ঢাকা: দেশে দিন দিন শিশু হত্যা বাড়ছে। প্রতিদিন গড়ে একজন শিশু এই জঘন্য নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। আজ বুধবারও সিলেটে একই পরিবারের চার শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বার্থ ও শত্রুতা চরিতার্থ করার জন্য শিশুদের সহজ লক্ষবস্তু করছে বিকৃতমনা মানুষ। এ ছাড়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় শিশু হত্যার ঘটনা বাড়ছে।
গত ২৯ জানুয়ারি দুপুরের খাবারের পর নিখোঁজ হয় শিশু আব্দুল্লাহ। এর কায়েক দিন পর তার গলিত লাশ পাওয়া যায় প্রতিবেশী মোতাহার হোসেনের বাড়ির একটি ড্রামে।
জানা গেছে, জমিজমা ও ব্যবসাসংক্রান্ত লেনদেন নিয়ে আবদুল্লাহর নানা মারফত আলীর সঙ্গে শ্যালক মোতাহার হোসেনের বিরোধ ছিল। সম্পর্কের তিক্ততার একপর্যায়ে মোতাহার ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রতিশোধ নিতে মারফত আলীর মেয়ে রিনা বেগমের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে আবদুল্লাহকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
গত বছরের ২৬ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থেকে হাফসা আক্তার রূপা নামের পাঁচ বছরের এক শিশু নিখোঁজ হয়। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা শিশুটির পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর ওই দিন রাত দুইটার দিকে আড়াইহাজারের দুপ্তারা ইউনিয়নের গিরদা এলাকা থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এভাবে একর পর এক হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে শিশুরা।
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানমতে, গত জানুয়ারি মাসের ১ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছে ২৯ জন শিশু। এদের মধ্যে চারজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। নিখোঁজের পর পাওয়া গেছে ১০ জনের লাশ। স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে ৭ জন। আর বাকিদের কেউ অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের হাতে, কেউ সহপাঠীদের হাতে খুন হয়েছে। আবার নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে এক শিশু গৃহকর্মীর।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শিশু হত্যার হার ছিল ক্রমবর্ধমান। ২০১৫ সালে এই হার ২০১৪ সালের তুলনায় কিছুটা কমেছিল। কিন্তু চলতি বছরে প্রায় প্রতিদিনই শিশু হত্যার ঘটনা আগের সব হারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এক হাজার ৮৫ শিশু হত্যার শিকার হয়। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২০৯, ২০১৩ সালে ২১৮, ২০১৪ সালে ৩৬৬ ও ২০১৫ সালে ২৯২ শিশু খুন হয়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অপহরণের পর হত্যার শিকার হয় ১১১ শিশু।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, নিখোঁজ বা অপহরণের পর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে, মামলা হয়েছে। মুক্তিপণ চাওয়ার বিষয়টিও পুলিশকে জানানো হয়েছে। তারপরও ওই শিশুদের জীবিত উদ্ধার করা যায়নি।
দেশে শিশু হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। তাদের ভাষ্য, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় এই ধরনের ঘৃণ্য ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হচ্ছে। একজন নিষ্পাপ শিশুকে যারা হত্যা করতে পারে তারা সুস্থ মানুষ হতে পারে না। তারা হয় বিকারগ্রস্ত, না হয় মানসিক ভারসম্যহীন। তাদের আইনের আওতায় আনতে পারলে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড কমতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিশু হত্যার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা দেশে দিন দিন বেড়ে চলছে। এটা এক আতঙ্কজনক ব্যাপার। আমরা আফসোস করছি। কিন্তু প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা দেখছি না। ফলে বেপরোয়া মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি উৎকট হচ্ছে।
অধ্যাপক মাসুদা বলেন, “শিশুদের মধ্যে কোনো ক্ষতিকর মানসিকতা নেই। কিছু মানুষ নিজের হীনস্বার্থে শিশুদের হত্যা করছে। সরকার যদি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না নেয় তাহলে সেটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে, যা আমাদের উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
এ ধরনের হত্যাকাণ্ড থামাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভীষণ জরুরি উল্লেখ করে এই সমাজবিজ্ঞনী বলেন, “এটা যত দ্রুত করা যাবে ততই মঙ্গল। কারণ আমার সন্তানের ওপর এই আক্রমন আসবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে।”
কেন এই হত্যাকাণ্ড হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মাসুদা বলেন, “কারো প্রতি শত্রুতা বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ছোটদের বলি বানানো সহজ। ফলে বড়দের কিছু করতে না পেরে শিশুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। যারা এটা করে তারা মানসিক ভারসাম্যহীন, বিকৃতমস্তিষ্কের অধিকারী।”
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড়. জিয়া রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, জায়গা-জমি নিয়ে শত্রুতাসহ বিভিন্ন কিছুর জেরে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি, নৈতিকতার শিক্ষাসহ সর্বস্তরে জনমত গড়ে তুলতে হবে। তা ছাড়া কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজিপি এএসএম শাহজাহান ঢাকাটাইমসকে বলেন, “শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। যারা এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা মানুষ হতে পারে না। তারা নরপশু। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
(ঢাকাটাইমস/১৭ফেব্রুয়ারি/এমএম/মোআ)