logo ২২ এপ্রিল ২০২৫
ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী
শুরুতেই খুনোখুনি, শঙ্কা বাড়াল সহিংসতার
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
০৮ মার্চ, ২০১৬ ১৮:১৬:২৪
image




ঢাকা: ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থিতার কারণে  খুনোখুনির আশঙ্কা করা হচ্ছিল বিভিন্ন মহলে। আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হতে না হতেই দেশের বেশ কয়েক স্থানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ সোমবার পটুয়াখালীতে বাউফলে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ইউপি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি।



প্রথম ধাপের ৭২৬টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের মধ্যে তিন শতাধিক ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর মোকাবেলা করতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে।  বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে কেন্দ্রের হুঁশিয়ারি থাকলেও তা আমলে নেননি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। ফলে সংঘর্ষ-সহিংসতার আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে।



নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা জানান, পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ইউপি নির্বাচনে। তৃণমূলের বলে এমনিতেই  এই নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা বেশি থাকে, তার ওপর এবার বিদ্রোহীদের কারণে এই আমঙ্কার মাত্রা বাড়ছে।  



অবশ্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া আছে।



আসন্ন ইউপি নির্বাচনে কয়েক স্তরে যাচাই-বাছাই করে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু তার পরও ঠেকানো যায়নি বিদ্রোহী প্রার্থী।



দেশে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হচ্ছে। ২২ মার্চ প্রথম দফা ইউপি নির্বাচনের ভোট নেয়া হবে। ইতিমধ্যে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ও প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়ে গেছে। এখন চলছে প্রচারণা।



আনুষ্ঠানিক প্রচারণার শুরু থেকেই নির্বাচনী মাঠ গরম হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যেসব ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে, সেগুলোতে উত্তেজনা বেশি।



এদিকে আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঠেকাতে ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিবৃত্ত করতে চেষ্টা নিচ্ছে দলটি। যার দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে  প্রার্থী হয়েছেন, তাদের তালিকা করা হচ্ছে। এর সমন্বয় করছেন সভাপতিম-লীর সদস্য ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তার নেতৃত্বে সমন্বয় সেলের নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।  তারা দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিচ্ছেন।



নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আ.লীগের একাধিক সম্পাদকম-লীর নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, দেশে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন এই প্রথম হচ্ছে। তাই বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি।  পর্যায়ক্রমে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কমে যাবে।



কিন্তু ভিন্নমত করছেন দলের অনেক নেতা।  নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা জানান, পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ইউপি নির্বাচনে।  



পৌরসভা নির্বাচনে শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন ক্ষমতাসীন দলে। তাদের মধ্যে ২০ জন বিজয়ী হন। অনেক জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।  পৌরসভা নির্বাচনে  বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে সাময়িক বহিষ্কারের কথা জানা গেলেও এরপর আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।  ফলে ইউপিতে বিদ্রোহীর আধিক্য ঘটেছে।



পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে বড় কোনো সংঘর্ষ না হলেও ইউপি নির্বাচনে এর বিপরীত ঘটনাই ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। তাদের আশঙ্কার কারণ- ইউপি নির্বাচন একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের বলে এখানকার কর্মীরা প্রার্থীর  সরাসরি কর্মী কিংবা এলাকাবাসী-আত্মীয়স্বজন। ফলে প্রার্থীর পক্ষে আনুগত্য ও মর্যাদার বিষয়টি এক ধরনের মরিয়া ভাবের জন্ম দেয় তাদেও মধ্যে।  ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনায় এই আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে।



প্রথম ধাপের ৭২৬টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যার তিন শতাধিক ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী। অনেক ইউপিতে আবার একাধিক বিদ্রোহী। ফলে তিন শতাধিক ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। আবার এমন উপজেলাও আছে, যার প্রায় সব কটি ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন।  



স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে এমনই তথ্য পেয়েছে ঢাকাটাইমস।



স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১টি ইউনিয়নে রয়েছে দলটির এক বা একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী।  



