logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
বিএনপিতে অবিশ্বাস-সন্দেহ!
বোরহান উদ্দিন
২৯ মার্চ, ২০১৬ ২২:২৯:৫৩
image




সরকার পতনের আন্দোলনে দুই দুইবারের ব্যর্থতা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন উদাহরণ নেই। আর সরকার টেনে নামানোর চেষ্টায় সাফল্য না আসায় উল্টো সংকটে বিএনপি। নানা চেষ্টা করেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না দল। পৌরসভা আর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিলেও মাঠে নেতা-কর্মীরা সক্রিয় ছিল না সেভাবে। রাজনৈতিক পরিম-লে আপাতদৃষ্টিতে অপ্রতিরোধ্য আওয়ামী লীগ।



নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৩ সালে আন্দোলনে নামার আগে এমনটি হবে সেটা ধারণাতেও ছিল না বিএনপি নেতাদের।



নেতারা বলতেন, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে তাদের দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন আছে এবং এ কারণে সরকার দাবি মানতে বাধ্য হবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, বিএনপি আন্দোলনের যেসব কৌশল নিয়েছে, সেগুলো আগেভাগেই নানা মাধ্যমে জেনে গেছে সরকার। যে কারণে ভেস্তে যায় আন্দোলন। কীভাবে কারা তথ্য পাচার করেছে সে নিয়ে বিএনপিতে দানা বাঁধে অবিশ্বাস-সন্দেহ। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা নানা সময় এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। সমস্যাটি কতটা প্রকট সেটা জানা গেল জাতীয় সম্মেলনে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে। তিনি নিজেও বলেছেন, কিছু বেঈমান ভুগিয়েছে তাকে। এই বেঈমান কারা, তা অবশ্য প্রকাশ করেননি খালেদা জিয়া, যেমনটি প্রকাশ করেননি এর আগে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা নেতারাও।



বিএনপিতে সুবিধাবাদী, আঁতাতকারীরা জায়গা করে নিয়েছে এমন আলোচনা দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন সময় এসব অভিযোগ আড়ালে আড়ালে করা হলেও দলের কাউন্সিলের পর এটি এখন সামনে চলে আসছে। কারণ তৃণমূলের দীর্ঘদিনের এমন অভিযোগের সুরেই কথা বলেছেন খোদ খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘এরশাদ ছিয়াশিতে বেঈমানি করেছিলেন। আমাদের দলের মধ্যেও এমন কিছু বেঈমান আছেন, যাদের জন্য আন্দোলনে সেভাবে সফলতা আসেনি। মীরজাফরের রক্ত তো অনেকের মধ্যেই আছে।’







বেঈমান কারা?



সংস্কারবাদী, আঁতাতকারী ও সুবিধাবাদীদের দলে জায়গা না দিতে সব সময়ই সোচ্চার বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। জাতীয় সম্মেলনে দলের প্রধানের সামনেই এসব নেতাকে ‘বেঈমান’ আখ্যা দিয়ে তাদের ব্যাপারে চেয়ারপারসনকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন কাউন্সিলররা। তৃণমূলের বক্তব্যের পর যখন খালেদা জিয়া অনেকটা তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বক্তব্য দেন, তখন উপস্থিত নেতা-কর্মীরা উল্লাস করেন। খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের সময় হলরুমের বাইরে থাকা নেতা-কর্মীদের মধ্যে কৌতূহল প্রকাশ ও বলাবলি হচ্ছিল, কারা এই বেঈমান? কাউকে কাউকে বাইরে লাগানো পর্দায় সম্মেলন মঞ্চে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ও পেছনে বসা কেন্দ্রীয় কিছু নেতার ছবির দিকে ইঙ্গিত করতে দেখা যায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের অনেকে মঞ্চে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন।



তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে, কাউন্সিলররা তাদের বক্তব্যে ‘বেঈমান’, ‘মীরজাফর’ হিসেবে এক-এগারোর সময়ে সংস্কারবাদীদের চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে গত আন্দোলনে যেসব নেতা খালেদা জিয়াকে মাঠে থাকার আশ্বাস দিয়ে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন তাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তৃণমূলের নেতাদের এমন বক্তব্যের সময় কেন্দ্রীয় অনেক নেতা বিব্রত হন। তাদের কেউ কেউ সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত। অনেকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে আত্মগোপনে থাকার অভিযোগও আছে। বিএনপির নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে দলের পরিকল্পনার খবর পৌঁছে দেওয়ার। নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে ফেরা খবর হলো, খালেদা জিয়ার আশপাশেই এসব আঁতাতকারীর অবস্থান।



