logo ২২ এপ্রিল ২০২৫
দখল উচ্ছেদ আর দখলের খেলা
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
০১ মার্চ, ২০১৬ ০০:০৭:১৮
image




নগরজীবনের ভোগান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে হাঁটার রাস্তা দখল করে করা অবৈধ দোকান বা পার্কিংয়ের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা। ফুটপাতে জায়গা না পেয়ে পথচারীরা হাঁটছে সড়ক ধরে। অথবা ফুটপাতের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে স্বল্প দূরত্ব পার হচ্ছে রিকশা বা অন্য কোনো গাড়ি দিয়ে। আর পার্কিংয়ের জায়গায় অন্য স্থাপনা থাকায় সড়ক দখল করে দাঁড়িয়ে থাকছে গাড়ি। ফলে নিত্য যানজটের এই নগরে তৈরি হচ্ছে আরও যানজট। এটা কেবল কোনো এক দিনের চিত্র নয়। বছরের পর বছর ধরে এই সমস্যা চলে আসছে। সিটি করপোরেশন, পুলিশ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের অভিযানও কম হয়নি। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কখনো। প্রতিবার অভিযানের সময় ঘোষণা দেওয়া হয়, আগে যা হয়েছে, এবার থেকে পাল্টে যাবে পরিস্থিতি। কিন্তু পাল্টায় না কখনো। বরং দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে সব। দখল হচ্ছে নতুন নতুন জায়গা। অস্থায়ী দোকানগুলো কখন স্থায়ী হয়ে যায়, তা বুঝতেই পারে না কেউ।



অভিযানে উচ্ছেদ হয় না তা নয়, কিন্তু সেটি দিন কয়েকের জন্য, কখনো বা ক্ষণিকের জন্য। আবার ফিরে আসে দখলদাররা। আর অভিযানের খবর পেয়ে পথ চলায় স্বস্তির আশা নিয়ে থাকা নাগরিকরা আবার হতাশ হয়। সচিবালয়ের উল্টো দিকে ওসমানী উদ্যানের দক্ষিণে হাঁটার রাস্তাটি বেশ চওড়া। কিন্তু পথচারীদের হাঁটার জন্য এতটুকু রাস্তাও খালি নেই। খানিক দূরে দূরে গোল হয়ে জটলা পাকিয়ে বসেছে এক-একটি দল। কেউ খেলছেন বাগবন্দি। কেউবা কার্ড নিয়ে বসেছেন। ‘কী খেলছেন?’ জানতে চাইলে একজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন ঠিকই, কথা বললেন না। ছোট দলে ভাগ হয়ে বসা এসব লোকের বেশির ভাগই ভাসমান। যাদের রাত-দিন দুটোই হয় পার্কে। নগরভবনের দিকে মুখ করা কামান সোজাসুজি ফটক। বেরোতেই চোখে পড়ল আরেক চিত্র। ঠিক ফটক লাগোয়া ফুটপাতে বসেছে মুঠোফোনের পসরা। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মুঠোফোন। দেখতে চকচকে হলেও এগুলোর বেশিরভাগই পুরনো, জিজ্ঞাস করে জানা গেল। বেচাকেনা কেমন তা জানা না গেলেও দোকানের সামনে ভিড় কম নয়। পছন্দসই সেট হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছেন, দামদর করছেন। দরকষাকষিও চলছে বেশ। তার দু-চার পা সামনে গেলে মিলল চার্জার লাইট, ফ্যান।



ফুটপাতে পলিথিন বিছিয়ে চলছে বেচাকেনা। এখানে বেচাকেনা ভালো। যারাই দেখছেন, কমবেশি কিনছেন। এভাবে একের পর এক দোকান বসেছে ফুটপাতে। শুধু বাহারি পণ্যই নয়, ছোলামুড়ি, পিঠা, লেবু ও বেলের শরবত, কাঁটাফল এবং চা টং দোকানও বেসেছে সারি হয়ে। রোদ-বৃষ্টি এড়াতে পলিথিন দিয়ে অস্থায়ী ছাউনিও আছে দোকানগুলোর ওপর। ঠিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (নগরভবন) ভবনের উল্টোদিকের এই চিত্র দেখে বোঝার উপায় নেই এটি কোনো ফুটপাত। বরং মনে হবে, ছিন্নমূল দোকানিদের জন্যই গড়ে দেওয়া হয়েছে জায়গাটি। ফুটপাতের ধার বেয়ে যারা চলছেন তারাই অন্যায় করছেন। দোকানিদের হাবভাবে মনে হচ্ছে, তাদের কোনো দোষ নেই। বরং পথচারীদের জন্যই ক্রেতা ভিড়ছেন না তাদের দোকানে। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ যেন তারই প্রমাণ।



