logo ২২ এপ্রিল ২০২৫
বাংলাদেশি শ্রমিক না নেয়া
ভারত-চীনের চাপে মালয়েশিয়ার হঠকারিতা?
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
১৪ মার্চ, ২০১৬ ০৮:২২:২৫
image



ঢাকা:  শ্রমিক নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একের পর এক হটকারী আচরণ করেছে মালয়েশিয়া। একে তুলনা করা হচ্ছে ‘পুতুল খেলা’র সঙ্গে। একদিন বলল শ্রমিক নেবে না তো পরেই বলল সরকার-সরকার পদ্ধতিতে শ্রমিক নেবে; এ নিয়ে বেশ এগিয়ে যাওয়ার পর সেখানেও বাগড়া। সে বাগড়া সেরে আবার সরকার-সরকার-বেসরকার পদ্ধতি। এভাবে একের পর এক হটকারিতার পর অবশেষে জানিয়ে দিল তারা বাংলাদেশ থেকে কোনো শ্রমিক নেবে না।






২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এই খেলার সর্বশেষটি ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ১৫ লাখ শ্রমিক নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সই করে মালয়েশিয়া। পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি এই চুক্তির কার্যকারিতা সাময়িক স্থগিত এবং ১২ মার্চ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দেশটি।






বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার মতো একটি মুসলিম দেশের এ রকম হটকারী সিদ্ধান্ত কেন? ঢাকাটাইমসের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে বেশ কিছু কারণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো পাঁচটি।






প্রধান কারণ হলো- বাংলাদেশের বদলে ভারত থেকে শ্রমিক নেয়ার জন্য মালয়েশিয়ার ওপর চাপ ছিল এশিয়ার প্রভাবশালী দেশটির। মালয়েশিয়ায় কাজ করছে ভারতের অনেক শ্রমিক। আরও শ্রমিক পাঠাতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে মৌখিক আলোচনা করেছে তারা। কিন্তু মালয়েশিয়া যখন বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক নেয়ার ঘোষণা দেয়, তখনই ভারত সরকার ও দেশটির মানবসম্পদ রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলো মালয়েশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। মালয়েশিয়াও তাদের প্রস্তাব বিবেচনায় নেয়। 






এশিয়ার আরেক বৃহৎ শক্তি চীনও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রচুর কর্মী জোগান দিয়ে থাকে। তারাও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানির জন্য মুখিয়ে আছে। ফলে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে চীন থেকে শ্রমিক নেয়ার বিষয়ে মালয়েশিয়ার ওপর বাড়তি চাপ ছিল তাদের।






এসবের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ চাপও ছিল বেশ তীব্র। দেশটির বিরোধী দল, শ্রমিক সংগঠন, মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি সংস্থা চাইছে বিদেশ থেকে শ্রমিক না নিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমিকদের আগে নিয়োগ দেয়া। এসব নিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে।






এসব ‘ফ্যাক্টর’ বিবেচনায় নিয়ে মালয়েশিয়া বাংলাদেশে থেকে সঙ্গে শ্রমিক নেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে।






প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও দেশের বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।






তাদের ভাষ্য, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীও এই হটকারী সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত। তিনি আন্তর্জাতিক লবির কাছে মাথা বিক্রি করে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।






এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব বেগম শামছুন নাহার কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে শ্রমিক নেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা পাইনি।” তবে মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে এমনটি হতে পারে বলে তিনি জানান।   






মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাসার ঢাকাটাইমসকে বলেন, “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার। শিশুর জন্মের আগেই মৃত্যু ঘটল। মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করার আগে আমাদের সরকারের ভালো করে বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করার দরকার ছিল। আমরা ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসা করতে চাই। আমরা চাই এই পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণ হোক।”






নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বায়রার এক সদস্য ঢাকাটাইমসকে বলেন, “মালয়েয়িশার এই ঘোষণার ফলে শ্রমিক রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অনেকেই আমাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে; যদিও এটি একটি ঘটনা মাত্র।”






তবে আরেকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মালয়েশিয়া ১৫ লাখ কর্মী নেয়ার বিষয়ে চুক্তি বাতিল করলেও ‘প্রফেশনাল ভিসায়’ কর্মী নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে মানুষের কাছে এ ঘটনায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে।”






দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে ‘জিটুজি’ পদ্ধতিতে ‘প্ল্যান্টেশন’ খাতে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে শুরু করে মালয়েশিয়া। তবে এ পদ্ধতিতে আশানুরূপ কর্মী দেশটিতে না যাওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ সাগরপথে জীবনবাজি রেখে মালয়েয়িশার উদ্দেশে যাত্রা করে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সমালোচনার জন্ম দেয়। এ প্রেক্ষাপটে জাহিদ হামিদি গত জুন মাসে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি তথা রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সব খাতে ১৫ লাখ কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণার আলোকেই গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তি সই হয়। তবে এ চুক্তির পরদিনই জাহিদ হামিদির ঘোষণায় বিপুলসংখ্যক কর্মী যাওয়ার পথ আটকে যায়।






মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির জন্য দুই দেশের মধ্যে প্রায় সাত বছর ধরে একের পর এক শুধু উদ্যোগই নেওয়া হয়। কিন্তু শীর্ষ ওই শ্রমবাজারের বন্ধ দুয়ার বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। সরকারিভাবে পাঁচ বছরে ৫ লাখ শ্রমিক পাঠানোর সেই বহুল আলোচিত ঘোষণাও আর আলোর মুখ দেখেনি।






এরপর বেসরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানির (বিটুবি) আলোচনা চলছিল। এরই মধ্যে আকস্মিকভাবে চলে আসে সরকার চাইলে বেসরকারি রপ্তানিকারকদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে (জিটুজি প্লাস) পারবে।






তবে দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবায়নে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে মালয়েশিয়ার একটি সিদ্ধান্ত, যার মাধ্যমে দেশটির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কয়েকটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করবে বলে আশঙ্কা করেন এই খাতসংশ্লিষ্টরা।






বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া। দেশটিতে ২০০৭ সালে ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ জন এবং ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন শ্রমিক গিয়েছিলেন। কিন্তু নানা অনিয়ম ও প্রতারণার কারণে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয় দেশটি। এরপর ২০১২ সালের নভেম্বরে দুই দেশের মধ্যে সরকারিভাবে কর্মী নেওয়ার চুক্তি হয়। তখন মালয়েশিয়া ৫ লাখ কর্মী নেওয়ার আশ্বাস দেয়।






এ নিয়ে সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের (বর্তমানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী) আশ্বাসে মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার লোক নিবন্ধন করেন। সরকারের সফলতা হিসেবে বিষয়টি ব্যাপক প্রচারও পায়। নাম নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেই কেবল ৭ কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু গত তিন বছরে পাঠানো গেছে মাত্র আট হাজার শ্রমিক।






সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, সরকারিভাবে কম টাকায় লোক নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলেও মালয়েশিয়া পর্যাপ্ত চাহিদাপত্র পাঠায়নি। বেসরকারি জনশক্তি রপ্তারিকারকরাও ভেতরে ভেতরে সরকারি পর্যায়ে কর্মী পাঠানোর বিরোধিতা করতে থাকে। পরবর্তীতে সরকারও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারায় ব্যর্থ হয় সরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানি।






(ঢাকাটাইমস/১৪মার্চ/মোআ)