logo ২২ এপ্রিল ২০২৫
চা-বিস্কুট বিক্রি করে ছাত্রলীগ নেতার পড়ালেখা
রফিকুল ইসলাম রফিক, ঢাকাটাইমস
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১৯:৩০:৫৩
image




রংপুর: ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একটি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা তিনি। ছাত্রলীগের হাজারো কর্মীর বিরুদ্ধে যখন উঠছে একের পর এক ক্ষমতা অপব্যবহার আর অপকর্মের অভিযোগ, তখন উল্টো স্রোতে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোলায়মান হাসান খান। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির বদলে তিনি চা-বিস্কুট বিক্রি করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালান।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের গেটে ক্ষুদ্র ব্যবসা তার।







বর্তমান ছাত্ররাজনীতির ‘প্রথাগত ধারা’য় অর্থ উপার্জনের দিকে না গিয়ে এই উল্টো স্রোতে কেন? সোলায়মান বলেন আদর্শের কথা,  বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা। সৎ থেকে রাজনীতি করার কথা।







সোলায়মান এমনও স্বপ্ন দেখেন,  বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে আওয়ামী লীগের ডোনার হবেন একদিন।







ছাত্ররাজনীতিতে পা রাখার প্রেরণার কথা বলতে গিয়ে সোলায়মান হাসান খান বলেন, “তখন রংপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি।  একদিন স্কুলের টিফিন বিরতিতে স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। অদূরে মাইকে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ভেসে আসে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’... বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য আমার হৃদয় স্পর্শ করে। আমি বন্ধুদের আড্ডার মধ্যেই নীরবে শুনতে থাকি সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।”






তার চা-বিস্কুটের দোকানে বসেই কথা হচ্ছিল সোলায়মানের সঙ্গে।






তখনো রাজনীতির ভালোমন্দ বুঝতেন না জানিয়ে সোলায়মান হাসান বলেন, “তবে বঙ্গবন্ধুই যে বাংলাদেশের স্থপতি, এ কথা বুঝতে কষ্ট হয়নি। যতই দিন যায়, আগ্রহ বাড়তে থাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি।  মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিজের মধ্যে লালন করব।  পরে যোগ দিই বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। ”






তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় সোলেমান। রংপুরে একমি (ওষুধ) কোম্পানির রিপ্রেজেন্টিটিভ বাবা ছামছুদ্দিন খান ২০১০ সালে চাকরি থেকে অবসরে যান। সেই বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হন সোলায়মান হাসান।






টানাপোড়েনে সংসার।  পাঁচ ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ জোগোতে চরম কষ্ট হয় বাবার।






নেত্রকোনার দক্ষিণ সাত পাই এলাকায় গ্রামের বাড়ির ভাড়া থেকে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়। সেই টাকা দিয়েই চলে বাড়ির খরচ, ছোটদের পড়ালেখা। বাবা-মা পড়ালেখার খরচ জোগান দিতে না পারায় পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়ে পড়ত জানিয়ে সোলায়মান বলেন, “কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী হয়ে না পারি অসৎ পথে যেতে, না পারি পড়ালেখা বন্ধ করতে। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী হয়ে অন্যায় ও অসৎ পথে যাব না। তাই যাইনি কখনো।”






এই ছাত্রনেতা বলেন, “ছাত্রলীগের নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবনসহ অনেক বদনাম আছে। আমি ওই বদনামে যেতে চাইনি, চাই না। সবাই যদি বদনাম করে তাহলে নতুন প্রজন্ম কাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে। তাই আমি বহু চিন্তা করেই এই ব্যবসা শুরু করি।






“ব্যবসার শুরু থেকেই ক্যাম্পাসের শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, ছোট ভাই-বোনরা, রাজনৈতিক সহকর্মীরা প্রায় সবাই আমার এ ব্যবসা মেনে নেয়। তবে এখনো আমার অনেক রাজনৈতিক সহকর্মী  এটা পছন্দ করেন না।  কিন্তু আমি অনড় ছিলাম, আছি।”






কিন্তু ব্যবসার শুরুতেই পুঁজির সংকটে পড়েন এমবিএ প্রথম সেমিস্টারের শির্ক্ষাথী সোলায়মান হাসান।  বলেন, “প্রথম দিকে টাকার অভাবে আমি প্রায় ভেঙে পড়ি। এরপর নেত্রকোনা এলাকার ঠিকাদার রিজম ভাই আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দেন, আর পাঁচ হাজার টাকা আমি জোগাড় করি। এই ১০ হাজার টাকা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের মূল ফটকের পাশে গত বছরের অক্টোবরে ব্যবসা শুরু করি।  প্রতিদিন আড়াই শ থেকে তিন শ টাকা আয় হয়। তা থেকে আমি আমার থাকা-খাওয়া ও পড়ালেখার  খরচ চালাই। থাকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের ৪১০ নম্বর রুমে।”






তিনি বলেন,  ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন। এই সংগঠনের গৌরবগাঁথা ইতিহাস রয়েছে। আছে অনেক সুনাম, খ্যাতি। এই খ্যাতি আমিও অর্জন করতে চাই।






পড়ালেখা শেষ করে প্রকৃত রাজনীতিক হতে চান সোলায়মান। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে আওয়ামী লীগের ডোনার হওয়ারও স্বপ্ন তার চোখে-মুখে।






ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেছে, ছাত্রলীগের এই নেতাকে নিয়ে এখন ক্যাম্পাসে বেশ আলোচনা। অনেকে বলেছেন, ছাত্রলীগের যারা বিপদগামী, তাদের অনুপ্রেরণা তিনি। এখন সোলায়মানের বন্ধু, রাজনৈতিক সহকর্মী, শিক্ষকরাও গর্ব করেন তাকে নিয়ে। সোলায়মানের বন্ধু আমিনুল ইসলাম, মনোয়ার, সাইফুল ইসলাম জানান, তারা গর্বিত যে সোলেমান রাজনীতি করেও অসৎ পথে পা বাড়াননি। সৎ পথে থেকেই রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে।






সোলায়মান সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদি হাসান শিশির বলেন, “সে দলে সক্রিয়। আমরা তার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।”






সোলায়মান খানের শিক্ষক আজিজুর রহমান জানান, “সোলায়মান ছাত্র হিসেবে অনেক ভালো। আমরা আশা করছি সে অনেক বড় হবে।”






বাবার ওষুধ কোম্পানির চাকরির কারণে ১৯৯৪ সাল থেকে রংপুরে বসবাস করছে সোলায়মানদের পরিবার।  রংপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। সেখান থেকেই প্রত্যক্ষভাবে শুরু হয় রাজনীতি। পরের বছর ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হই।  ২০১২ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা অনুমোদন দেয়। ওই কমিটিতে ৩ নম্বর সহসভাপতি করা হয় সোলায়মানকে।






(ঢাকাটাইমস/১৮ফেব্রুয়ারি/মোআ)