১ নম্বর পোড়াগাঁও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন মো. আজাদ মিয়া; ২ নম্বর নন্নী ইউনিয়নে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও আবদুল হাই আজাদ; ৩ নম্বর রাজনগর ইউনিয়নে তানজিল আহমেদ রিমন ও শাহীন; ৫ নম্বর রামচন্দ্রকুড়ায় মো. খোরশেদ আলম খোকা; ৬ নম্বর কাকরকান্দিতে নাজিম উদ্দিন, নিয়ামুল কাউসার সোহাগ, নাজমুল হোসেন; ৮ নম্বর রূপনারায়ণকুড়ায়; এ এইচ এম মোস্তাফা কামাল, ১০ নম্বর যোগানিয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী তাকিজুল ইসলাম তারা, আওয়ামী ঘরানার স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আনসার আলী, মো. আবদুল জলিল, ১১ নম্বর বাঘবেড় ইউনিয়নে হাসানুজ্জামান রিয়াদ, গোলাম মোস্তাফা; ১২ নম্বর কলসপাড় ইউনিয়নে জাহাঙ্গীর আলম, ফকর উদ্দিন নয়ন, জয়নাল আবদীন ও মিজানুর রহমান।



ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ১০টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পাঁচজন।



পাবনার বেড়া উপজেলার নয়টি ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বেশ কজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেন, পুরান ভারেঙ্গা ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাশেম; চাকলায়  সরোয়ার হোসেন; মাসুমদিয়ায় বর্তমান চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম; হাটুরিয়া নাকালিয়ায় আবদুর রহিম; রূপপুরে বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নুরু মোল্লা; নতুন ভারেঙ্গায় আবু দাউদ; জাতসাখিনীতে মিজানুর রহমান রানা।



নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চারটি ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে আওয়ামী লীগের। তমরদি ইউনিয়নে তিনজন বিদ্রোহ্-ী কামাল উদ্দিন, ফারুক হোসেন ও বুলবুল; চরকিং ইউনিয়নে মহিউদ্দিন; সোনাদিয়ায় ইয়াসিন আরাফাত কানু ও জাহাজমারায় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন অ্যাডভোকেট মাসুম বিল্লাহ।



পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সাফা ইউনিয়নের বিদ্রোহী মোহাম্মদ ফারুক, মাছুয়া ইউনিয়নে নাইমুল হোসেন, দাউদখালি ইউনিয়নে বজলুর রহমান, সাতলেজা ইউনিয়নে ইউনুচ মোল্লা। তারা সবাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক বা যুবলীগের দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন।



খুলনার তেরখাদার অজগরাতে বাদশা মল্লিক, তেরখাদায় বাসাহাটে তারিকুল ইসলাম, ডমুরিয়ার সদরপুরে রবিউল ইসলাম, সোহানায় সুরঞ্জিত বৌদ, বটিয়াগাটা উপজেলার সুরখালিতে বিদ্রোহী প্রার্থী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর রহমান সাগর।



ইতিমধ্যে বিদ্রোহী  প্রার্থী ও দলের মনোনীত প্রার্থীরা পরস্পর সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। অনেক স্থানে বিদ্রোহী প্রার্থীদের হয়রানির অভিযোগও এসেছে। এসব ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে আওয়ামী লীগই নির্বাচনী মাঠে লড়াই করতে যাচ্ছে, যা দলীয় প্রার্থীর জন্য পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।



সোমবার রাতে পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলা আদাবাড়িয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আশ্রাফ ফকির।



স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার রাতে আব্দুল বারেকের বাড়িতে বৈঠক করছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সামসুল হক ফকির। বৈঠককে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীরের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সামসুল হকের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের অন্তত ১৬ জন আহত হন। তাদের মধ্যে আশ্রাফ ফকিরকে বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।



জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ঢাকাটাইমসকে বলেন, “অনেক যাচাই-বাছাই করে তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে। এখানে বিদ্রোহী হওয়ার সুযোগ নেই। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা প্রার্থিতা বহাল রাখবেন, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।”



(ঢাকাটাইমস/৮মার্চ/মোআ)