logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
হ্যাকার ভয়ংকর
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
১৬ মার্চ, ২০১৬ ০০:০৫:৩৩
image




ব্যাংকে টাকা রাখা কি অনিরাপদ হয়ে পড়ছে দিন দিন? এটিএম বুথ থেকে টাকা গায়েব, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা চুরি হওয়ার পর এই প্রশ্ন সামনে আসছে ঘুরে ফিরে। একের পর এক এসব ঘটনায় সাধারণ গ্রাহকের মধ্যে তৈরি হচ্ছে আস্থার সংকট। দেখা দিয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। যেখানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর, সেখানে রাষ্ট্রের প্রধান এই ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা বেহাত হওয়া আতঙ্কের বটে। কদিন আগে বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম কার্ড এবং বুথের নিরাপত্তা জোরদারে নির্দেশনা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটিএম কার্ড হ্যাক করে টাকা তুলে নেওয়া এবং কেনাকাটা করছিল একটি সংঘবদ্ধ চক্র। কার্ড জালিয়াতির ওই ঘটনায় আতঙ্কিত ছিলেন সাধারণ গ্রাহক। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট  হ্যাক হওয়ার পর সেই আতঙ্ক আরও বেড়েছে।



জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের একটি বড় অংশ রাখা আছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে। সেখান থেকে টাকা তুলতে হলে প্রয়োজন হয় বাংলাদেশের অনুমতি। ব্যাংকিং ভাষায় যাকে বলা হয় অ্যাডভাইস বা পরামর্শ। একটি সংকেত কোড (সুইফট কোড) ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো ‘পরামর্শ’ (অ্যাডভাইস) অনুযায়ী অর্থ স্থানান্তর করেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এরকম ৩০টি পরামর্শ পাঠানো হয়েছিল ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে। এর মধ্যে পাঁচটি কার্যকর হয়েছে। আর তাতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার চলে গেছে ফিলিপাইনে।



প্রযুক্তিবিদ এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে এসব ‘পরামর্শ’ পাঠানো হয়েছে। চীনের হ্যাকাররা এই কা- ঘটিয়েছে। প্রশ্ন, হ্যাক করে টাকা তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো বার্তা কি পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক? শোনা যাচ্ছে, আন্তর্জানিক কারসাজির মাধ্যমে টাকা তুলে নেওয়ার অনেক পরের দিন ৫ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি টের পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তারা বিষয়টি গোপন রেখেছিল। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, যে ৩০টি ‘পরামর্শ’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে গিয়েছিল তার সব কটি কার্যকর হলে দেশের রিজার্ভের একটি বড় অংশ চলে যেত হ্যাকারদের কাছে। এতে রাষ্ট্রীয়ভাবে রিজার্ভ সংকটে পড়ার আশঙ্কা ছিল। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে টাকা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এটা রাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি।



অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘বিভিন্ন সময় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট হ্যাকড হওয়ার খবর পাওয়া যায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করার খবর নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটা নাজুক হলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরও কত করুণ তা অনুমেয়।’ তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় চীনা হ্যাকাররা জড়িত বলে ধুয়া তুলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায় এড়াতে পারবে না। এর পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট কেউ জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘটনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও কঠিন মাশুল দিতে হবে।’



বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে খুব বেশি কথা বলছে না গণমাধ্যমের সঙ্গে। একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। জানানো হয়েছে, চুরি হয়ে যাওয়া অর্থের একটি অংশ তারা ফেরত এনেছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে। তবে সেটা অনেক পরে। ততদিনে গণমাধ্যমে বিষয়টি ফলাও হয়েছে। এমনকি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বিষয়টি নাকি প্রথম শুনেছিলেন সাংবাদিকদের কাছ থেকে। গত সোমবার (৭ মার্চ) সাংবাদিকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি স্পষ্ট বলেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। এর পরদিন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বলেন, টাকা নিয়ে যাওয়ার এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দোষ কিছু নেই। তাই তিনি নিউইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার কথাও জানান। পরে অবশ্য তার ভুল ভাঙে। সরে যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এবং সরিয়ে দেয়া হয় দুই ডেপুটি গভর্নরকেও। এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসলাম আলমকেও তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।



সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রের এত বড় একটি ঘটনা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক না জানা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিলম্ব অনুধাবন অব্যবস্থাপনার উদাহরণ।







বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ কি জড়িত?