সিটি করপোরেশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই-আড়াই মাসে একবার-দুবার নয়, কম করে হলেও সাত থেকে আটবার উচ্ছেদ অভিযান চালালেও অবৈধ দখল একেবারে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। বরং নগর কর্মকর্তাদের অনেকের আক্ষেপ, সকালে উচ্ছেদ চালিয়ে অফিসে ফিরে দাপ্তরিক কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে ঠিক সাবেক অবস্থা দেখতে পেয়েছেন তারা। ‘বুঝলেন ভাই, উচ্ছেদ-ফুচ্ছেদ এখন রুটিন ওয়ার্ক। করতে হয় করি। আদতে উচ্ছেদের পর এগুলোর দখলমুক্ত রাখার জন্য যে ধরনের জনবল দরকার তা নেই। উচ্ছেদ করে দিতে পারি, কিন্তু দিন-রাত লাঠি হাতে পাহারা দেওয়া তো সম্ভব নয়’, বলছিলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রমে থাকেন এমন একজন কর্মকর্তা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, ‘ফুটপাত বা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে এটা ঠিক যে, আমরা অভিযানের পর নজরদারি চালাতে পারছি না। এ কারণে পুরোপুরি সফল হওয়া যাচ্ছে না।’



বিশিষ্ট নগরবিদ ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। এজন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই নগর পরিকল্পনা। তিনি বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরীর যেসব সমস্যা থাকে ঢাকাতেও তাই আছে। আমরা বারবারই বলে আসছি ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য যে ধরনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন ছিল তা নেওয়া হয়নি। এজন্যই ফুটপাত, সড়ক দখল থেকে শুরু করে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে।’ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ছিন্নমূল ব্যবসায়ী যারা যত্রতত্র দোকান সাজিয়ে বসছেন তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে? নগর পরিকল্পনার ভেতর এই বিষয়গুলোও আশা উচিত। যদি তাদের বিকল্প জায়গার ব্যবস্থা করে দেওয়া যেত তাহলে উচ্ছেদ অভিযান দরকার হতো না।’



ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়ররা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, যেকোনো মূল্যে ঢাকাকে অবৈধ দখলের হাত থেকে বাঁচাবেন। শুধু তাই নয়, সিটি করপোরেশনের যেসব সম্পদ অবৈধ দখলে আছে সেগুলো উদ্ধার করবেন। জলাশয়গুলোর শোভাবর্ধনের কাজ করবেন। ফুটপাত তো বটেই, বিভিন্ন জায়গায় গায়ের জোরে দখল করে গড়ে তোলা পাকা-কাঁচা স্থাপনাগুলোও গুঁড়িয়ে দেবেন শক্ত হাতে। কিন্তু নির্বাচনের পর পরই প্রতিশ্রুতি রাখতে নগরপিতারা সফল হতে পারেননি, এক কথায় বলা যায় জোর দিয়েই। নির্বাচনের পর পরই ছিল রোজার ঈদ। ঈদকে ঘিরে ফুটপাতে হকার শ্রেণির ব্যবসায়ীদের আনাগোনা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। তার প্রায় আড়াই মাসের মাথায় সড়ক দখল পেল ভিন্নমাত্রা।



নিয়ম করে হাট নিলাম হলেও ঢাকার রাস্তায় হাট বসানোর প্রবণতা যে পুরোপুরি বন্ধ ছিল, একথা বলতে পারবে না কেউ। বরং উত্তরা, বনানী, গাবতলী, সায়েদাবাদের মতো ব্যস্ত রাস্তায় পশুর হাট বসিয়ে নগরবাসীকে বেশ ভোগান্তির মধ্যে ফেলেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এর কয়েকদিন অন্তর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অভিযান চলেছে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, উপসড়কের পাশে।ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজও বাদ যায়নি এ থেকে। এসব অভিযানের পর দিনসাতেক কিছুটা স্বস্তি মিললেও আবারও যেইসেই অবস্থাতেই ফিরে গেছে ঢাকা। উচ্ছেদ-পুনর্দখলের এই খেলা শুধু পল্টন, গুলিস্তান কিংবা ফুলবাড়িয়াতেই নয়, ঢাকাময় একই দশা। ঢাকার শুরু সেই আবদুল্লাহপুর থেকে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার ব্রিজ, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, গাবতলী আমিনবাজার পর্যন্ত কোথাও কোনো ফাঁকা নেই। সব জায়গাতেই ফুটপাত, সড়কের একাংশ দখল করে দোকানপাট বসছে নিত্য। বিকিকিনিও চলছে।