জাতীয় সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘ম্যাডাম, কেউ কেউ আপনাকে আশ্বাস দিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে সরকারের পতন ঘটানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারা আন্দোলনের সময় মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছিলেন। তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।’ বরিশালের আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘বেঈমান, মীরজাফরদের নতুন কমিটিতে দেখতে চাই না। যদি বেঈমানদের চিনতে চান তাহলে আশপাশ আর পেছনে তাকান, তাহলেই বুঝতে পারবেন।’ কাউন্সিলে খালেদা জিয়ার বেঈমানদের নিয়ে এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মাহবুবুর রহমান ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।



তবে বিএনপির খুলনা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘আন্দোলনে থাকার আশ্বাস দিয়েও যারা ছিলেন না, নেতা-কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন, চেয়ারপারসন তাদের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন বলে আমি মনে করি।’ নতুন কমিটিতে চেয়ারপারসনের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটবে এমন প্রত্যাশা করে মঞ্জু বলেন, ‘এই বক্তব্য নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে, যা আগামী দিনের আন্দোলনে ফল দেবে।’ এই বেঈমানদের নিয়ে দলের চেয়ারপারসনের এমন মন্তব্যের পর বিএনপিতে নতুন করে সন্দেহ-সংশয় দেখা দিয়েছে। কমিটি গঠন আর দল পুনর্গঠন নিয়ে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।



নিষ্ক্রিয় নেতাদের নিয়ে অবিশ্বাস



দুই দফায় খালেদা জিয়ার চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক আসার পর দেখা গেছে, দলের প্রধানের আহ্বানে সাড়া দেননি নেতাদের একটি অংশই। আন্দোলন শুরু হলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের একাংশ আত্মগোপনে গেছেন, কেউ কেউ তাদের ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। এমনকি খালেদা জিয়াও অনেক নেতাকে ডেকে পাননি এমন ঘটনাও ঘটেছে। আবার নানা সময় ঘরোয়া বৈঠকের তথ্য ফাঁস হয়েছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। দলের নির্বাহী কমিটির অনেক নেতার বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগও আছে। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সন্দেহ, গ্রুপিং দানা বেঁধেছে। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের একাংশ এবং ঢাকা মহানগরসহ গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের শীর্ষ নেতাদের দিকেও সন্দেহের আঙুল তুলছেন নেতা-কর্মীরা।



দশম সংসদ নির্বাচনের আগে টানা তিন মাসের আন্দোলনে থাকা বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে। এ জন্য সারা দেশে অবরোধ-হরতাল পালন করে বিএনপি। তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলনে কর্মীদের অংশগ্রহণ থাকলেও রাজধানীতে নেতা-কর্মীদের নিষ্ক্রিয়তায় কার্যকর কিছু করতে পারেনি বিএনপি। খালেদা জিয়ার কঠোর হুঁশিয়ারিতেও সক্রিয় হননি নেতাদের একটি অংশ। নির্বাচনের পর হঠাৎ করে স্থগিত করা হয় আন্দোলন। জাতীয় সম্মেলনে আনা তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, নেতাদের একটি অংশের চাপাচাপিতে চেয়ারপারসন ভুল বুঝে আন্দোলন থেকে পিছুটান দিয়েছেন। কিন্তু এমনটি না করে আন্দোলন চালিয়ে গেলে সরকার এখনকার মতো কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠতে পারত না বলেই দাবি করেছেন বিএনপির তৃণমূলের নেতারা।



বেঈমানদের কারণেই তথ্য ফাঁস!



২০১২ সালে হঠাৎ করেই বিএনপির অভ্যন্তরীণ গোপন খবর-তথ্য ফাঁস হওয়ার খবর প্রকাশ হতে থাকে। চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষ থেকে কলমসদৃশ ১৮টি গোপন ক্যামেরা, অডিও-ভিডিও ডিভাইস উদ্ধারের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন খালেদা জিয়া। সেসময় খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। বলা হয়, গুলশান কার্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একটি অংশ খালেদা জিয়ার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন। এদেরকে বিশ্বাস করতেন খালেদা জিয়া। আর এই বিশ্বস্ততার সুযোগেই তারা গোপনে এসব যন্ত্র স্থাপন করতে পারেন যেগুলো দিয়ে অডিও-ভিডিও বাইরে চলে যেত বলেই ধারণা আছে বিএনপিতে।



