামী লীগের আগের আমলে নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের কোনো প্রশ্ন উঠেনি। পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন আর জাতীয় সংসদের একাধিক উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত বা সমর্থিত প্রার্থী হারলেও সে সময় ভোট সুষ্ঠু হওয়ায় প্রশংসা কুড়িয়েছিল নির্বাচন কমিশন এবং সরকার।
তবে বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আবারও আগের মতো পেশিশক্তির ব্যবহার, জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। আর এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের আগের আমলে ভোট নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও বর্তমান আমলে কেন উঠছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই আগে সুষ্ঠু ভোট করা গেলে এখন কেন গোলযোগের ঘটনা ঘটছে। নির্বাচন কমিশন কি আগে কঠোর ছিল আর এখন তারা নমনীয় কি না সে প্রশ্নও উঠছে নানা মহলে। উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও নির্বাচন কমিশন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বলে অভিযোগ আছে। কশিমন কখনো কখনো প্রার্থী বা সমর্থকদের জরিমানা করলেও সেটা কার্যকর প্রমাণ হয়নি। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হলেও কমিশন সে ক্ষমতা প্রয়োগ করে না কখনো।
বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জেতাতে তাদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে। এসব নির্বাচনে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরাল হচ্ছে বলেও মনে করছে দলটি। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগকে ঢালাও বলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারা বলছে, তৃণমূল পর্যায়ে ব্যক্তিগত ও আঞ্চলির দ্বন্দ্বের জেরে নানা ঘটনা ঘটে। তাই বলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোলযোগ হলে সামগ্রিকভাবে নির্বাচনকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন
বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থায় দখলের সংস্কৃতি চালু হয়েছিল আশির দশকে জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও চালু থাকে সেই সংস্কৃতি। সে সময় মাগুরা ও মিরপুরের বিতর্কিত নির্বাচনের পর তীব্র আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বিএনপি। তিনটি নির্বাচন করে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদিও ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোটে নতুন ধারায় কারচুপির অভিযোগ আনে। আবার উচ্চ আদালতের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায় বিএনপি-জামায়াত জোট ও সমমনারা।
কিন্তু সরকার রাজি না হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে তারা। তবে জাতীয় নির্বাচন বাতিল করলেও উপজেলা নির্বাচন এবং দলীয় প্রতীকে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তারা। ২০১৫ সালে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই পর্বেও ভোট নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ উঠেনি। এই দুই পর্বে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা প্রায় সমান-সমান এলাকায় জিতেছিলেন। কিন্তু তৃতীয় পর্ব থেকে ষষ্ঠ পর্বে ভোট কারচুপির অভিযোগ ক্রমেই বাড়তে থাকে। নির্বাচনী সহিংসতা, জাল ভোট, ভোটারদের বের করে দিয়ে ব্যালটে সিল দেওয়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশন কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সংঘর্ষ-সংঘাত হলে কোথাও কোথাও কিছু কেন্দ্রে ভোট স্থগিত বা বাতিলের ঘটনা নির্বাচন নিয়ে ওঠা প্রশ্নের জবাবে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়নি।
এরপর ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং দেশজুড়ে পৌরসভা নির্বাচনেও একই কায়দায় উঠে বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে কেন্দ্র দখলের অভিযোগ উঠে। তুলনামূলকভাবে কম হলেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দুই পর্বও এসব অভিযোগ থেকে মুক্ত না। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, নানা ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা, উদ্দেশ্য, ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তারা বলছেন, এই কমিশনের অধীনেই কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, সিলেট, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু এখন তারা নির্বাচন পদ্ধতির ওপর জনগণের বিশ্বাস রক্ষায় সেভাবে সফল হতে পারছেন না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনই দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। নির্বাচনে সব কিছুর দায়িত্বও কমিশনের ওপরই বর্তায়। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আইন অনুযায়ী যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কমিশনের আছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের আগের দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ তার বক্তব্যে যেকোনো ধরনের অনিয়ম কঠোর হাতে দমন করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ভোটের দিন কমিশনের এই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রমাণ মেলেনি। অনিয়মের অভিযোগে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা দুই সিটি করপোরেশনের ভোট থেকে সরে দাঁড়ালেও তাদের অভিযোগের বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। একইভাবে পৌরসভা নির্বাচনে ওঠা অভিযোগেরও প্রতিকার হয়নি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘গত দুই পর্বের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কিছু কিছু স্থানে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে তা অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আগের নির্বাচনগুলোতে কঠোর ব্যবস্থা নিলে উত্তরোত্তর সহিংসতা আর কারচুপির অভিযোগ উঠত না।’ সাতক্ষীরায় প্রথম ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ব্যালট পেপার বোঝাইয়ের ঘটনা উল্লেখ করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সাতক্ষীরায় পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এখন ইসি ডাকছে। কিন্তু তাদের তো ডাকার কোনো কারণ নেই, তাদের দায়িত্বে থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল ইসির। অপরাধীরা তো তাদের সামনেই ছিল। তারা এখন কীভাবে অপরাধী ধরবে? সুশাসনের জন্য নাগরিকÑসুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় হলো তারা কোনো ঘটনার দায়িত্ব নিতে চান না। যেমন কোনো শিশুর অভিভাবক যদি শিশুর দায়িত্ব না নেয় তাহলে শিশুটি এতিম হয়ে যাবে। তখন তার পক্ষে যেকোনো অপকর্ম করা স্বাভাবিক।
নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা, যা করার জন্য তারা শপথ নিয়েছেন। কিন্তু তারা যদি দায়িত্ব না নেন তাহলে নির্বাচনে অনিয়ম, জালিয়াতি তো হবেই।’ নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের আন্তরিকতাও জরুরি বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার। বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য সরকারের সদিচ্ছার প্রয়োজন। কারণ সরকারের অধীনে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি যথাযথভাবে তাদের কর্মকা- পরিচালনা না করে নির্বাচন কমিশনের কাজ করা দুরূহ হবে।একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছার এবং নাগরিকদের নাগরিকত্ব বোধ থাকতে হবে।’
প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা তো নির্বাচন কমিশনের রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন বলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, কঠোর অবস্থানে থাকবে তারা কিন্তু নির্বাচন চলাকালে তারা ব্যবস্থা সেভাবে নেয় না। সাতক্ষীরার ঘটনা উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সাতক্ষীরার ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের ডেকে এনে ভর্ৎসনা করেছে। ভর্ৎসনা তো আমরা শিশুদের করি। এটা তো কোনো শাস্তি হলো না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি দিতে হয়। অন্যায় করে পার পেয়ে গেলে অন্যায়কারী তো উৎসাহী হয়। দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশন অন্যায় দেখেও না, অন্যায় বিষয়টি শুনতেও চায় না। তাদের কাছে অভিযোগ করেও পার পাওয়া যায় না।’
রাঙামাটিতে ইউপি নির্বাচন স্থগিত নিয়েও প্রশ্ন
পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা ৪৯টি ইউনিয়নে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি এমন অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে গোটা জেলায় নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। তবে তুলেছেন অন্য একটি প্রশ্ন। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শতাধিক ইউনিয়নে প্রার্থী ছিল না বিএনপির। দলটির অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কর্মীদের হুমকির কারণেই তাদের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। নির্বাচন কমিশনের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেও প্রতিকার পায়নি দলটি। যদিও কমিশনররা ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, ‘রাঙামাটির মতো ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু তখন নির্বাচন কমিশন নির্বিকার ছিল। এখন যখন সরকার দলের প্রার্থীরা বাধার সম্মুখীন হয়েছে তখন তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাদের এমন কর্মকা-ই নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনভাবে কাজ করার ইচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য যথেষ্ট।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মোবারক হোসেন এই সময়কে বলেন, ‘সব জায়গা তো এক রকম হওয়া যায় না। ওই এলাকার পরিস্থিতি বুঝে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
কাগজে-কলমে যথেষ্ট শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন
সংবিধান ও আইনে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা ছাড়াও সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে অতিরিক্ত যা যা দায়িত্ব নির্ধারিত হবে, তা-ই করবে। আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেমের মামলার (ডিএলআর-৪৫, ১৯৯৩) রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলে, ‘নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করণীয়, তার সবই করতে পারবে।’ এমনকি নির্বাচনি আইন ও বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজন করে বিধান তৈরি করতে পারবে। আফজাল হোসেন বনাম প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (ডিএলআর-৪৫, ১৯৯৩) মামলার রায়েও সুপ্রিম কোর্ট একই মত দেয়। তবে নির্বাচন কমিশন সব সময় এসব ক্ষমতার প্রয়োগ করেনি বলে অভিযোগ আছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে আইনে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা যথাযথভাবে পালন করছি। আমরা ভালো কাজ করলেও ওনারা বলবে আমরা কাজ করি নাই।’ তাহলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন বলা যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘স্বাধীন কথাটা বলা ঠিক নয়। কারণ স্বাধীন হলো রাষ্ট্র। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র তাই এর কোনো অঙ্গ আলাদা আলাদাভাবে স্বাধীন হতে পারে না। কোনো প্রতিষ্ঠানই স্বাধীন হতে পারে না। কিছু কিছু লোক নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবি করে জাতিকে বাজে কথা বলছে।’
তবে নির্বাচন কমিশনের বর্তমান ও সাবেক একাধিক সদস্য ও কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আইনে যাই থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনের পাশাপাশি বিশেষ করে পুলিশ এবং সরকার দলের স্থানীয় কর্মীদের সহযোগিতা জরুরি। তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মতো শক্তি নির্বাচন কমিশনের নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমরা বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য ইসিকে দায়ী করছি কিন্তু আমি মনে করি, স্বচ্ছ নির্বাচনের দায় সরকারের ওপরও বর্তায়। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে তো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। সমস্যা হলো তাদের, যারা এই নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। আর এটিই কমিশনের কাজকে কঠিন করে দেয়। হ্যাঁ, এই কমিশন চাইলে পদত্যাগ করতে পারেন কিন্তু তাতে কি কোনো পরিবর্তন আসবে?’