সড়কের ওপর দোকান বসানো যেন কোনো অপরাধই নয়, বরং এটাই ঠিক। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট থেকে কাঁটাবন যেতে সড়কের হাতের ডানের রাস্তাটিতে দুটো লেন। অথচ একটি লেন দিয়েই যানবাহন চলাচল করে। অন্যটি বরাবরই থাকে দখলে। রিকশা, ভ্যান মেরামতের গ্যারেজ, ময়লার ভাগাড় আর টং দোকানিদের রাম রাজত্ব কায়েম হয়েছে সড়কটিতে। এখানে কখনো উচ্ছেদ অভিযান চলেছে এমন নজির নেই। কারণ জানতে চাইলে স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, ‘কার বাপের এত সাহস এই রাস্তায় হাত দেয়। সরকার দলীয় লোকজনই এখানের হর্তাকর্তা। এ দোকানিদের কেউই মুক্ত নয়, সবাই কমবেশি ভাড়া গোনেন।’ অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদের পরও কেন আবার পুনর্দখল হয় ফুটপাত, সড়ক? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া দায়-ই বটে। কারণ, অপ্রিয় হলেও সত্য এসবের পেছনে আছে ‘শক্তহাত’।



যারা নির্বাচনের আগে ঢাকার ফুটপাতগুলো অন্তত ফাঁকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই কাউন্সিলরদের সদিচ্ছার অভাবেই যাচ্ছেতাই অবস্থা মেনে নিয়েই পথ চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আবার ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দোষ দিতেও ছাড়েন না স্থানীয়রা। তবে ফুটপাত কিংবা রাস্তার ধার ঘেঁষে যারা দোকান করছেন, তাদের অজুহাতও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বলা হয়েছিল, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হবে। হকারদের জন্য অস্থায়ী হাটের ব্যবস্থা হবে। কিন্তু কোথাও কি এসব আয়োজন আছে? নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসবের পেছনে ঢাকার হর্তাকর্তা এবং রাজনীতিকদেরই আগ্রহ নেই। এসব অবৈধ দোকানপাট থেকে দৈনিক যে ‘ভাড়া’ তোলা হয় তার একটি অংশ মাসোহারা হিসেবে যায় নেতাদের পকেটে।



ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের একশ্রেণির নেতা এসব বাণিজ্যে বেশ মশগুল। যাদের কারণে চাইলেই রাতারাতি পাল্টে ফেলা যাচ্ছে না ঢাকার চিত্র। আবার অবৈধ দখলের পর ঠেকানো যাচ্ছে না পুনর্দখল। ঢাকাকে ‘হঠাৎ অভিযানে’ দখলমুক্ত করার চেষ্টারত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক তো একবার এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেই বসলেন, ‘সবাই বলেন, ফুটপাত থেকে হকার তুলে দেন, রাস্তা দখলমুক্ত করেন। কিন্তু এটা তত সহজ নয়। তারা টাকা দিয়ে বসেছেন। শক্ত শক্ত হাত এর পেছনে আছে।’ মেয়র না জেনেই এমন মন্তব্য করেছেন, তা বলা যাবে না। ঢাকার ব্যস্ত সড়কের একটি শাহবাগ এলাকা। এই এলাকাতে বৈধ দোকানপাটের চেয়ে অবৈধ দোকানপাটের সংখ্যাই ঢের।



হোটেল রূপসী বাংলার সীমানা শেষ হলেই বাংলাদেশ বেতারের কার্যালয়। এই কার্যালয়ের সীমানা ঘেঁষে ফুটপাত শেষ হয়েছে শাহবাগের চার রাস্তার মোহনার কাছাকাছি। কিন্তু ফুটপাতে পথচারীদের জন্য স্বস্তিতে পথ চলার সামান্যতম জায়গাও খালি নেই। ফলমূল, খাবার, পত্র-পত্রিকার দোকানেই ঠাসাঠাসি পুরো পায়ে হাঁটার রাস্তা। অথচ ওই এলাকায় সবচেয়ে ব্যস্ততম তিনটি হাসপাতাল রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম হাসপাতাল এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল। প্রতিদিন হাজার হাজার রোগীর আনাগোনা এসব হাসপাতালে। সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, রোগীদের স্বস্তিতে পথ চলার সুব্যবস্থা নেই শাহবাগ এলাকায়। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের ছোট সড়ক দ্বীপটিতে বসে তিন থেকে চারটি ভ্রাম্যমাণ দোকান।