মার্কিন ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা সরিয়ে নেওয়ার পেছনে হ্যাকার চক্রকে দায়ী করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই হ্যাকার চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কিংবা বর্তমান কেউ জড়িত ছিলেন কি? কারণ, প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার থেকে যেভাবে টাকা স্থানান্তর করার জন্য ‘অ্যাডভাইস’ বা ‘পরামর্শ’ পাঠানো হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, কাজটি বেশ পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হয়েছে। সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে না ঢুকে কাজটি কঠিনই বটে। এক্ষেত্রে যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার কিংবা অ্যাডভাইস সংক্রান্ত গোপন তথ্যাদি জানেন তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি একেবারে অমূলক নয়। তাছাড়া যে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে ‘পরামর্শ’গুলো পাঠানো হয়েছে তা একেবারে গোপনীয়। এতে সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।



ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কিন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হ্যাকড করে টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়টি একেবারে সহজ নয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকের কেউ জড়িত থাকতে পারেন। বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করলে বেরিয়ে আসতে পারে। আর যদি কেউ জড়িত নাও থেকে থাকেন তাহলেও ব্যাংকের আইসিটি বিভাগ এই দায় এড়াতে পারে না। কারণ, তাদের প্রযুক্তিগত দুর্বলতার সুযোগেই হ্যাকার চক্র এই কাজ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো সর্বোচ্চ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমন হেয়ালিপনা কোনোভাবে মেনে নেওয়ার মতো নয়। এর দায় সংশ্লিষ্টদের নিতেই হবে।



কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় জড়িত সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকেরই আট কর্মকর্তাকে। এরা আছেন গোয়েন্দা নজরদারিতে। ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, কৌশলে ওই কর্মকর্তাদের পাসপোর্টও নাকি জব্দ করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। যদিও উদ্ধৃত হয়ে কেউ এ নিয়ে কথা বলতে চাননি।











হ্যাকারদের অস্ত্র ম্যালওয়্যার ও ট্রোজেন হর্স!



বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ সিস্টেমের আইডি হ্যাক করতে হ্যাকাররা ম্যালওয়্যার ও ট্রোজেন হর্স নামে দুটি ভাইরাস ব্যবহার করেছেন বলে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন। তবে ব্যাংকের কেউ যদি সহযোগিতা করে থাকেন তাহলে এটা সরাসরি হ্যাকড হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা থাকা ১০ কোটি ডলার হ্যাকিংয়ের তদন্ত উপদেষ্টা হিসেবে এখন কাজ করছেন রাকেশ মাস্তান। তিনি বিশ্বব্যাংকের সাবেক আইটি উপদেষ্টা। গত ৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকে ৫৬টি ব্যাংকের আইটি এক্সপার্ট এবং সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে এই হ্যাকিংয়ের বিভিন্ন দিক এবং আশঙ্কা নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা উপস্থিত ছিলেন।   



তানভীর হাসান বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে ম্যালওয়্যার ভাইরাস ইনফেকশনের মাধ্যমে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের আইডি (সুইফট কোড) নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এরপর তারা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে অ্যাডভাইস পাঠায়। তবে পাঁচটি অ্যাডভাইসের পরই হ্যাকিংয়ের বিষয়টা টের পায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক।’ তিনি বলেন, ‘এর সঙ্গে ট্রোজেন হর্স নামে আরও একটি ভাইরাসকে কাজে লাগানো হয়েছে। এখানে ম্যালওয়্যার ও ট্রোজেন হর্স একসঙ্গে কাজ করেছে।’ তিনি জানান, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমেই হ্যাকার ঢুকেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নয়। হ্যাক হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম।’