চরম ক্ষমতা প্রয়োগে নির্বাচন কমিশনের অনীহা
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা আছে নির্বাচন কমিশনের। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ টি এম শামসুল হুদার কমিশন সংসদ নির্বাচনি আইন আরপিওতে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতার বিধান যোগ করে। এরপর ইউপি নির্বাচনে এ আইনটি নতুন করে যুক্ত করা হয়। কিন্তু এর আগে ক্ষমতাটি প্রয়োগযোগ্য নয় বলে একদফা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) থেকে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসি।
আচরণবিধির ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে কোনো উৎস থেকে প্রাপ্ত রেকর্ড বা লিখিত প্রতিবেদনে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী বা তার এজেন্ট বিধিমালা লঙ্ঘন করেছে বলে ইসির কাছে প্রতীয়মান হলে তা তাৎক্ষণিক তদন্তের নির্দেশ দেবে ইসি। তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে ওই প্রার্থী অযোগ্য হতে পারেন বলে কমিশন সন্তুষ্ট হলে তাৎক্ষণিক আদেশে তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে ইসি।’ আবার ৯১ (ই) ধারা অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী বা এজেন্ট বা তার পক্ষে অন্য কেউ এমন কোনো অন্যায় করলে (যার ফলে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হতে পারেন) কমিশন তদন্ত সাপেক্ষে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাকে ‘অর্থহীন ও অপ্রয়োগযোগ্য’ উল্লেখ করে ৯১ (ই) ধারাটি বাতিলের সুপারিশ করেছিলেন। পরে এ নিয়ে সমালোচনার মুখে তা থেকে সরে আসে ইসি। তবে কাগজে-কলমে ক্ষমতা থাকলেও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা মনে করেন, প্রার্থিতা বাতিল করলে বিতর্ক না কমে উল্টো বাড়বে। তাই এমন আইন প্রয়োগ না থাকায় সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় তাদের। নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ ও জাবেদ আলী সম্প্রতি বলছেন, প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা থাকলেও তা কখনো করা হয়নি। অর্থদ- ও কারাদ-ের বাইরে এমন বিধান রাখা ঠিক নয়। এমন ক্ষমতার প্রয়োগ না থাকায় সবার সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটিকে।
ভোট কারচুপির অভিযোগের প্রতিকার মেলে না
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, কোনোভাবে জোর জবরদস্তি করে নির্বাচন পার করতে পারলেই বিজয়ী প্রার্থীর আর সমস্যা নেই, এটা এখন প্রতিষ্ঠিত প্রায়। কারণ, কিছু মামলার নিষ্পত্তি হলেও বেশিরভাগ মামলা দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যায়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের ভোটের পর কারচুপির অভিযোগে করা মামলা পাঁচ বছরে সুরাহা হওয়ার উদাহরণ কম। এমন মামলা করে বাংলাদেশে কেবল দুইজন জাতীয় সংসদে বসতে পেরেছিলেন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর মামলায় জিতে সংসদ সদস্য হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর মামলায় জিতে সংসদ সদস্য হন টাঙ্গাইলের বিএনপি নেতা মাহমুদুল হাসান। আবার মামলায় হেরে একই সংসদে ভোলায় আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী জসিম উদ্দিন তার পদ হারিয়েছিলেন। কিন্তু আর ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে করা মামলার প্রতিকার হয়নি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও করা বেশিরভাব মামলার সুরাহা হয়নি এখনো।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে করা মামলারই যখন এই অবস্থা তখন তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনে হেরে গিয়ে মামলা করলে প্রতিকারের আশা থাকে না বললেই চলে। এ কারণে সে পথে যেতে চান না প্রার্থীরা। ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইনে বেশ কিছু সংস্কার করে। সে সময় নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির কথা ওঠে। কমিশনও বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু সেগুলো কার্যকর প্রমাণ হয়নি। জানতে চাইলে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ এই সময়কে বলেন, ‘নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ নিষ্পত্তি হলে ভবিষ্যতে কেউ আর অনিয়ম করতে পারত না। এতে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক কমে আসত। কিন্তু যেহেতু মামলাগুলো শেষ হয় না, তাই অনিয়ম করার প্রবণতাও থেকে যায়। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।