logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
ব্যাংক লুটের বিচার কই?
আল ফারুক ও হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০২:৫৪
image




বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট শ কোটি টাকার সমমূল্যের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হওয়া নিয়ে তোলপাড় দেশ-বিদেশে। গভর্নরের পদ থেকে সরে যেতে হয়েছে ড. আতিউর রহমানকে। অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে দুই ডেপুটি গভর্নরকে। ওএসডি করা হয়েছে ব্যাংকিং বিভাগের সচিবকে।



বিদায়ী গভর্নর আতিউর রহমান বলেছেন, হ্যাকাররা হানা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে সরিয়ে নিয়েছে এই টাকা। সরকার আশা করছে রিজার্ভের এই টাকা উদ্ধার করা যাবে। নতুন গভর্নর ফজলে কবিরও বলেছেন, চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধারই হবে তার অগ্রাধিকার।



এ মুহূর্তে আট শ কোটি টাকা চুরি নিঃসন্দেহে দেশের সবচেয়ে বড় আলোচিত ঘটনা। অথচ এর চেয়ে বড় অঙ্কের টাকা লোপাটের ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গেছে প্রায়। ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে কেউ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযুক্ত সরকারের আয়ত্তে থাকলেও তার বিচার আটকে যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রতায়। আবার সঠিক উপায়ে ঋণ নিলেও তা ফেরত দেওয়ার নাম নেই কারও কারও।



গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী ও বিশেষায়িত বেসিক ব্যাংক থেকে গত পাঁচ বছরে লোপাট হয়েছে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা। কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বেসরকারি ব্যাংক থেকেও।



বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শুধু হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমেই প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে সোনালী ব্যাংক থেকে। বেসিক ব্যাংক থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আত্মসাৎ করেছে আরও সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ আত্মসাৎ করেছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। চট্টগ্রামের শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ হিসেবে পরিচিত একটি গ্রুপও রাষ্ট্র্র্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। এসব ঋণ আদায় করতে না পেরে খেলাপি ঘোষণা করেছে ব্যাংকগুলো।



ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে শোধ দিয়েছেন এমন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কত? প্রতিবছর ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হয়। অথচ কজন নিয়মিত ঋণ শোধ করেন এমন কোনো তালিকা কি আছে? জবাবে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের পরিচালক মুচকি হেসে বলেন, ‘প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর আছে। বড় অঙ্কের ঋণ যারা নেন তারাও বড়। আর বড়দের কাছ থেকে টাকা আদায় কঠিনই বটে।’ আক্ষেপ নিয়ে ওই পরিচালক বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে অনেকের। কাগজে-কলমে ভুয়া প্রকল্প সাজিয়ে ঋণ নাও মেরে দাও- এ মূলনীতিই এই ব্যবসার মূলধন।’



স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গত প্রায় ৪৪ বছরে ব্যাংকঋণ খেলাপির সংখ্যা কত, সে তথ্য আদৌ কোথাও আছে কি না জানা নেই ব্যাংকসংশ্লিষ্টদেরই। ব্যাংকিং খাতের এত কড়াকড়ির পরও বড় অঙ্কের ঋণ ব্যবস্থাপনা চলছে ‘ফ্রি স্টাইলে’। তাদের ব্যবসার মূল কিংবা হাঁড়ির খবর নিতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার জোগাড়।



এখন পর্যন্ত ব্যাংকঋণ জালিয়াতির যেসব খবরে এসেছে তার একটিও সুষ্ঠু বিচার হয়নি। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বাগিয়ে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার একটিও আদায় করা হয়নি। বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি করেও ঋণের টাকা অর্ধেক শোধ নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোই বারবার শিকার হয়েছে ঋণ জালিয়াতির। কেউ ঋণ জালিয়াতি করে আছে কারাগারে। কেউ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশে। আবার কেউ পাড়ি দিয়েছেন বিভূঁইয়ে। শিল্পপতিদের তালিকায় শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যেও দু-একজন আছেন এর মধ্যে। মুখে মুখে অনেকে ঋণখেলাপি হিসেবেও পরিচিত। কিন্তু তাতে তাদের কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না।



সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির অভাবে বড় ধরনের জালিয়াতি ঘটেছে ব্যাংক খাতে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্বলতা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিও সঠিক সময়ে হয় না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির ঘটনাও ঘটে।’



ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতাও বাড়ানো প্রয়োজন।’



ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোতে সাধারণ গ্রাহকদের রাখা আমানতের একটি বড় অংশ প্রতিবছরই ঋণখেলাপির কারণে বেহাত হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ঋণের নীতিমালা এত কড়াকাড়ি করার পরও শতভাগ ঋণ আদায় সম্ভব হচ্ছে না।’ তবে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ আদায়ের হার ভালো বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।



হলমার্কের নজিরবিহীন জালিয়াতি, আদায় হয়নি টাকা



বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত আর্থিক কেলেঙ্কারি এটি। হলমার্ক নামের প্রায় অখ্যাত একটি গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের হোটেল রূপসী বাংলা শাখা থেকে তিন হাজার ৬০৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে জালিয়াতি করে।



ভুয়া রপ্তানি বিল, জাল করা হিসাব এবং অপ্রতুল জামানতের বিপরীতে হলমার্ক গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার শুরুর দেড় বছর পরে সোনালী ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্থাপক এই দুর্নীতির সন্ধান পান। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পরিদর্শন ও অনুসন্ধানের সুপারিশ করেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৌখিকভাবে ওই সুপারিশ অনুমোদন করেন। তবে একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক চার মাস ধরে অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার কাজটি ঠেকিয়ে রাখেন বলে অভিযোগ উঠেছে।



ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর হোসেন ও চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা করে দুদক।



আসামিদের মধ্যে আছেন তানভীরের ভায়রা ও গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, সেনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক মীর মহিদুর রহমান, দুই উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শেখ আলতাফ হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত) ও মো. সফিজউদ্দিন আহমেদ (সাময়িক বরখাস্ত) কারাগারে আছেন।



এদের মধ্যে জামিনে আছেন তানভীরের স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ও জামাল উদ্দিন। কারাগারে মারা গেছেন সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান।



মামলার অন্য ১৭ আসামি পলাতক। তারা হলেন, হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের মালিক শহিদুল ইসলাম, স্টার স্পিনিং মিলসের মালিক আব্দুল বাছির, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের মালিক জিয়াউর রহমান, আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, প্যারাগন প্রুপের মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম রাজা, নকশী নিটের মহাব্যবস্থাপক আবদুল মালেক ও সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন সরকার, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জিএম ননী গোপাল নাথ (ওএসডি), প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, ডিএমডি মাইনুল হক (ওএসডি), দুই উপমহাব্যবস্থাপক কামরুল হোসেন খান (সাময়িক বরখাস্ত) ও এজাজ আহম্মেদ, সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন ও সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার বর্তমান জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি।



মামলার চার বছরেও বিচার বা টাকা উদ্ধারে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। তবে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কামরুল হোসেন মোল্লা তিনটি মামলায় বিচার শুরুর আদেশ দিয়ে অভিযোগ গঠন করেছেন। এই তিন মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে ৩ মার্চ।



প্রতি মাসে এক শ কোটি টাকা জমা দেওয়ার শর্তে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট জামিন পান হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম। এই হিসাবে গত ৩০ মাসে তার তিন হাজার কোটি টাকা জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটি টাকাও দেননি তিনি। আর শর্ত ভঙ্গের পরও জেসমিনের জামিন বাতিল হয়নি।



হলমার্ককে ছাড়িয়ে বেসিক ব্যাংক



২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারিতে সংকটে পড়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখায় এই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে।



ব্যাংকের পর্ষদের ১১টি সভায় মোট তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে পর্ষদ কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেনি বলে অভিযোগ আছে। কোনো আইন বা বিধিমালা নয়, প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও পর্ষদ ঠিকই ঋণের অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এভাবে আর কখনোই ঋণ বিতরণ করা হয়নি।



বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে বলেছে, বেশির ভাগ ঋণই গুরুতর অনিয়ম করে দেওয়া হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ বা আদায় হওয়ার সম্ভাবনাও কম।



চার বছর অনুসন্ধানের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্র্রায়ত্ত ব্যাংকটির ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। এতে বেসিক ব্যাংকের ২৬ কর্মকর্তাকে আসামি করা হলেও ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্যকে রাখা হয়নি।