দলীয় সূত্র জানায়, আড়ি পাততে গোয়েন্দাদের ব্যবহার করা এসব যন্ত্র উদ্ধারের কিছুদিন আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গুলশান কার্যালয়ে যান চট্টগ্রামের একজন বড় ব্যবসায়ী। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী একান্ত বৈঠক শেষে ওই ব্যবসায়ী গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার কক্ষের সামনে যেতেই কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা তার পথরোধ করেন। ব্যবসায়ীকে তিনি বলেন, ‘আপনি ম্যাডামকে বেশ কিছু বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। এটা ঠিক হয়নি।’ প্রশ্ন শুনেই হতভম্ব হয়ে যান ওই ব্যবসায়ী। এ সময় তিনি কার্যালয় থেকে বের হয়ে সঙ্গে থাকা এক ব্যক্তিকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্তে কী কথা বলেছি, তা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বাইরে থেকে কীভাবে জানল?’



সঙ্গে থাকা ব্যক্তির পরামর্শে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ওই ব্যবসায়ী তার চশমা ভুল করে রেখে এসেছেন অজুহাতে আবার খালেদা জিয়ার কক্ষে যান। বিএনপি চেয়ারপারসনকে তথ্য পাচারের বিষয়টি তিনি খুলে বলেন। ওই ব্যবসায়ীর কথা শোনার পর তাৎক্ষণিকভাবে কার্যালয়ের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে নিজের কক্ষে তলব করেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার নির্দেশে ওই রাতেই গুলশান কার্যালয়ের সব কক্ষ, সিলিং, ফুলের টব, কার্পেট ও আসবাবপত্র তল্লাশি করা হয়। চেয়ারপারসনের কক্ষ, কনফারেন্স রুম, ফুলের টব, সিলিং ও অন্যান্য কক্ষ থেকে আড়িপাতার যন্ত্র উদ্ধার করা হয়।



এছাড়াও দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের কারো কারো বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পাচারেরও অভিযোগ তোলা হয়। এসব কারণে ২০১৩ সালের এপ্রিলের দিকে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সব সদস্যের মোবাইল ফোন কার্যালয়ের নিচে নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে জমা রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিষয়টি নিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেকে হন বিব্রত।



পুনর্গঠনে বাদ পড়ছেন ‘বেঈমান’রা



বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন। দ্বিতীয় অধিবেশনে দলের সাংগঠনিক প্রতিবেদন নিয়ে বক্তব্য রাখেন জেলা ও উপজেলা থেকে আসা প্রায় ১৫ জন কাউন্সিলর। এদের মধ্যে অন্তত ১০ জন তাদের বক্তব্যে বিএনপিতে সুবিধাবাদী, বেঈমান আছে বলে অভিযোগ করেন। তারা বলেন, এদের কারণেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। দল পুনর্গঠনের সময় এসব নেতা যেন কোনো পদ না পায় সে জন্য দাবি জানান তৃণমূলের নেতারা। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের এসব বক্তব্য আর নিজ দলের নেতাদেরকে নিয়ে খালেদা জিয়ার অবিশ্বাসের বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি গণমাধ্যমে। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ঠিকই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।



বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও বলছেন, নেতাদের নিয়ে দলেই যদি সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকে তাহলে দল চালানো কঠিন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, বড় রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকেই। তবে বিএনপিতে এটা একটু বেশিই। দলের সংকটকালেই এর প্রকাশ হয় বেশি। কারণ দলে শৃঙ্খলা তুলনামূলকভাবে কম। বিএনপির জন্ম অনেকটা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। এছাড়া বিভিন্ন দলের ভিন্ন ভিন্ন মতের লোকজন দলটিতে আসায় পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। একেকটি উপদলের নেতারা এখানে নিজেদের জায়গা করে নিতে নানা ধরনের চেষ্টায় লিপ্ত হয়।



