logo ২২ এপ্রিল ২০২৫
হায় রেল-৪
সংকট আর লাইনচ্যুতি চলছে হাত ধরাধরি করে
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০৮:৩৯:৪৪
image



ঢাকা: ‘...এলাকায় ট্রেন লাইনচ্যুত... ট্রেন চলাচল বন্ধ’- টেলিভিশনের স্ক্রলে এমন ব্রেকিং নিউজ ছুটে চলে প্রায়ই। কখনো কখনো একই দিন দুবার বা তার চেয়ে বেশি ট্রেন লাইনচ্যুতির খবর আসে। এর জন্য দায়ী করা হয় জরাজীর্ণ রেললাইন, পুরনো ইঞ্জিন আর বগির কথা। এ রকম নানা সংকটে ভারাক্রান্ত রেলওয়ে। তানিম আহমেদের ‘হায় রেল!’ শিরোনামে ধারাবাহিকের আজ চতুর্থ কিস্তি।






সম্প্রতি রেলপথের ওপর একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।  তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, রেল দুর্ঘটনার ৬৩ ভাগই লাইনচ্যুতি এবং ১৭ ভাগ লেভেল ক্রসিংজনিত। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেল কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, গাফিলতি, অবহেলা ও উদাসীনতা; রেললাইনে সার্বক্ষণিক তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব; চালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মীদের অসতর্কতায় এসব দুর্ঘটনা হচ্ছে।






বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনবলের অভাব, রেললাইন নিয়মিত মেরামত না করা, ইঞ্জিন ও বগি যথাযথভাবে মেরামত না করা, মেরামত কারখানায় দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব এবং রেল কর্মকর্তাদের গাফিলতি ট্রেন লাইনচ্যুতির কারণ।






বুয়েটের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান বলেন, পুরনো ট্রেনলাইনের কারণেই লাইনচ্যুত হচ্ছে। যদি লক্ষ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, রেল যতগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছে তার বেশির ভাগই হলো পুনর্বাসন প্রকল্প। দীর্ঘ সময় লাইন মেরামত না করার কারণে লাইন ঠিক থাকছে না, রিবন্ডিং খুলে যায়, স্লিপার ঢিলা হয়ে যায়, চাকাও ক্ষয় হয়। এ কারণে রেললাইনে সমস্যা দেখা দেয়, যার ফল ‘লাইনচ্যুতি।  রেলে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার ৮০ শতাংশ লাইনচ্যুতি।






তবে মাত্রাতিরিক্ত হারে ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে এমন তথ্য মানতে নারাজ রেলের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, অতীতের তুলনায় এখন ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনা কমেছে। রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) হাবিবুর রহমান বলেন, “ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনা এখন নেই বললেই চলে। গত ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে তিন থেকে চারটা লাইচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। যেটা উন্নত দেশেও ঘটে।”






রেলে লাইনচ্যুতি কিংবা ধীরগতির সংকটের আর একটি কারণ পুরনো ইঞ্জিন। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশ রেল প্রতিষ্ঠার পর ট্রেন চলত কয়লার ইঞ্জিনে। পঞ্চাশের দশকে কয়েকটি ডিজেলচালিত ইঞ্জিন রেলে চালু করা হয়।  এর পাশাপাশি অবশ্য কয়লার ইঞ্জিনও চালু থাকে। পরে হাঙ্গেরিতে নির্মিত কয়েকটি আধুনিক ইঞ্জিন আনা হয় এই লাইনে।  এসব ইঞ্জিনের আয়ু অনেক আগেই শেষ হয়েছে।  কোনো কোনো ইঞ্জিনের মেয়াদ শেষ হলেও সেগুলো চালানো হচ্ছে এখনো। এগুলোতে অতিরিক্ত তেল খরচ হয়। ফলে এসব ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানোর পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যায়। আবার পুরনো ইঞ্জিন ঘন ঘন মেরামত করতে হয়, বেশির ভাগ সময় লোকোশেডে (রেলওয়ে কারখানা) পড়ে থাকে। ফলে খরচ ও  ইঞ্জিন সংকট বাড়ে।






বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি রেল ইঞ্জিন লাভজনকভাবে সাধারণত ২০ বছর পর্যন্ত চালানো যায়। এই হিসাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ইঞ্জিনের  মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।






রেলের পূর্বাঞ্চল সূত্রে জানা গেছে, সিলেট-ঢাকা, সিলেট-চট্টগ্রাম, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-জামালপুরসহ বিভিন্ন লাইনে চলাচলকারী আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেনের জন্য প্রতিদিন ১১১টি ইঞ্জিন দরকার। কিন্তু ইঞ্জিন আছে ১৫৪টি।  এর মধ্যে ৫৯টির মেয়াদ রয়েছে। বাকিগুলোর অর্থনৈতিক আয়ু ফুরিয়েছে আগেই। এর মধ্যে ৪৬টি ইঞ্জিনের বয়স ৫০ বছরের বেশি যা রেলের বহরে যোগ হয়েছে ১৯৫৩ সালের দিকে।






রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ বলেন, “আমাদের নিয়মিত প্রয়োজন ১১১টি ইঞ্জিনের। কিন্তু সচল পাওয়া যায় গড়ে ১০৫টি।’






রেলের পশ্চিমাঞ্চলের পাকশি বিভাগে মোট ইঞ্জিন ৯৬টি, যার মধ্যে ৩২টির মেয়াদ ফুরিয়েছে আগেই। এসব ইঞ্জিনের মধ্যে জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হয়েছে ৭৬টি। কিন্তু দরকার অন্তত ৮০টি। পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট বিভাগে ইঞ্জিন রয়েছে ৩২টি। প্রয়োজন ২৭টি কিন্তু সচল ২৫টি। এর মধ্যে অর্ধেকের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। রেল সূত্রে জানা গেছে, ব্রডগেজের জন্য সম্প্রতি ২৬টি নতুন ইঞ্জিন সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে মিটারগেজে ইঞ্জিনের স্বল্পতা রয়েছে। শিগগিরই আরও ১০টি ইঞ্জিন রেলের বহরে যোগ হবে বলে জানিয়েছে সূত্র।






এদিকে নীলফামারীর সৈয়দপুরে রেল কারখানায় অবসরজনিত কারণে দক্ষ জনবল দিন দিন কমে যাওয়ায় পুরনো ইঞ্জিনগুলো মেরামতও করা যাচ্ছে না। ফলে এ ক্ষেত্রে সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে মেয়াদ শেষ হওয়া জরাজীর্ণ এসব ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানোর ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সময়মতো চলতে পারছে না ট্রেনগুলো। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের।






রেলওয়েতে এসব সংকটের সঙ্গে আসে অর্থের সংকটের বিষয়টি। যদিও সংকট সমাধানে ও যাত্রীসেবার মান বাড়াতে বছর তিনেক আগে দাপ্তরিক হিসাবে ৫০ শতাংশ (আসলে দ্বিগুণ) ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু সংকট সমাধান হয়নি। প্রকৃত অর্থে রেলের সংকট এমন প্রবল যে, সব পরিকল্পনা আর অর্থ ব্যয় হয় পুনর্বাসনের খাতে। ফলে সংকট আর লাইনচ্যুতি যেন হাত ধরাধরি করে চলে।     






জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (যান্ত্রিক) মতিন চৌধুরী বলেন, “আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। টাকা পাওয়া গেলে নতুন ইঞ্জিন কেনা হবে। বৈদেশিক ঋণে ৭০ ইঞ্জিন কিনতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।”






(ঢাকাটাইমস/১৫ ফেব্রুয়ারি/মোআ)