ঢাকা: বাংলাদেশ রেলওয়েকে কেউ কেউ ‘জমিদার’ বলে আখ্যা দেন। কারণ সরকারি এই সংস্থাটির যে পরিমাণ জমি আছে, সরকারের অন্য কোনো সংস্থার তা নেই। এই জমির আবার একটি বড় অংশ শহর এলাকায়, যার বাণিজ্যিক মূল বিরাট। এসব জমি ব্যবহৃত হচ্ছে না, তা নয়, তবে এর কোনো আয় পাচ্ছে না রেল। দখল কিংবা নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে আখের গোছাচ্ছে প্রভাবশালীরা। তানিম আহমেদের ‘হায় রেল!’ শিরোনামের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে রেলের জমি আছে ৬১ হাজার ৮৬০ একর। এর মধ্যে সরকারি হিসাবে প্রায় সাড়ে চার হাজার একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। এসব জমিতে কোথাও মার্কেট, কোথাও বাজার আবার কোথাও বস্তি গড়ে তুলে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বারবার আলোচনায় এলেও এই জমি উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ কখনো নেওয়া যায়নি। কখনো কখনো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে বটে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তা আবার বেদখল হয়েছে।
রেলের এসব জমি দখলকারীদের মধ্যে প্রধানত আছেন রাজনৈতিক দলের নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করছেন রেলের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। আর একটি গোষ্ঠী, বিশেষ করে শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়ে দখলের সুযোগ করে দেন দখলদারদের।
খোদ দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকায় রেলের কয়েক লাখ কোটি টাকার সম্পদ আছে। এসব জমিতে বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি করার একটা প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। কিন্তু সেই উদ্যোগ ‘কথা বলা’র মধ্যেই শেষ হয়ে যায়, এগোয়নি এতটুকু।
রেলের জমি দখল ও উদ্ধারের বিষয়ে কথা হয়েছে জাতীয় সংসদেও। সাংসদদেও প্রশ্নের মুখে রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেছিলেন, “রেলের বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধার করা হবে। যারা এসব জমি দখল করে রেখেছে, সেই তালিকা হচ্ছে। যে করেই হোক এসব জমি উদ্ধার করা হবে।”
এমন আশ্বাস কেবল বর্তমান রেলমন্ত্রী নন, এই মন্ত্রণালয়ে তার আগের দুই মন্ত্রী বা আগেকার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরাও বারবারই দিয়ে গেছেন। কিন্তু কেউই তাদের আশ্বাস বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
এমনকি এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও। গত বছর মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে রেলের জমি উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন তিনি। পাশাপাশি রেলের কত জমি রয়েছে তার জন্য নতুন করে জরিপ করারও নির্দেশ দেন। কিন্তু সরকারপ্রধানের এই নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয়নি।
জমি থেকে আয়ের জন্য রেলে ইজারা প্রথা চালু আছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এই খাতে যতটা আয় হওয়ার কথা, হয় তার ভগ্নাংশ মাত্র। কারণ, যে টাকায় জমি ইজারা দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাণিজ্যিক জমি নামমাত্র মূল্যে ইজারা দেয়া হচ্ছে কৃষিজমি হিসেবে। আর তাতে ভূমিকা রাখছে রেলেরই লোকজন। রেলের স্বার্থের চেয়ে ইজারাদার আর নিজেদেও স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত থাকে তারা। ফলে শত শত কোটি টাকার ইজারামূল্য হারাচ্ছে রেল। সরকারি হিসাবে বর্তমানে রেলের ১৩ হাজার একরের বেশি জমি ইজারায় রয়েছে।
কেবল জমি নয়, হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে রেলের সাত হাজার ১৭২টি বাড়িও। এসব বাড়ির ‘নামমাত্র’ যে ভাড়া তা আদায় না হওয়া এবং বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ বাবদ পাঁচ বছরে সরকারের ১৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অথচ কবে ও কীভাবে বাড়িগুলো অবৈধ দখলে চলে গেছে সে বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই রেল কর্তৃপক্ষের কাছে। এসব বাড়িতে বছরের পর বছর বহিরাগত, অবাঙালি, রেলওয়ে পুলিশ, রেলওয়ে কর্মচারী, স্থানীয় থানার পুলিশ সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী এবং বেসরকারি কলেজের কর্মকর্তারা বসবাস করছেন।
বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে সংসদীয় কমিটিতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কোনো বাড়ি ১৯৭২ সাল থেকেই অবৈধ দখলে আছে। দখলদারদের উচ্ছেদে বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা নিলেও তা কার্যকর হয়নি। ফলে প্রতি বছরই নতুন নতুন বাড়ি অবৈধ দখলে গেছে।
ওই প্রতিবেদনে ২০০২ সালের আগস্ট থেকে ২০০৩ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের নিরীক্ষাতথ্য জানিয়ে বলা হয়, রেলের পূর্বাঞ্চলে দুই হাজার ৯২০টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে চার হাজার ২৫২টি বাড়ি অবৈধ দখলে আছে। প্রতিটি বাড়ির ভাড়া ন্যূনতম মাসিক ২০০ টাকা হিসাবে আট কোটি ৬০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা এবং বিদ্যুৎ বিল বাবদ ১০০ টাকা হিসাবে চার কোটি ৩০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান হিসাবে এই লোকসান কয়েক গুণ বেশি।
রেলের অডিট অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রেলের জমি অবৈধ দখলে থাকা, নির্ধারিত হারের চেয়ে লাইসেন্স ফি কম করে জমি ইজারা, নামমাত্র টোকেন ফি দিয়ে বাণিজ্যিক জমি দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া, জমির মূল্য আদায় না করা, প্রতিষ্ঠানের আয়তন কম দেখিয়ে মূল্য আদায়, পরিত্যক্ত ঘোষিত সেকশনের ফি আদায় বন্ধ রাখায় বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জমি বিক্রির ক্ষেত্রে অনিয়মের কারণে রেলের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া ১৯৯০-৯১ থেকে ২০০২-০৩ অর্থবছর পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলে ১৯১ একর ও পশ্চিমাঞ্চলে ৯৯১ একর জমি বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে দরপত্র ছাড়া পূর্বাঞ্চলে ১৮২ একর ও পশ্চিমাঞ্চলে ৯৮৬ একর জমি বিক্রি করা হয়। এক যুগ আগের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নামমাত্র ফিতে রেলের জমি দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়ায় প্রায় ১০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় এই ক্ষতি ১০০ গুণের বেশি বলে মনে করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
বছরের পর বছর পতিত পড়ে আছে রেলের জমি। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বর্তমানে রেলের দখলে থাকা অব্যবহৃত জমি ১৩ হাজার ১০৭ একর। এর মধ্যে কৃষিজমি ১০ হাজার ৭১৬ একর। এসব দখলে থাকা জমির বেশির ভাগই অর্থনৈতিক আয়ের বড় রকমের উৎস হতে পারে, যা রেলের উন্নয়ন ও ভর্তুকি হিসেবে কাজে লাগানো যায়। অথচ ‘সম্পদশালী’ রেল চলে লোকসান দিয়ে। একে জমিদারের শূন্য থালা ছাড়া আর কী বলা যায়।
(ঢাকাটাইমস/১১ফেব্রুয়ারি/মোআ)