একইভাবে দলের একটি অংশকে বরাবর তারা কোণঠাসা করে রাখতে চায়। যখন তারা দেখে দলের ভবিষ্যৎ অনুজ্জ্বল তখন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সঙ্গেও যোগাযোগ করে। নেতৃত্বে এই সন্দেহ-অবিশ্বাস থেকে বিএনপি কি কখনই মুক্ত হতে পারবে না? এ প্রশ্নের জবাবে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘অবশ্যই পারবে। এ জন্য বিএনপিকে গণমুখী করতে হবে। তৃণমূলকে সংগঠিত করতে হবে। দলের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদেরকে নেতৃত্বের সামনের সারিতে আনতে হবে।’ এই যখন অবস্থা তখন অনেকের মনে নানা প্রশ্ন জেগেছে। তাহলো আগামী দিনে এই নেতাদের বাদ দিয়ে খালেদা জিয়া দলের নির্বাহী কমিটি করতে পারবেন কি না। কথিত বেঈমানদের আগের মতো দলে রাখলে আবার বিএনপিকে হতাশ হতে হয় কি না এমন প্রশ্নই বেশি তুলছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। খালেদা জিয়া অবশ্য বলছেন, ‘চিহ্নিত বেঈমানরা আর সুবিধা করতে পারবে না। মীরজাফরদের আর দলে পদ দেওয়া হবে না।’



দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর সুষ্ঠুভাবে জাতীয় সম্মেলন করতে পেরে স্বস্তিতে বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তাদের দাবি, নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এই সম্মেলন করতে পারায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। গ্রাম পর্যায়ের নেতারা চেয়ারপারসনের কাছে খোলামেলাভাবে নিজেদের কথা বলতে পেরেছেন। এই অবস্থায় সুবিধাবাদী নেতাদের মধ্যেও এক ধরনের সতর্ক বার্তা পৌঁছে গেছে। যা আগামী দিনের দল পরিচালনা ও আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখবে।



নির্বাহী কমিটি কবে?



ছয় বছর পর জাতীয় সম্মেলন হলেও তাতে মহাসচিব নির্বাচন হয়নি। দলের স্থায়ী বা নির্বাহী কমিটিতে কারা থাকছেন সে প্রশ্নের উত্তরও এখনো অজানা। জাতীয় সম্মেলনে এসব কমিটি করতে খালেদা জিয়াকে একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নতুন কমিটিতে পদ পাওয়া এবং পদোন্নতির আশায় যারা বুক বেঁধে আছেন তাদের দিন কাটছে অজানা আতঙ্কে। কারণ খালেদা জিয়ার গুডবুকে থাকলেই কেবল পদ মিলবে এমনটা মোটামুটি সবাই নিশ্চিত। তবে কবে নির্বাহী কমিটি ঘোষণা হবে তা জানা নেই কারও। দায়িত্বশীল পর্যায়ের নেতারা সুনির্দিষ্ট করে তারিখ বলতে না পারলেও চলতি মাসের মধ্যে মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটি অথবা দুটো ঘোষণা আসবে বলে তারা আশা করছেন।



তবে দলের বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, নতুন কমিটি ঘোষণা করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগতে পারে। কারণ এবারের কমিটি হবে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে। বিগত আন্দোলনে অনেক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। অনেক নেতার দ্বিমুখী চরিত্র বিশেষ করে প্রকাশ্যে একরকম আবার অন্তরালে অন্যরকম খালেদা জিয়া এমন নেতাদের সম্পর্কে জানেন। কাউন্সিল অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে খালেদা জিয়া এমন নেতাদের কমিটিতে রাখা হবে না বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘সবার প্রত্যাশা তৃণমূলের নেতাদের যে বক্তব্য চেয়ারপারসন শুনেছেন এবং তিনি যা নিজে থেকে অবগত হয়েছেন সেই আলোকে ত্যাগী নেতাদের দিয়ে কমিটি করবেন। আমরা সবাই এখন ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে আছি।’



সাত বছর কমিটি না হওয়ায় সাবেক ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের বহু নেতা পদহীন অবস্থায় আছেন। সারা দেশের ত্যাগী এবং সাহসী নেতারা আছেন, যারা বিগত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন জেলায় জেলায়। তাদেরকে এবার বঞ্চিত করবে না বিএনপি। ফলে কমিটির আকার প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে। বড় কমিটি করতে গেলে স্বাভাবিকভাইে সময় একটু বেশি লাগবে বলে মন্তব্য করেছেন দলের একজন নেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘কমিটিতে কারা থাকবেন আর কারা বাদ যাবেন তা আসলে চেয়ারপারসনই ভালো জানেন। তিনি আগের মতো কারও সঙ্গে শেয়ার করছেন না। আশা করি তৃণমূলের প্রত্যাশা অনুযায়ী কমিটি হবে। তবে এবার কমিটি বড় হতে পারে। তাই সময় বেশি লাগতে পারে।’



তৃণমূলের পুনর্গঠনের কী হবে?



