ঢাকা: সময় মেনে চলে না বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন। এটাই সাধারণ চিত্র। বছরের পর বছর চলছে এই ধারা। আবার বিশ্বে যখন গতি নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা, তখন বাংলাদেশে ট্রেনের গতি ধীর। এই মন্ত্রণালয়ে যিনি দায়িত্ব নিয়ে আসেন, কিংবা রেল বিভাগের কর্মকর্তারা বরাবরই আশ্বাস দেন, শিগরিই সময়মতো চলবে ট্রেন, কিন্তু তা আর বাস্তবায়ন হয় না। বরং নানা ঘটনা আর দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত হয় ট্রেনের সময়সূচি। দীর্ঘ হয় গন্তব্যে পৌঁছানোর সময়। নিজস্ব প্রতিবেদক তানিম আহমেদের ‘হায় ট্রেন!’ ধারাবাহিকের এটি তৃতীয় কিস্তি।
ট্রেনের বিলম্ব কিংবা ধীরগতি নিয়ে রীতিমতো কৌতুক তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। কেউ দেরি করলে টানা হয় ট্রেনের উদাহরণ। কৌতুকপ্রবণ বন্ধুদের মধ্যে কারো কারো ক্ষেত্রে আবার ট্রেনের নামে সম্বোধনের চলও আছে।
চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে। কিন্তু সেদিন সেটি ছাড়ে আধা ঘণ্টা পর সকাল ৮টা ১০ মিনিটে। বেলা সাড়ে ১১টার সময় মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়ে জানা গেছে, ট্রেনটি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৫২ মিনিট পিছিয়ে আছে। ২১ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ থেকে আসা ঢাকাগামী কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি এক ঘণ্টা ৫২ মিনিট পর্যন্ত বিলম্বে চলেছে। কিশোরগঞ্জের স্টেশন মাস্টার জানান, এই ট্রেনটি প্রতিদিনই এই রকম দেরিতে চলে। নিয়মিত চলে এমন যাত্রীরাও বিষয়টি জানেন।
স্টেশনে অপেক্ষা করার সময় একটি কিশোর সাইকেলে করে এসে স্টেশন মাস্টারকে বললেন, “আঙ্কেল, ট্রেন কতক্ষণ লেট করবে?’ দেড় ঘণ্টার বেশি, জানার পর ওই কিশোর আবার বাসার পথ ধরল। জানাল, তার স্বজন ট্রেনে করে ঢাকায় যাবে। স্টেশনের কাছেই বাড়ি, দেরি হবে সেটা জানেন ওই যাত্রী। কখন বাসা থেকে বের হলে ভালো হয়, তা জানতেই কিশোরকে এভাবে স্টেশনে পাঠানো।
নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করেন এমন একজন যাত্রী বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে আন্তঃনগর ট্রেনে সময় লাগে সাত থেকে আট ঘণ্টা। কখনো কখনো ১০ ঘণ্টাও লেগে যায়। এ কারণে যাদের জরুরি কাজ থাকে তাদের পক্ষে ট্রেনে চলাচল করা কঠিন। এই চিত্র প্রতিদিনের।
লাখো যাত্রীর দেড়-দুই ঘণ্টার বাড়তি সময়ের আর্থিক মূল্য কত সেই হিসাব কষবে কে? রেলওয়ে দাবি করছে, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে দিনে দিনে। বাস্তবে তার কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না।
অথচ আশি ও নব্বইয়ের দশকেও ঢাকা-চট্টগ্রামে যাতায়াতে খরচ হতো পাঁচ-ছয় ঘণ্টা।
রেলের এক কর্মকর্তা বলেন, “একসময় আমাদের দেশের ট্রেন চলাচলের কোনো সময়সীমা ছিল না। এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো ট্রেনকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে চালানোর। সে জন্য আমরা কাজ করছি। অনেক জায়গায় পুরনো লাইন মেরামত করা হচ্ছে। রেলওয়ের যে কোচ আছে, সেগুলোও অনেক পুরনো। গত কয়েক বছরে আমাদের বহরে কিছু নতুন কোচ যোগ হয়েছে। আগামীতে আরও আসবে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বেশির ভাগ ডাবল লাইন হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড শেষ হলে রেলে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।”
ট্রেনে সময় বিপর্যয় হয়, এমন বিষয়টি মানতে নারাজ রেলের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, “কয়েক দিন আগে আমরা আমাদের সব ট্রেনের সময়সীমা কমিয়ে এনেছি। আগামী সাত দিনের মধ্যে সুবর্ণ এক্সপ্রেস সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছবে। অনুরূপভাবে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছাবে। এখন তা ছয় ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় লাগে। এর আগে ছিল ছয় ঘন্টা ৪০ মিনিট।” গত কয়েক দিনে ৯০ শতাংশ ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে চলেছে বলেও দাবি আমজাদ হোসেনের।