এ নিয়ে তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সাইবার অ্যাট হোমের চিফ স্ট্যাটেজিক অফিসার সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘ম্যালওয়্যার হলো এক ধরনের ভাইরাস বা এপ্লিকেশন। এটাকে যদি কোনো কম্পিউটারে ইনফেক্ট করানো যায় তাহলে তিনি ওই কম্পিউটারের সব তথ্য যিনি ইনফেক্ট করেছেন তার কাছে পাঠিয়ে দেবে। ট্রোজেন হর্সেরও একই বৈশিষ্ট্য। তবে ট্রোজেন হর্স একটি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ যদি জড়িত না থাকেন তাহলে এটাই হলো হ্যাকিংয়ের পদ্ধতি।’



এই দুটি ভাইরাস কম্পিউটারে পাঠাতে সরাসরি কম্পিউটারের সং¯পর্শে যেতে হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় ইনফেক্ট করা সম্ভব। এটা বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে থাকে, কেউ তার কম্পিউটারে ডাউনলোড করলেই তিনি এর শিকার হবেন। তিনি জানতেও পারবেন না।’







দরকার উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার



একের পর এক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাকড, এটিএম কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের অর্থ লোপাট বন্ধে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি জোর দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, যে প্রবণতা শুরু হয়েছে এটা সহজে থেমে যাবে তা ভাবা ঠিক হবে না। প্রতারক ও জালিয়াত চক্র সব সময়ই এ ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব গোটা দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের নিরিখে বাংলাদেশ এখনো নবীন। অনেক বাধা উতরেই বাংলাদেশ শক্তিশালী এবং নিরাপদ জায়গায় যেতে হবে। আর্থিক নিরাপত্তা দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব মনোযোগী হতে হবে।



এমন পরিস্থিতিতে অনলাইনে অর্থ লেনদেনে সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন দেশের ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, উন্নত বিশ্বের ব্যাংকিং লেনদেনে আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে বেছে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক হ্যাকার চক্র। রূপালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহমেদ আল কবির বলেন, ‘প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের পিছিয়ে থাকলে হবে না। এখন বিশ্বায়নের যুগ। আমেরিকা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করছি না বলেই আমাদের ওপর এমন আক্রমণ হচ্ছে।’



আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে ও হ্যাকিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা জোরদার করার কথা বললেন অর্থনীতিবিদ মামুন রশীদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কার্যক্রম জোরালো করার পরামর্শ দিলেন সাবেক ব্যাংকার আহমেদ আল কবির। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাংকারদের প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিকে নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।







যেভাবে বেহাত হয় টাকা



ফিলিপাইনের সংবাদমাধ্যম এনকোয়্যারারের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের মোট ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে অনুপ্রবেশ করানো হয়। এর মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সফলভাবে স্থানীয় ব্যাংক থেকে তুলে নেয় সংশ্লিষ্টরা। তবে সঠিক সময়ে শনাক্ত করায় ৮৭ কোটি ডলার তুলে নেওয়ার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। গত মাসে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনকে (আরসিবিসি) ওই অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যাংক।



প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাচারকৃত ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থ প্রাথমিকভাবে ফিলিপাইনের এক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়কারীর কাছে পাঠানো হয়। পরে তা সোলেয়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনো, সিটি অব ড্রিমস ও মাইডাস এ তিন ক্যাসিনোয় স্থানান্তর করা হয়। সেখানে এ অর্থ জুয়ার টেবিলে ব্যবহারের উদ্দেশে বেটিং চিপসে রূপান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসব চিপসকে আবার নগদ অর্থে রূপান্তর করে হংকংয়ের একাধিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে সংশ্লিষ্টরা।