মহাখালীও ঢাকার ব্যস্ত এলাকার একটি। অথচ ওই এলাকায় পায়ে হেঁটে পথচলা যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা ভাষায় প্রকাশ যোগ্য নয়। মহাখালীর আমতলী থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পর্যন্ত ফুটপাতে দোকানগুলো এমনভাবে বসেছে যে, ক্রেতাদের দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। কেনাকাটা করার জন্য মূল সড়কে দাঁড়াতে হয়। একই অবস্থা আমতলী থেকে তিতুমীর কলেজ হয়ে গুলশানে যাওয়ার রাস্তাটিও। ফুটপাতই নয়, সড়কের ওপর ভ্যান দাঁড় করিয়ে যেসব পসরা সাজানো হয় তা দেখলে মনেই হবে না, এটা কোনো রাস্তা।



প্রভাবশালীদের দখলে ফুটপাত



ফুটপাতে অবৈধ দখলের পেছনে আছে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাত। যাদের কারণেই দিনের পর দিন দখলে থাকছে জনসাধারণের জন্য তৈরি করা হাঁটার রাস্তা। দুই সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীতে ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাতই রয়েছে প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে। এছাড়া নগরীর ২ হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার ফুটপাতেই রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় বসেছে পণ্যের পসরা। পথচারীরা বিড়ম্বনায় পড়ছেন প্রতি পদে পদে। ফুটপাত নিয়ে চলছে বড় অঙ্কের বাণিজ্য। রাজধানীর ফুটপাতে পসরা সাজানো হকারদের কাছ থেকে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা পরিচয়ে ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে নানা ধরনের পণ্যসামগ্রীর দোকান থেকে তোলা হচ্ছে এই চাঁদা। ভাগ পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যেও।



যেসব কারণে টেকসই হয় না উচ্ছেদ অভিযান



রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, জিপিও, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, বায়তুল মোকাররম, ক্রীড়াভবন, দৈনিক বাংলা, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, মতিঝিল, মৌচাক-মালিবাগ, ফকিরাপুল, টিকাটুলি, সদরঘাট, বঙ্গবাজার, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, ঢাকা কলেজ, গাউছিয়া, আজিমপুর, নীলক্ষেত, লালবাগ, চকবাজার, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, গুলশান, গাবতলী, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মোড়, শাহবাগ, রামপুরা, শাহজাদপুর, মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা ও হকারমুক্ত করতে সম্প্রতি একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। কিন্তু দেখা গেছে সকালে হকারদের উচ্ছেদ করে গেলে বিকেলে অথবা কয়েকদিন পরই আবার তারা ফুটপাত দখল করে বসে যাচ্ছে।



এ ধরনের উচ্ছেদ অভিযান টেকসই হয় না প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, বিপুল সংখ্যক হকারের বিকল্প বসার জায়গার ব্যবস্থা না করা হলে তারা লাঠির বাড়ি খেয়েও আবার ফুটপাতেই বসতে চাইছে। দ্বিতীয়ত, ফুটপাত নিয়ে রাজনৈতিক ক্যাডার-মাস্তান আর পুলিশের চাঁদাবাজি বাণিজ্য গোড়াতে বন্ধ না হলে এই উচ্ছেদ কার্যকর হবে না বলে মনে করেন নগরবিদরা। উত্তরায় সড়কের ওপর ভ্যান পেতে বসা একজন দোকানি বলেন, ‘পুলিশ আগে থেকেই জানিয়ে দেয় কখন অভিযান চলবে। অভিযানের আগে আমাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। ওইদিন কোনো টাকা দিতে হয় না।’ ওই দোকানি আরও বলেন, তাদেরও কিছু করার নেই। কারণ তাদের বিকল্প কোনো জায়গা না থাকায় পুলিশের লাঠির আঘাত হজম কিংবা ধাওয়া খেয়েও রাস্তার ধারে দোকান পেতে বসতে হয়।’



ভাসমান ব্যবসায়ীদের গতি হবে কোন কালে?