শম্ভুক গতির ট্রেন
আধুনিক জীবনে প্রযুক্তির অনেক সুবিধাই ভোগ করছে উন্নয়নশীল বাংলাদেশের নাগরিকরা। দুই দশক আগেও নতুন কোনো প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর বাংলাদেশে আসতে সময় লাগত দীর্ঘদিন। কিন্তু এখন আর সে সময় নেই। উদ্ভাবনের পর সংক্ষিপ্ততম সময়ে সুবিধা ভোগ করে বাংলাদেশের মানুষও। তবে এই দিক থেকে এক ব্যতিক্রমী নাম রেল। দুনিয়াতে ট্রেনের গতি যখন বিমানের গতির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে, যখন ডিজেলচালিত ট্রেন বিদ্যুৎ বা অন্য জ্বালানি দিয়ে চালিয়ে গতির রেকর্ড করছে তখন বাংলাদেশে ট্রেন চলে হেলেদুলে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ট্রেনের গতিই সবচেয়ে কম।
নব্বইয়ের দশকে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে চালু হওয়া বিরতিহীন ট্রেন সুবর্ণ এক্সপ্রেসের যাতায়াতের সময় ছিল পাঁচ ঘণ্টা। কিন্তু দুই দশকে সেটা বাড়তে বাড়তে সাত ঘণ্টায় পৌঁছে। সেটাও নির্ধারিত সময়ের হিসাব। দেশের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় যে ট্রেনে, সেটিও চলতে পারে না নির্ধারিত সময়ে। পৃথিবীতে ট্রেন যখন দিনে দিনে দ্রুততর হচ্ছে তখন বাংলাদেশে কেন উল্টো চিত্র?
রেল সূত্র জানায়, দেশে ব্রডগেজে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারিত করা আছে ঘণ্টায় ৯৫ কিলোমিটার। আর মিটারগেজে ৭২ কিলোমিটার। কিন্তু এই সর্বোচ্চ গতিতে ট্রেন চালানোর উদাহরণ নেই বললেই চলে। কিন্তু ব্রডগেজে ট্রেন চালানো হয় বড়জোর ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার ও মিটারগেজে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার গতিতে।
রেল কর্তৃপক্ষ এর বহুবিধ কারণ দেখান। বেশির ভাগ ইঞ্জিন আর কোচের অবস্থা ভালো নয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এগুলো চালাতে হচ্ছে। অবস্থা ভালো নয় লাইনেরও। এ কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতেই সর্বোচ্চ গতিতে ট্রেন চালানো হয় না।
আবার সব এলাকায় দুটি লাইন না থাকায় প্রায়ই বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রেনের জন্য জায়গা করে দিতে একটি ট্রেনকে কোনো স্টেশনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করিয়ে রাখতে হয়। একে বলে ক্রসিং। একবার কোনো ট্রেন অন্য ট্রেনকে ক্রসিং দিলে পরে আবারও তাকে একইভাবে ফেলে রাখা হয়। কারণ কোনো একটি ট্রেন দেরি করলে সেটিকে দেরিতে চালানোর রীতি আছে রেলে। তাহলে দ্রুতগামী ইঞ্জিন, উন্নত মানের বগি আর ভালো লাইন কবে হবে? ডিজেলচালিত ট্রেনের জায়গায় ইলেকট্রিক ট্রেন কি আদৌ হবে না? সরকার কেবল আশ্বাসের কথা বলে যাচ্ছে।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের মধ্যে স্বল্পতম সময়ে ইলেকট্রিক ট্রেন চালুর আশ্বাস দিয়েছিল। সে সময়ের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এত স্বল্প সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নকে অবাস্তব পরিকল্পনা বলেছিলেন। তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা দুই বছরের মধ্যে এম সাইফুর রহমানকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ইলেকট্রিক ট্রেনে করে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে চ্যালেঞ্জ রাখতে পারেননি তিনি।