ঢাকা: দরিদ্র থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথ পেরিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতিও কম নয়। কিন্তু উন্নতি নেই কেবল বাংলাদেশ রেলওয়ের; বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে এই সরকারি সংস্থাটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেলের যে অবকাঠামো ও সম্পদ রয়েছে তার যথাযথ ও পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে সহজেই দুর্দশা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের সেদিকে নজর খুব কম। তানিম আহমেদের ‘হায় রেল!’ ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পঞ্চম কিস্তি।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বরাবর বলে আসছেন, রেলওয়েকে লাভজনক করতে হলে বিদ্যমান পরিবহনসেবা বাড়ানোর পাশাপাশি আয়ের নতুন নতুন পথ খুঁজতে হবে। কিন্তু গত এক দশকে রেল তার পরিবহণসেবার পরিধি বরং সংকুচিত করেছে। এর মধ্যে পণ্য পরিবহণ সেবা অন্যতম। অথচ এই খাতে রেলের আয় সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি রেলের আয় গড়ে ৫৬ পয়সা, আর ব্যয় ১ টাকা ৫২ পয়সা। আর পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ২২ পয়সার বিপরীতে আয় দুই টাকার বেশি। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে কনটেইনারবাহী একটি ট্রেন চালালে আয় হয় কমপক্ষে ছয় লাখ টাকা। যাত্রীবাহী সবচেয়ে অগ্রাধিকার ট্রেন সুবর্ণ এক্সপ্রেসে একবারে আয় কখনো দেড় লাখ টাকার বেশি হয় না। লাভজনক হলেও পণ্য পরিবহনে রেল সক্ষমতা বাড়ানোর বদলে উল্টো কমাচ্ছে। এই উল্টোযাত্রায় দিনে দিনে লোকসান বাড়ছে।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেলপথে পণ্য পরিবহন হয়েছে ৩০ লাখ ১০ হাজার টন। ছয় বছর পর তা কমে দাঁড়ায় ২১ লাখ ৩৫ হাজার টনে। গত ছয় বছরে রেলপথে পণ্য পরিবহন কমেছে ২৯ শতাংশের বেশি। রেলের কর্মকর্তারা বলেন, কয়েক বছর ধরে যাত্রী ও জ্বালানি তেল পরিবহনকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় কমেছে রেলের পণ্য পরিবহন।
রেলে পণ্য পরিবহন কমার পেছনে অবশ্য বলা হচ্ছে পুরনো ইঞ্জিন ব্যবহারের কথাও। পথে ইঞ্জিন ঘন ঘন বিকল হয় বলে চাহিদা বাড়লেও দিনে আটটির বেশি পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা করা হয় না। ফলে পণ্যবাহী কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে থাকে। তাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা। তাই বেশি খরচ করে সড়কপথে পণ্য আনতে বাধ্য হন তারা। অবশ্য অতিরিক্ত পরিবহনের এই দায় শেষতক ভোক্তাকেই বইতে হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলসচিব ফিরোজ সালাহউদ্দিন পণ্য পরিবহনকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে জানান। তিনি বলেন, “আগের তুলনায় আমাদের পণ্য পরিবহন অনেক বেশি হচ্ছে। আগামীতে খাদ্য পরিবহনেরও ব্যবস্থা করা হবে। যদি পণ্য পরিবহন না করা হয় আমরা ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি করেও লোকসান কমাতে পারব না। এ জন্য পণ্য পরিবহনের জন্য একটি স্বতন্ত্র কোম্পানি গঠন করা হবে, যা শুধু পণ্য পরিবহন দেখাশোনা করবে।”
রেলসচিব আরও বলেন, “এখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পণ্য আনতে একটু সময় লাগে; কিন্তু ডাবল লাইন হয়ে গেলে এ সমস্যা থাকবে না। এ ছাড়াও কোম্পানি হলে মেইল ট্রেনের সঙ্গে ওয়াগন যুক্ত করারও ব্যবস্থা করা হবে।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান বলেন, “ট্রেনের উন্নয়ন কখনো পরিকল্পনামাফিক হয়নি। এ কারণেই পণ্যবাহী ওয়াগন দিন দিন কমছে। তাই বিপুল লোকসানের বোঝা চাপছে জনগণের ঘাড়ে।” এই বিশেষজ্ঞ বলেন, যাত্রী পরিবহনে সারা দুনিয়াতেই ভর্তুকি দিতে হয়। আর মাল পরিবহনে তা পুষিয়ে লাভ করে ট্রেন। বাংলাদেশ রেলওয়েকে লাভজনক করতে পণ্য পরিবহনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিকল্প নেই।