৯ আগস্ট দল পুনর্গঠনের জন্য বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান তৃণমূলে চিঠি দিয়ে দলের সব ইউনিট কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচনের কারণে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া কিছুদিন স্থগিত ছিল। জানুয়ারিতে সেই প্রক্রিয়া ফের শুরু হলেও কাউন্সিল ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে বিএনপির জেলা এবং এর অধীন থানা-উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন প্রক্রিয়া চলায় নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছিল। এ জন্য কাউন্সিলের প্রস্তুতির কার্যক্রমের গতি বাড়াতে এবং ইউপি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই ও সুষ্ঠু প্রস্তুতির স্বার্থে দলের চেয়ারপারসন কমিটি গঠন প্রক্রিয়া স্থগিত করার নির্দেশ দেন, যা এখনো বলবৎ আছে।



তবে দলের কাউন্সিল শেষ হওয়ার পর দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি করার তোড়জোড় শুরু হলেও তৃণমূলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া কবে নাগাদ শুরু হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা পাননি নেতারা। সহসা তৃণমূল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে কি না তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলার সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বেশিরভাগ জেলায় নির্দেশনা অনুযায়ী কমিটি হয়নি। সেক্ষেত্রে কাউন্সিলে এ নিয়ে নির্দেশনা থাকলে ভালো হতো। আশা করি নির্বাহী কমিটি ঘোষণার পাশাপাশি স্থগিত জেলা কমিটি পুনর্গঠনের নির্দেশনাও পাওয়া যাবে।’



সন্দেহ-অবিশ্বাস চলছেই...



আন্দোলনে নামলেও কেন ব্যর্থ হয় বিএনপি? দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আছে নানা ধারণা। তাদের ধারণা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমন-পীড়নের পাশাপাশি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও এ জন্য দায়ী। দেখা গেছে, নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যতটা না সক্রিয়, তার চেয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ ও রেষারেষিতে বেশি ব্যস্ত। এমন দ্বন্দ্ব শীর্ষ মহল পর্যন্ত আছে। যেমন স্থায়ী কমিটি। এই কমিটির কেউ কেউ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। কেউ কেউ অসুস্থ, আর নানা ফোরামে কথা বলে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন কেউ কেউ। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে সরকার আবার উদার। তারা কোনো হয়রানির শিকার হননি কখনো। কেন এই নেতারা বারবার ছাড় পাচ্ছেন, এ নিয়ে কথা উঠেছে বিএনপিতে।



নীতিনির্ধারণী বিষয়ে মতবিরোধ ও আস্থাহীনতা স্থায়ী কমিটিকে আরও নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে বলে অনেকের মত। যদিও কেউ কেউ এ জন্য দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ না দেওয়া বড় কারণ বলে মনে করছেন। আস্থাহীনতার উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিষয়টি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য খালেদা জিয়াকে মোদির সঙ্গে বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে ব্রিফ করেন। কিন্তু ওই নেতাকেই মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকে রাখা হয়নি। আবার চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখেন দলের এমন শীর্ষ একজন নেতাকে বাদ দিয়েই সে দেশে পাঠানো হয় বিএনপির প্রতিনিধি দল।



এ ছাড়া ঢাকা মহানগরে মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার দ্বন্দ্ব; চট্টগ্রামে আবদুল্লাহ আল নোমান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও শাহাদাত হোসেনের ত্রিমাত্রিক বিরোধ; কেরানীগঞ্জে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমান উল্লাহ আমানের মধ্যে পুরনো বিরোধ তো রয়েছেই। অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার দাবি করেন, দলের স্থায়ী কমিটি বা নির্বাহী কমিটিতে কোনো কোন্দল বা অবিশ্বাস নেই। এই নেতা বলেন, ‘চেয়ারপারসন স্থায়ী কমিটি বা নির্বাহী কমিটিতে যাদের আনবেন, তাদের নিয়ে কোনো কোন্দল হবে বলে মনে করি না।’



বিভিন্ন সময় বিএনপি নেতাদের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনাকেও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দে¦র বহিঃপ্রকাশ বলছেন নেতা-কর্মীরা। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দল থেকে পদত্যাগী ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর ফোনালাপ ফাঁস প্রথম ঘটনা। এর কিছুদিন পর স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ও আবদুল মঈন খানের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার পর অনেক দিন বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা মোবাইল ফোনে দলীয় বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করতেন। যদিও এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। তবে আতঙ্ক কাটেনি। বিএনপি নেতাদের দাবি, দলকে বেকায়দায় ফেলতে গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকারের এজেন্টরা ফোনালাপ ফাঁস করছে।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।