অথচ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিকে পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল। বিদেশে থাকা অর্থমন্ত্রীর কাছে রাখা সংসদ সদস্যদের প্রশ্ন এবং উত্তর সংসদ অধিবেশনে টেবিলে উত্থাপিত হয়। সেখানেই এই জবাব দেওয়া হয়।



জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য বাচ্চুকে ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়েছিল। কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করার পর বাচ্চু পদত্যাগ করেন।



তখন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, পদত্যাগ করলেই পার পাবেন না বাচ্চু। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুই বছর পরও সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখনও দুদক বলে যাচ্ছে, তদন্তে প্রমাণ পেলে বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে তারা।



বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি



সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতির আরেক আলোচিত নাম বিসমিল্লাহ গ্রুপ। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাদের আত্মসাৎ করা মোট টাকার পরিমাণ এক হাজার ১৭৪ কোটি। এর মধ্যে তারা জনতা ব্যাংক থেকে ৩৯২ কোটি ৫৭ লাখ, প্রাইম থেকে ৩০৬ কোটি ২২ লাখ, যমুনা থেকে ১৬৩ কোটি ৭৯ লাখ, শাহজালাল থেকে ১৪৮ কোটি ৭৯ লাখ ও প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে ৬২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।



গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঘটনা অনুসন্ধানে ২০১৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কমিটি গঠন করে দুদক। ওই বছরের ৩ নভেম্বর ১২ মামলায় ৫৪ জনকে আসামি করে রাষ্ট্র্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।



তবে এজাহারে অন্তত তিন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী, দুই সাংসদপুত্রের সংশ্লিষ্টতা থাকার পরও তাদের নাম না থাকা এবং একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও নাম দেওয়ায় এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।



আসামিদের মধ্যে বিসমিল্লাহ গ্রুপের রয়েছে ১৩ জন, বাকি ৪১ আসামি পাঁচটি ব্যাংকের। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের তিন শাখার ১২ জন। শাখা তিনটির মধ্যে করপোরেট শাখায় সাতজন, মগবাজার শাখায় তিনজন এবং এলিফ্যান্ট রোড শাখায় দুজন কর্মকর্তা আসামি হয়েছেন। প্রাইম ব্যাংকের আসামি নয়জন, প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাতজন, যমুনা ব্যাংকের পাঁচজন এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের আটজন।



১২টি মামলার সবকটিতেই বিসমিল্লাহ গ্রুপের পরিচালক খাজা সোলেমান চৌধুরী আসামি। অন্য মামলাগুলোতে রয়েছেন খাজা সোলেমানের স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নওরীন হাবিব, পরিচালক খাজা সোলেমানের বাবা সফিকুল আনোয়র চৌধুরী ও মা সারোয়ার জাহান (পরিচালক)। গ্রুপের অন্য আসামিরা হলেন আবুল হোসেন চৌধুরী, আবিদা হাসিব, নাহিদ আনোয়ার খান, খন্দকার মো. মইনুদ্দিন আশরাফ, বকর আজিজ মুতাক্কি, আবুল হোসাইন চৌধুরী, রিয়াজউদ্দিন আহম্মদ, আক্তার হোসেন, মঈন উদ্দিন এবং গোলাম মহিউদ্দিন আহম্মেদ। তাদের মধ্যে খাজা সোলেমান ও তার স্ত্রী নওরীন হাবিব দুবাইয়ে, আবুল হোসেন মালয়েশিয়ায় ও মঈন উদ্দিন জার্মানিতে রয়েছেন।



গত ১৭ মার্চ মামলাটি আবার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ এম আতোয়ার রহমান। আদালতের পেশকার মোহাম্মদ রফিক বলেন, দুদকের তদন্ত যথাযথ না হওয়ায় আদালত মামলা দুটি আবার তদন্ত করে আগামী ২ মে দুটি মামলার সম্পূরক বা অধিকতর তদন্তের প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।



বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে আত্মগোপন



ব্যাংক খাতের শতাধিক ঋণগ্রহীতার হদিস মিলছে না। নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করে তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। অনেকে আবার বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এসব ঋণগ্রহীতাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। একদিকে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে তাদের মর্টগেজ দেওয়া কাগজপত্রও ভুয়া।



সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায়ও এদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এদের ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।