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার আর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে দুই বছরেও ট্রেনের গতি বাড়েনি। মাঝে রেলের উন্নয়নে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ভেঙে আলাদা রেলপথ মন্ত্রণালয় করা হয়েছে। তবু কাজে আসেনি উদ্যোগ। এখনো সরকার আশ্বাসের কথাই বলে যাচ্ছে। গাজীপুর, নরসিংদী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বদলে নারায়ণগঞ্জের ওপর দিয়ে কুমিল্লা হয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নতুন লাইন স্থাপন করে দ্রুতগামী ট্রেন চালুর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। এই লাইন চালু হলে দেড় ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে সরকার। তবে এই পরিকল্পনায় এখনো সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি। লাইনটি অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভজনক হবে তা জানতে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কেবল সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের চুক্তি হয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের পুরোটাতেই ডাবল লাইন করার কাজ চলছে। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে ভৈরব পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রামের মিরসরাই চিনকী আস্তানা থেকে কুমিল্লার লাকসাম পর্যন্ত ৬১ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ তিন বছরের মধ্যেই শেষ হবে। আর এই কাজ শেষ হলেই সর্বোচ্চ গতিতে ট্রেন চালানোর আশ্বাস দিয়েছেন রেল সচিব ফিরোজ সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, “সব কাজ শেষ হলে ট্রেনের ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহনের সময় অনেক কমে আসবে।”
ইঞ্জিন আর কোচের স্বল্পতারও সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন রেল সচিব। তিনি জানান, চলতি বছর ভারত থেকে ১২০টি এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে ১৫০টি নতুন কোচ আসবে। যোগ হবে নতুন ১০টি ইঞ্জিনও। এগুলো যুক্ত হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে এই ইঞ্জিন আর বগি আমদানি এক সময়সাপেক্ষ বিষয়। কারণ ইঞ্জিনের অর্ডার দিলে তা বানাতেই বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যায়। কারণ একেক দেশের রেলের ব্যবস্থা একেক রকমের। আর সে ক্ষেত্রে ইঞ্জিনের বেশির ভাগ যন্ত্রাংশই নতুন করে বানাতে অথবা সংযোজন করতে হয়। তাই কোথাও তৈরি করে রাখা ইঞ্জিন থাকে না বলে কার্যাদেশ দেওয়ার তিন থেকে পাঁচ বছর, কখনো কখনো তার চেয়ে বেশি সময় পরে ইঞ্জিন আসে দেশে।
রেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খারাপ লাইন আর ইঞ্জিন সংকটের পাশাপাশি ধীরগতিতে ট্রেন চালানোর পেছনে আছে আরও একটি কারণ। লোকবল সংকট আর লোকসানের কারণে সারা দেশে ১৬৪টি স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অনেক রেলপথের ওপর দিয়ে অনেক লেভেল ক্রসিং তৈরি হয়েছে। বন্ধ স্টেশন খুলে সেখানে স্টেশন মাস্টার নিয়োগ ও লেভেল ক্রসিংয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আগে রেলের গতি বৃদ্ধি সম্ভব হবে না। এসব সমস্যা সমাধান হলে ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলা সম্ভব বলে মনে করছেন রেলের কর্মকর্তারা।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান ঢাকাটাইমসকে বলেন, পুরনো লাইন ও পুরনো কোচের কারণেই ট্রেনের গতিসীমা কমে গেছে। তবে লাইন মেরামত ও নতুন কোচ আনয়নের যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন হলেই গতিসীমা বাড়বে।
সীমাবদ্ধতা হোক আর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কিংবা ঘটনা-দুর্ঘটনা, বহুকাল থেকেই ট্রেন সময়সূচি মেনে চলতে পারছে না, এটাই বাস্তবতা। আশ্বাসে আশ্বাসে বেলা (পড়ুন দিন) কম গেল না, দেশে দেশে শব্দের গতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ট্রেন চলে, কিন্তু বাংলাদেশের রেলওয়ে এখনো বেরোতে পারেনি ‘নয়টার ট্রেন কয়টায় চলে’ বৃত্ত থেকে!
(ঢাকাটাইমস/১৪ ফেব্রুয়ারি/টিএ/মোআ/ ঘ.)