রেলওয়ের সূত্র জানায়, যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রেও রেলওয়ের আয়ের ক্ষেত্রে আছে বৈষম্য। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচ বা প্রথম শ্রেণির কোচ থেকে যে পরিমাণ আয় হয়, তার চেয়ে বেশি আয় হয় শোভন শ্রেণি থেকে। রেলের কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা-রাজশাহী রুটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্লিপিং কেবিনে একটি বগিতে বিক্রি হয় ২৩টি টিকিট। প্রতিটি টিকিটের দাম এক হাজার ৮১ টাকা হিসাবে এই বগি থেকে রেলের আয় হয় ২৫ হাজার টাকার কম। ব্রডগেজ এই ট্রেনগুলোর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ারকোচে ৮০টি আসন থেকে রেলের আয় হয় (প্রতি আসন ৬০৬ টাকা) ৪৮ হাজার টাকার বেশি। অর্থাৎ স্লিপিং কেবিনের প্রায় দ্বিগুণ। আর সাধারণ কোচে আসন থাকে ১২০টি। প্রতি আসনের ভাড়া ৩১৫ টাকা হিসেবে রেলের আয় হয় ৩৭ হাজার ৮০০ টাকা। এসব বগির প্রতিটিতে গড়ে ৩০ জন দাঁড়িয়ে যাওয়ার যাত্রী থাকলে আয় বেড়ে হয় ৪৭ হাজার টাকার বেশি।
শোভন শ্রেণির চেয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচ বা প্রথম শ্রেণির কোচের পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। এই ব্যয় বাদ দিলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচ বা প্রথম শ্রেণির কোচের আয় আরও কম দাঁড়ায়। অথচ এই তিন শ্রেণিতে ভাড়া বাড়ানো কিংবা নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিসাব করা একই অনুপাতে।
জানতে চাইলে রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালনা) হাবিবুর রহমান বলেন, “আন্তঃনগর ট্রেনে আসনের বাইরে টিকিট দেওয়ার কোনো বিধান নেই। কিন্তু তারপরও যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে আমরা স্ট্যান্ডিং টিকিট দিচ্ছি। কিন্তু এসি কোচের যাত্রীরা তো আর আসন ছাড়া টিকিট কাটবে না। তাই আয়ের ক্ষেত্রে এই চিত্রটা চোখে পড়ে।”
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান বলেন, “বিলাসবহুল কোচ থেকে বাড়তি আয় করতে পারে রেলওয়ে। এ জন্য প্রয়োজনে বিলাসবহুল কোচের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেলের আয়ের আর একটি পথ হতে পারে কমিউটার ট্রেন। রাজধানীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চাকুরে ও ব্যবসায়ী ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে এসে কাজ সেরে আবার বাড়ি ফিরে যেতে পারে যদি সঠিক পরিকল্পনায় কমিউটার ট্রেন চালু করা হয়। এতে কম পরিচালন ব্যয়ে বেশি আয় করতে পারে রেল। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ আর নরসিংদীর পথে কয়েকটি কমিউটার ট্রেন চলে বটে, তবে তা চাহিদার তুলনায় কম। উপচেপড়া যাত্রী নিয়ে চলে ট্রেনগুলো। ঢাকা লাগোয়া মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জে কোনো রেললাইন নেই। এদিকে প্রচুর যাত্রী সড়ক ও নদীপথে রাজধানীতে যাতায়াত করে। এসব জেলার সঙ্গে নতুন রেললাইন স্থাপন করতে পারে।
রেলের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনের দাবি, ঢাকার আশপাশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রী ট্রেনে করে আসে। তিনি বলেন, “ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ৩৬টি ট্রেন চলাচল করে। ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে মাসিক টিকিটধারী যাত্রীর সংখ্যা ৭০ হাজার। তুরাগ ট্রেন নির্ধারিত সময়েই চলাচল করছে যাতে করে অফিসগামী যাত্রীদের সুবিধা হচ্ছে। গত ৫ বছরে ৯৩টি নতুন ট্রেন চালু করেছি।”
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান বলেন, “আমাদের পাশের দেশ ভারতের মুম্বাই ও কলকাতা শহরে যাত্রীদের প্রধান ভরসা কমিউটার ট্রেন। এসব ট্রেনে করে অফিসযাত্রী ও ব্যবসায়রিা শহরে আসে, আবার শহর থেকে উপশহরে ফিরে যায়। আমাদের ঢাকায় নারায়ণগঞ্জ ও জয়দেবপুর রুটে চালু আছে এ ধরনের ট্রেন। তবে সেটি শুধু এই দুই জায়গায় হলে হবে না, এখন ঢাকার আশপাশের জেলায় কমিউটার সার্ভিস বাড়াতে হবে।”
(ঢাকাটাইমস/১৬ফেব্রুয়ারি/মোআ)