সূত্র জানায়, শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকেই শতাধিক ঋণগ্রহীতা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কোনো কোনো ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো ব্যাংক এদের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পরামর্শ চেয়েছে। বিপুল অঙ্কের এই ঋণ ‘খেলাপি’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।



বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০২ সালে মেশিনারি আমদানির নামে ওয়েস্টমন্ট পাওয়ার (বাংলাদেশ) লিমিটেডের অনুকূলে জনতা ব্যাংক থেকে ১২ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার (৭৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা) ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই ঋণ নিয়ে সে সময় বিদেশে পালিয়ে গেছেন এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কাজী তাজুল ইসলাম ফারুক।



ওয়াহিদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ব্যবসায়ী সেজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে পঁাঁচ ব্যাংক থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ, পলাশ এন্টারপ্রাইজ, রতœা এন্টারপ্রাইজ, মাসুদ ট্রেডিং, ইউনাইটেড ট্রেডিং, অটো ডিফাইন, ওয়েস্টার্ন গ্রিল, ডেং ডি লায়ন রেস্টুরেন্ট, ফিয়াজ ট্রেডিং ও আলী ট্রেডিং। এর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি, কৃষি ব্যাংক থেকে ১২৪ কোটি, সিটি ব্যাংক থেকে ছয় কোটি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি থেকে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর বেশির ভাগ টাকাই তিনি ঋণ নিয়েছেন ভুয়া ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে। সর্বশেষ তিনি ৭৬৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বেসিক ব্যাংক থেকে। এখন তার আর কোনো হদিস পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।



বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে সিদ্দিক ট্রেডার্স ২০১১ সালে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এখন লাপাত্তা। ব্যাংকটি এক টাকাও আদায় করতে পারছে না। এর মধ্যে ঢাকার একটি শাখা থেকে সিদ্দিক ট্রেডার্স নামে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ও চট্টগ্রামের একটি শাখা থেকে আরেকটি নামসর্বস্ব গ্রুপ ৭০০ কোটি টাকা নিয়েছে। ঋণ নেওয়ার পর প্রথম দুই বছর লেনদেন স্বাভাবিক থাকলেও পরে আর ওই মালিকদের খুঁজে পাচ্ছে না ব্যাংক।



ইয়াসির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাহের হোসেন কয়েকটি ব্যাংক থেকে ৪৮১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন। তার কাছে পাওনাদারদের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি ব্যাংক ও একটি বেসরকারি ব্যাংকও (ঢাকা ব্যাংক)।



চট্টগ্রামের গিয়াসউদ্দিন কুসুম নামে এক ব্যবসায়ী অগ্রণী, সোনালী ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে মোট ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে। তবে ঋণ নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেওয়ায় তাদের কোনো কিছুই করা যায়নি। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে ২০৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সানশাইন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানেরও হদিস নেই।



সর্বশেষ চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা দুই ভাই মিজানুর রহমান শাহিন ও মজিবুর রহমান মিলন সরকারি-বেসরকারি নয়টি ব্যাংক থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। ব্যাংকগুলো তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) বিভাগের তথ্য অনুযায়ী তাদের ১০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর অনুকূলে তারা ঋণ নিয়েছেন। এখন ব্যাংক তাদের খুঁজে পাচ্ছে না।



বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মিজানুর রহমান শাহিন মিশম্যাপ শিপ ব্রেকিংয়ের নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ১৭২ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে ৯ কোটি ৫৫ লাখ এবং অগ্রণী ব্যাংকের লালদীঘি ইস্ট শাখা থেকে ৩১ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ নেন। তার প্রতিষ্ঠান ফয়জুন শিপ ব্রেকিং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখা থেকে ৩৭ কোটি ১৯ লাখ ও যমুনা ব্যাংকের কদমতলী শাখা থেকে পাঁচ কোটি ১১ লাখ টাকা নিয়েছে। একই মালিকের বিআর স্টিল মিলস ঢাকা ব্যাংকের আইবিবি মুরাদপুর শাখা থেকে নিয়েছে ২৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তার ভাই মজিবুর রহমান মিলন এমআর শিপিং লাইনসের নামে ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে নিয়েছেন ১৪২ কোটি টাকা। মুহিব স্টিল অ্যান্ড শিপ রি-সাইক্লিংয়ের নামে প্রিমিয়ার ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৪৬ কোটি সাত লাখ, অগ্রণী ব্যাংকের লালদীঘি ইস্ট শাখা থেকে ৯১ কোটি ৯৩ লাখ ও মার্কেন্টাইলের আগ্রাবাদ শাখা থেকে নিয়েছেন ২০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এমআরএম এন্টারপ্রাইজের নামে শাহ্জালাল ব্যাংক থেকে সাত কোটি ২০ লাখ এবং ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে আহমেদ মোস্তফা স্টিল ইন্ডাস্ট্রির নামে ৪৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন মিলন। এ ছাড়া দুই ভাইয়ের যৌথ মালিকানার সানমার হোটেলস লিমিটেড প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা ১০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছিল। সেই হোটেল নির্মিত হয়নি; টাকাও আদায় করতে পারেনি ব্যাংক।