ফিলিপাইনে এখন পর্যন্ত ধরা পড়া সবচেয়ে বড় অর্থ পাচারের ঘটনা এটি। বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করে এনকোয়্যারার জানিয়েছে, মাকাতি সিটির জুপিটার স্ট্রিটে অবস্থিত আরসিবিসির শাখা থেকে এ অর্থ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শাখাটির প্রধান এরই মধ্যে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এতে বলা হয়, ইয়ুচেঙ্কো পরিবার নিয়ন্ত্রিত আরসিবিসি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা লেনদেনের প্রতিটি পর্যায় স¤পর্কে অবগত।



ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ তদন্তের অংশ হিসেবে ওই শাখা ব্যবস্থাপককে এরই মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপকের এক প্রতিনিধি কিছু প্রমাণপত্র দেখিয়ে এনকোয়্যারারকে জানান, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনুমোদন নিয়ে শাখা ব্যবস্থাপক ওই লেনদেন করেছেন। তাকে ২০১৫ সালের মে মাসের মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। এজন্য তাকে পাঁচটি পরিচয়পত্রও সরবরাহ করা হয়। অর্থ পাচারের এ ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর এসব পরিচয়পত্র ভুয়া বলে ধারণা করা হচ্ছে।



ওই প্রতিনিধি জানান, শাখা ব্যবস্থাপক এখন এ সম্পর্কে মুখ খুলতে চাইছেন। কারণ তার ধারণা, এ পুরো ঘটনায় তাকে ফাঁসানো হতে পারে। তবে অর্থ লেনদেনের এ কার্যক্রম স¤পন্ন করার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ ছিল। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের না জানিয়ে এত বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন সম্ভব নয়।



জড়িত ছিল মার্কিন ব্যাংক



এনকোয়্যারারের সংগৃহীত কাগজপত্র অনুযায়ী, চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক থেকে পাচারকৃত ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার আরসিবিসির পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। আন্তর্জাতিক ওয়্যার ট্রান্সফারের মাধ্যমে এ অর্থ স্থানান্তর করা হয়। এ স্থানান্তরের বিষয়ে করেসপনডেন্ট ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, সিটি ব্যাংক ও ওয়েলস ফারগো। আত্মসাতকারীরা সুইফট ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের ফিলিপিনো প্রতিনিধিকে অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে অবহিত করে।



ফিলিপাইনে পৌঁছার পর কয়েক মাস আগে খোলা আরসিবিসির উল্লিখিত পাঁচটি হিসাবে এ অর্থ পাঠানো হয়। পরে তা স্থানীয় মুদ্রা পেসোয় রূপান্তরের জন্য পাঠানো হয় বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমে। এর পর আবারো আরসিবিসিতে পাঠিয়ে একজন চীনা-ফিলিপিনো ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাবে এ অর্থ একত্র করা হয়। তার পর ক্যাসিনোয়। ওই শাখা ব্যবস্থাপক ও তার প্রতিনিধি দুজনই তাদের পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেন নিরাপত্তার স্বার্থে। তারা দাবি করেন, ব্যাংকিং খাতের অথবা অর্থপাচার রোধ-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা তারা লঙ্ঘন করেননি। এমনকি এ-স¤পর্কিত তদন্তে সাক্ষ্য প্রদানেও প্রস্তুত আছেন বলে জানান দুজন।



সরকারি একটি সূত্রমতে, চীনা-ফিলিপিনো ওই ব্যবসায়ীর মাধ্যমেই পাচারকৃত এ অর্থ হংকংয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। আরসিবিসি থেকে পুরো অর্থ বের হয়ে যাওয়ার পর সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) বার্তার মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার ফেরত চাওয়া হয় ব্যাংকটি থেকে। পাশাপাশি ৮৭ কোটি ডলার জব্দের অনুরোধ করা হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। আরসিবিসি সূত্র জানায়, যথাসময়ে ৮৭ কোটি ডলার জব্দ করা সম্ভব হলেও আগের চালানটি থামানো সম্ভব হয়নি। কর্তৃপক্ষ সচেতন হওয়ার আগেই ওই অর্থ অফশোরে স্থানান্তর হয়ে গেছে।











কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে যা বলা হয়  



বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক হিসাবে রক্ষিত স্থিতি থেকে ‘হ্যাকড’ হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অর্থের একাংশ এরই মধ্যে আদায় করা সম্ভব হয়েছে। অবশিষ্ট অঙ্কের গন্তব্য শনাক্ত করে তা ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছে। ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে তাদের দেশের আদালতে মামলা দায়ের ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবগুলোর ফ্রিজ আদেশ আদালত থেকে সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাস¤পন্ন একজন সাইবার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক ও তার ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন টিম এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের টিমের সঙ্গে কাজ করছে।



কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের তদন্ত স¤পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থ ফেরত আনতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রয়োজনবোধে বিশ্বব্যাংকের স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি প্রক্রিয়াও অবলম্বন করা হবে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে দেশে ও দেশের বাইরে তদন্তলব্ধ তথ্যাদি অপ্রকাশিত রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বৃহত্তর আর্থিক খাতে সাইবার নিরাপত্তা সার্বিকভাবে নিñিদ্র করার প্রক্রিয়া জোরালোভাবে সচল রাখা হয়েছে।



বিশ্বায়নের এ যুগে আর্থিক লেনদেনে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি অবলম্বনের বিকল্প নেই উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ সত্য অনুধাবন করে প্রযুক্তির উৎকর্ষকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন ব্যাংকিং সেবা উদ্ভাবন ও আত্তীকরণের মাধ্যমে দেশবাসীকে আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদানে দেশের আর্থিক খাত এক অভাবনীয় বিপ্লব সাধন করেছে। তবে ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে যেমন গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি ও আধুনিক বিশ্বের ব্যাংকিং সেবাকে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে, অন্যদিকে বাড়িয়ে তুলেছে সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিও। উন্নত বিশ্বে ব্যাংকিং খাতে সাইবার আক্রমণ অনেকটা নৈমিত্তিক ঘটনা হলেও বাংলাদেশের জন্য একেবারেই নতুন। আর্থিক খাতের অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সাইবার অপতৎপরতার বিষয়ে অবহিত হওয়া মাত্রই তা মোকাবেলায় তৎপর রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর অনুসরণীয় বিষয়ে সার্কুলার জারি করেছে। পরবর্তী সময়ে যাতে বড় ধরনের আর কোনো আর্থিক ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে বাংলাদেশে কার্যরত সব তফসিলি ব্যাংকের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ নিচ্ছে।







টাকা গেছে ক্যাসিনোতে



ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ হ্যাক করে এ অর্থ শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনে সরিয়ে নেয় চীনা চক্রটি। ফিলিপাইনের গণমাধ্যম এনকোয়্যারার সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, প্রবাসী ফিলিপিনোদের রেমিট্যান্স স্থানান্তরকারী সংস্থা ফিলরেমের মাধ্যমে হ্যাক হওয়া অর্থ রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের মাকাতি সিটি শাখায় জমা হয়। এর পর স্থানীয় মুদ্রা পেসোয় রূপান্তর করে তা একটি করপোরেট হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। করপোরেট ব্যাংক হিসাবটি চীনা বংশোদ্ভূত এক ফিলিপিনো ব্যবসায়ীর। ওই ব্যবসায়ীর হিসাব থেকে অর্থ স্থানান্তর হয় তিনটি স্থানীয় ক্যাসিনোয়। পুরো ঘটনাটি ঘটে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে।



গত ৭ মার্চ ফিলিপাইনের পত্রিকা দ্য এনকোয়্যারার তাদের অনলাইন সংস্করণে জানিয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাকড হওয়া অর্থ সেখানকার স্থানীয় ক্যাসিনোতে ব্যয় হয়েছে। পত্রিকাটি জানায়, ফিলিপাইন আরও ৮৭০ মিলিয়ন ডলার আটকে দিয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফিলিপাইনের স্থানীয় ব্যাংকে হ্যাকাররা নিয়ে গিয়েছিল।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।