ফুটপাত কিংবা সড়ক দখল করে দোকান বসানোর পেছনের বড় কারণ ভাসমান ব্যবসায়ীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। দিনের পর দিন তাই খোলা আকাশের নিচেই থাকতে হচ্ছে তাদের। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই জীবন-জীবিকার অন্বেষণ করছেন তারা। এসব ভাসমান ব্যবসায়ীদের কল্যাণে অনেক উদ্যোগই কাগজে-কলমে ছিল। কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সড়ক ও ফুটপাতের অবৈধ দখল শক্ত হাতে সরিয়ে দেওয়া হলেও তা বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পরে বর্তমান সরকারের শুরুর মেয়াদে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল উচ্ছেদ করা ভাসমান ব্যবসায়ীদের জন্য হলিডে মার্কেট করার। দু-এক সপ্তাহ সেই মার্কেট বলবতও ছিল। কিন্তু তা আর দীর্ঘ হয়নি। কদিন যেতে না যেতেই আবারও সড়কের ওপরেই চলে এসেছেন স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরা।



অভাব নজরদারির



ফুটপাতের অবৈধ দখল উচ্ছেদের পর আবারও যত্রতত্র দখল হয়ে যাওয়ার পেছনে আছে নজরদারির ঢিলেঢালা ভাব।শক্ত হাতে যদি এসব নজরদারির মধ্যে আনা যেত তা হলে একই সমস্যায় বারবার পড়তে হতো না। নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো কাজ করার পর তা নজরদারির মধ্যে আনা সম্ভব না হলে এর সুফল পাওয়া যাবে না। ঢাকায় অবৈধ দখল বা স্থাপনা উচ্ছেদের পর তা টেকসই হয় না কেবল শক্ত নজরদারির অভাবে।’ নজরদারি বাড়ানো গেলে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সুফল দীর্ঘদিন পাওয়া সম্ভব হতো। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের তত্ত্বাবধানেই পুনরায় রাস্তায় নেমে আসছে হকাররা। দিনের শেষে তাদের মাসোহারাও গুনতে হচ্ছে।



পার্কিংয়ে দোকানপাট!



সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আলোচনায় আসে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় কার স্থাপনা ভেঙে দেওয়ার কাজ। কিন্তু কদিন পর যে লাউ সে কদু। রাজউকের জরিপ বলছে, অধিকাংশ ভবনের নিচে নেই কোনো পার্কিং ব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, মুখে মুখে পার্কিং বলা হলেও দেখা যায় এসব জায়গাতে দোকান তুলে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়ে গাড়ি পার্কিং করতে হচ্ছে রাস্তায়। এসব অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে রাস্তায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটছে।



কিন্তু অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কদিন পর আবারও ভেঙে দেওয়া স্থাপনায় নতুন করে স্থাপনা তৈরি করতে দেখা গেছে। এসব অভিযানে মূলত যারা ভাড়া নিয়েছে তাদেরকেই জরিমানা করা হয়। কিন্তু ভবন মালিকের কার্যত কোনো ক্ষতিই হয় না। তাই তিনি কদিন পর আবার একই কাজ করেন। বরং এই উচ্ছেদ অভিযান তার জন্য সাপে বর হয়। নতুন করে স্থাপনা তৈরি করে আবার ভাড়া দিলে অগ্রিম হিসেবে বড় অঙ্কের টাকা পান তিনি।



টার্মিনালের বাইরে বাস-ট্রাক



নিয়ম হচ্ছে টার্মিনালের ভেতর থাকবে বাস কিংবা ট্রাক। অথচ রাজধানীর মহাখালী, সায়েদাবাদ, গাবতলী বাস টার্মিনালের আশপাশের রাস্তা সব সময়ই থাকে দূরপাল্লার যানবাহনের দখলে। টার্মিনালের ভেতর বাস রাখার পর্যাপ্ত জায়গা থাকার পরও অনেকে রাস্তা আটকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখেন। এতে দেখা দেয় যানজট। একই অবস্থা ট্রাক ও হালকা মালবাহী যানের টার্মিনালেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক নেতা বলেন, রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য পুলিশকে টাকা দিতে হয়। টার্মিনালের ভেতরে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকা এবং দ্রুত গাড়ি বের করতে অসুবিধার কারণে তারা রাস্তায় গাড়ি রাখেন।



তবে সরেজমিনে মহাখালীর আন্তঃবাস টার্মিনালে দেখা গেছে, টার্মিনালের ভেতরে অনেক ফাঁকা রয়েছে। অথচ গাড়ি রাখা হচ্ছে রাস্তায়। এর মধ্যে গাবতলীর অবস্থা এখন অনেকটাই ভালো। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিশেষ উদ্যোগের পর সড়কের ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ির সারি কমেছে অনেকটাই। ফলে স্বস্তি ফিরেছে এই সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে। আগের মতো দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে না তাদের। কিন্তু অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এই স্বস্তি কতদিন টেকে, সে নিয়েও সংশয়ে আছে এই পথ ধরে চলা মানুষের। কারণ, এ রকম উদ্যোগ তারা আগেও দেখেছে, দেখেছে আশার মৃত্যুও।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।