বেসিক ব্যাংক থেকে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালে ১৪ জন গ্রাহক ৫৬৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। ব্যাংককে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়টিও সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা করা হয়েছে।



আরও কিছু কেলেঙ্কারি



২০০২ সালে পাঁচটি ব্যাংক থেকে ওম প্রকাশ নামের এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর কারচুপি করে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে খবর প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। এ টাকা আর পাওয়া যায়নি।



২০০৬ সালে হাওয়া ভবন সম্পৃক্তদের কোনো রকম চেক না লিখেই ৫৯৬ কোটি টাকা তছরুপ করা এবং ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নুরুন্নবীর জাল করা স্থানীয় এলসি দিয়ে ৬২২ কোটি টাকা গায়েব করে দেওয়ার ঘটনাগুলোরও কোনো প্রতিকার হয়নি।



এর চেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে ডেসটিনি গ্রুপের ক্ষেত্রে। প্রতিষ্ঠানটির অপকর্মের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার তিন মাস পরে সোনালী ব্যাংকে রক্ষিত ওই কোম্পানির অবৈধ আমানতে সংগৃহীত মূল অ্যাকাউন্ট থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা হর্তাকর্তাদের ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এরও কোনো বিচার হয়নি।



গ্রাহকরা ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাংকের ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ২২২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের লালদীঘি পূর্ব কর্পোরেট শাখা থেকে ৫১৩ কোটি টাকা নিয়েছে ছয়টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে নূরজাহান সুপার অয়েল ৬৫ কোটি ৪৮ লাখ, খালেক অ্যান্ড সন্স ২০৬ কোটি ২১ লাখ, মুহিব স্টিল অ্যান্ড সাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ ৯২ কোটি, চিটাগাং ইস্পাত ৭৪ কোটি, ইমাম মোটরস দেড় কোটি, রুবাইয়াত ভেজিটেবল অয়েল মিলস ৭৪ কোটি টাকা।



আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখা থেকে নেওয়া হয়েছে ৪১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাররীন ভেজিটেবল অয়েল ৩০৬ কোটি ৩৮ লাখ, এমএম ভেজিটেবল অয়েল মিলস ৬০ কোটি, শিরিন এন্টারপ্রাইজ ৫২ লাখ টাকা। আসাদগঞ্জ কর্পোরেট শাখা থেকে জাসমীর ভেজিটেবল অয়েল ৮৬ কোটি এবং মিজান ট্রেডার্স ৬০ কোটি টাকা নিয়েছে। নিউমার্কেট কর্পোরেট শাখা থেকে তাসমিন ফ্লাওয়ার মিলস নিয়েছে ২৮ কোটি টাকা।



বাণিজ্যিক এলাকা করপোরেট শাখা থেকে নেওয়া হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিদ্দিক ট্রেডার্স ১০৯ কোটি, এমএস ওয়্যারিং অ্যাপারেলস তিন কোটি এমএস গার্মেন্ট ৫৬ লাখ, মাসুদা ফেব্রিক্স এক কোটি ৩০ লাখ এবং অ্যাপ্ট পিলেট ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ ছয় কোটি ৪৫ লাখ টাকা নিয়েছে।



ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে শহিদুল আহসান নামের এক ব্যবসায়ীকে বেসরকারি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক গুলশান শাখা, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রিন্সিপাল শাখা ও এক্সিম ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় করপোরেট শাখা থেকে ৬৩৪ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দল নিরীক্ষা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে জবাব চেয়েছে। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে জবাব দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ওই জবাব সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছে।



