logo ২২ এপ্রিল ২০২৫
৪২ হাজার শিক্ষকের কষ্টের জীবন
রোগ-অনাহারেও মিলছে না অবসর-সুবিধার টাকা
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১১:৪৯:১০
image



ঢাকা: রাজধানীর গেন্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক সিরাজুল হক। অবসরে গেছেন ২০১২ সালে। ওই বছরই তিনি অবসরের টাকা পেতে আবেদন করেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে।






পাঁচ বছর পার হতে চলল, এখনো অবসর-সুবিধার টাকা পাননি তিনি। এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন সিরাজুল ইসলাম। দীর্ঘ চাকরিজীবনে তার প্রতি মাসের বেতন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কেটে তহবিলে জমা রাখা টাকা না পেয়ে এখন চিকিৎসাও হচ্ছে না মানুষ গড়ার এই কারিগরের।






সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিলে তাকে ২০১৬ সালের শেষ দিকে খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।






ঢাকার পলাশী এলাকায় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিরাজুল ইসলামের মতো প্রায় ৪২ হাজার শিক্ষক অবসর-সুবিধার অর্থের জন্য আবেদন করেও তা পাচ্ছেন না।






বৃহস্পতিবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, অবসর-সুবিধা নিতে ভোগান্তির শিকার শত শত শিক্ষকের ভিড়। তাদের কেউ কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা কিংবা মা। কেউ বয়সজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। শেষ বয়সে উপার্জন বন্ধ হওয়ায় এসব শিক্ষকের অনেকে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু অবসর ফান্ডের আর্থিক সুবিধা কবে পাবেন সে নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না।






গোপালগঞ্জের লোহাইল দারুল উলুম ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক সাহেবালী মৃধা অবসরে যান ২০১২ সালে। তিনি ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর অবসরের টাকা পেতে আবেদন করেন। কিন্তু পাঁচ বছরেও কোনো ইতিবাচকি আশ্বাস মিলছে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওলিউর রহমান ভুঁইয়া অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ২০১৩ সালে অবসরের টাকার জন্য আবেদন করেন। অসুস্থতা তীব্র হলেও অবসরের টাকা এখনো মেলেনি তার।






বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষকদের এই ভোগান্তির কারণ অপর‌্যাপ্ত তহবিল। যত সংখ্যক শিক্ষক আবেদন করেন, তাদের সুবিধা দেয়ার জন্য সেই পরিমাণ অর্থ নেই তহবিলে। ফলে আবেদনের পর শিক্ষকদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। অনেকে টাকার অপেক্ষায় থেকে থেকে মারাও গেছেন। এ সংকট মেটাতে হলে অন্তত পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা লাগবে।






অবসর বোর্ডে ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৪১ হাজার ৮০১টি আবেদন পড়েছে। এই আবেদন নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজন এক হাজার ৭৪৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। কিন্তু বোর্ডের কাছে কোনো টাকাই নেই।






এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ফান্ড সংকটের কারণে আমরা সব আবেদনকারীকে সন্তুষ্ট করতে পারছি না। এই বাস্তবতার কারণেই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে ভাতা পরিশোধ করে যাচ্ছি।’






এদিকে এই সংকটকে পুঁজি করে একটি চক্র গড়ে উঠেছে সেখানে। তারা জালিয়াতি করে সরকার ও শিক্ষকদের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চক্রের সদস্যরা শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থের আনুপাতিক হারে কমিশন বা উৎকোচ নিয়ে অর্থ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। তাদের খুশি না করলে কম সুবিধা দেয়া বা দিনের পর দিন ঘোরানোর অভিযোগও রয়েছে।






এ রকমই কয়েকটি ঘটনার কথা জানতে পেরেছেন এই প্রতিবেদক। অন্য এক ব্যক্তিকে রাজশাহীর মৃত শিক্ষক তাহাজউদ্দিনের ছেলে সাজিয়ে (হুমায়ূন কবির নামে) প্রায় ৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী চাকরির ১০ বছর পূর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও শেরপুরের মৃত শিক্ষক শাহানারার নামে আড়াই লাখ টাকা দেয়া হয়। টাঙ্গাইলের ৫২৩৯২ ডকেট নম্বরধারী এক শিক্ষক ৪ লাখ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও তাকে দেয়া হয় ৮ লাখের বেশি। রংপুরের ৪২৯২ ডকেট নম্বরের এক শিক্ষককে সাড়ে ১২ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। একই শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট থেকেও অতিরিক্ত টাকা তুলে নেন। এ ঘটনায় কল্যাণ ট্রাস্ট মামলা করেছে। এ রকম নানা অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ওই ফাইল গায়েব হয়ে যাওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।






এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অবসর সুবিধা বোর্ডের নতুন সদস্যসচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি সম্প্রতি এখানে যোগ দিয়েছি। আগে কী হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে এখানে যোগদানের পর থেকেই দেখছি অসহায় শিক্ষকদের চোখের পানি। তাদের চোখের জলে আমি ভাসছি। অনেক অসহায় শিক্ষক এখানে এসে কেঁদে চলে যান। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি। কিছু করতে পারছি না। কারণ অর্থ নেই।’






এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ শরীফ বলেন, ‘অবসর বোর্ডের বিরাজমান সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর দরদি নজর ভীষণ প্রয়োজন। একমাত্র তার সুদৃষ্টিই পারে এই সংকট সমাধান করতে।’






জানা গেছে, অবসর সুবিধা তহবিলে শিক্ষকদের এমপিও থেকে চার শতাংশ হারে অর্থ কাটা হয়। এই হিসাবে প্রতি মাসে জমা হয় গড়ে ১৭ কোটি টাকা। প্রতি মাসে অবসরে যাচ্ছেন গড়ে ৯৫০ জন শিক্ষক। তাদের প্রাপ্য মেটাতে মাসে লাগে অন্তত ৫৭ কোটি টাকা। এই হিসাবে মাসে ঘাটতি পড়ছে কমপক্ষে ৪০ কোটি টাকা।






অবসর বোর্ডের বিধান অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক সর্বশেষ যে পে স্কেলে থাকবেন, সেটার আলোকে সুবিধা পাবেন। অষ্টম পে স্কেলে বেতনভাতা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।






সে হিসাবে এখন যে টাকায় দুজন শিক্ষকের প্রাপ্য পরিশোধ করা যায়, নতুন পে স্কেলে সেই টাকায় একজনেরটা দেয়া যাবে।






এই হিসাবে ভবিষ্যতে আবেদন নিষ্পত্তির জট দ্বিগুণ হবে। সংকট রূপ নেবে মহাসংকটে। এ কারণে এখনই এই সংস্থার তহবিলে বাড়তি বরাদ্দ অথবা বিকল্পভাবে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন বোর্ডের সদস্যসচিব।






তিনি বলেন, চলমান সংকট মোকাবেলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এক হাজার কোটি টাকা চেয়ে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটি অনুমোদন হলে শিক্ষকদের কিছুটা স্বস্তি দেয়া যাবে।






সরকার এককালীন ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ২০০৪ সালে অবসর বোর্ড গঠন করে। বর্তমানে এ তহবিলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আছে।






(ঢাকাটাইমস/২৬ফেব্রুয়ারি/মোআ)