সম্প্রতি কৃষি ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পদ্মা ফেব্রিকস ও ব্লিচিং ডাইং, মিমটেক্স নিটিং, রোজবার্গ ইন্ডাস্ট্রিজ, কেয়া ইয়ার্ন মিলস, ফেয়ার, ফিয়াজ গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে তাতে। ব্যাংকটির নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকেও জেবি ট্রেড, মা এয়ার জেট স্পিনিং, ওশান স্পিনিং, মারহাবা স্পিনিং, স্টার কুটিরশিল্প, এঞ্জেল ওয়্যার হাউস, এইচএইচ টেক্সটাইল, অ্যাবা টেক্সটাইল ও নিট পারজোয়ার টেক্সটাইল বিভিন্ন পন্থায় টাকা বের করে নিয়েছে। এসব অনিয়মের কারণে ২০১৩ সাল শেষে এক হাজার ৬৯১ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতেও পড়ে কৃষি ব্যাংক। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে বিতরণ করা ঋণের ৩৩ দশমিক ২১ শতাংশ। অঙ্কের হিসাবে পরিমাণটা ৫ হাজার ২২ কোটি টাকা। এ অবস্থায় ব্যাংকটির ৬ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারকে অনুরোধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।



বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন লিখেছেন, ‘ব্যাংকিং ব্যবস্থার জীবনীশক্তি ক্ষয়কারী জালিয়াতি, তছরুপ ও আত্মসাতের তেমন বিচার হচ্ছে না, হবে বলেও মনে হয় না। যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুশীল সমাজ এবং একটি ঐক্যবদ্ধ ও বস্তুনিষ্ঠ মিডিয়া সজ্ঞানে এসব জঘন্য অপরাধের বিচারে কৃতসংকল্প বা সোচ্চার না হয়, তাহলে জনগণকে কিন্তু অরাজকতার অন্ধকারে ফেলে দেওয়া হতে পারে।’



টাকা ফেরত পাওয়ার আশা নেই!



নামে-বেনামে বা জালিয়াতি করে দেওয়া ঋণ ফিরে যাওয়ার আশা নেই বললেই চলে। নানা সময়ে তদন্তে দেখা গেছে নামসর্বস্ব কোম্পানিকে বড় কোম্পানি দেখিয়ে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্র মর্টগেজ হিসেবে জমা নিয়ে মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালকরাও এ ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। আর ব্যাংকের সহযোগিতায় ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়েছেন অনেকেই।



ঋণ কেলেঙ্কারির কারণেই সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে চলতি বছরের বাজেটে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।



প্রস্তাবিত বাজেট প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে মূলধন ঘাটতি পূরণে রাখা হয় ৩৪১ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এক হাজার ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও ওই অর্থবছরে ব্যয় হয় ৫৪১ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য ৪২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও ব্যয় হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আবারও পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও খরচ হয় পাঁচ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও মূলধন ঘাটতি পূরণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।



মূলধন ঘাটতি ১১ হাজার কোটি টাকা



গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষি ব্যাংকের ছয় হাজার ১৫ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থান বেসিক ব্যাংকের। এদের মূলধন ঘাটতি তিন হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ৫৯৯ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৫৫২ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৩৫৫ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের ৯৩ কোটি টাকা।



সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক খাতে যে আত্মসাৎ বা জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, এতে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা পরিষ্কার নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতার বড় দুর্বলতা রয়েছে। ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা আগ্রহ দেখা যায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ততটা তাগাদা দেখা যায় না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ঋণ যারা দিচ্ছেন তাদের উচিত কাকে ঋণ দিচ্ছে, ঋণের উদ্দেশ্য কী, যে কোম্পানিকে দিচ্ছে তার অবস্থা কেমন তা যাচাই করা। ঋণ নেওয়ার পর তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে কি না, তা নিয়মিত তদারকি করা উচিত।’



খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে



গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ২১৬ হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরের হিসাবে ঋণ দেওয়ার পর আদায় করা যায়নিÑ এমন টাকার পরিমাণ ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। তবে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে তিন হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা।



ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৮৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের আট দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০১৪ সাল শেষে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণ ছিল ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা।



২০১৫ সাল শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২০ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ এক হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের সাত দশমিক ৭৭ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।