logo ১৯ মে ২০২৫
তাবুক অভিযান: মহানবী (সাঃ)-র জীবনের শেষ যুদ্ধাভিযান
ইসলাম ডেস্ক, ঢাকা টাইমস
২৩ নভেম্বর, ২০১৩ ১০:১৪:৩৬
image

ঢাকা: নবম হিজরীর গ্রীষ্মকাল। সূর্যের প্রখর কিরণে মরু আরবের আবহাওয়া উত্তপ্ত। চারিদিকের মাঠ-ঘাট অগ্নিদগ্ধ। দুঃসহ গরমে মানুষ অস্থির চঞ্চল। আবার ঐ একই সময় গোদের উপর বিষ ফোড়ার ন্যায় দুর্ভিক্ষের হাহাকার। ঘরে অন্ন নেই, রোগে পথ্য নেই, নিদারূণ কষ্টের মাঝে মানুষের দিন কাটছে। মাঠে ফসল পাকার সময় আসন্ন। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত ভুখা মানুষের ক্লান্ত চোখে সুখময় ভবিষ্যতের এক টুকরো ছবি ঐ পাকা ফসলের মাঠকে ঘিরে। ফসল কাটার প্রস্তুতি চলছে ঘরে ঘরে। আর ঠিক এমনি সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একটা খবর ছড়িয়ে পড়লো রোমানরা মুসলমানদের ওপর আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মহানবী (সাঃ) এ সংবাদ অবগত হয়ে সারা দেশে জিহাদের সাধারণ ঘোষণা জারী করলেন। মদীনার বাইরে বিভিন্ন গোত্রকেও সংবাদ দেওয়া হলো, প্রতিটি  সামর্থ্যবান শক্তি যেন এই জিহাদে অংশগ্রহণ করে । সুদীর্ঘদিনের অমানুষিক নির্যাতন ও অক্লান্ত পরিশ্রম সহ্য করে ইসলামের যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, সেই সামগ্রিক সাফল্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের যুদ্ধ প্রস্তুতি একটা চ্যালেঞ্জস্বরূপ। যদি কোনমতে রোমানরা জয়লাভ করতে পারে, তাহলে ইসলাম চিরতরে মুছে যাওয়ার আশংকা। তাই এই জিহাদ অতি গুরুত্বপূর্ণ, ঈমানদারদের জন্য ফরয।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগের এই চরম সংকট মুহূর্তে একদিকে যেমন মানুষের ব্যক্তি জীবন বিপদাপন্ন, অপরদিকে ইসলাম তেমনি সংকটাপন্ন। কিন্তু মুসলমানদের নিকট ব্যক্তিগত সমস্যার চাইতে ইসলামের সমস্যা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুতঃ দুঃসময়ের এই অভিযান মুসলমান ও মুনাফিকের মধ্যে একটা মাপকাঠিও।

মুজাহিদদের খাদ্য ও যুদ্ধাস্ত্রের জন্য বিপুল অর্থ ও সম্পদের প্রয়োজন। মুহাম্মদ (সাঃ) অর্থ সংগ্রহের জন্য সাহাবাদের কাছে আবেদন জানালেন। ওসমান গনি (রাঃ) নিজেই ১০ হাজার উট ও দশ হাজার মুজাহিদের খাদ্য সরবরাহ করলেন। ওমর (রাঃ) তাঁর সমুদয় সম্পদের অর্ধাংশ দান করলেন। আবূ বকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদ নবীর পদতলে উপস্থিত করলে নবী জিজ্ঞাসা করলেন, "আবূ বকর, তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য কি রাখলে?" সিদ্দিক তাঁর জওয়াবে বললেন, "আল্লাহ ও আল্লাহ্র রাসূল।"

তাবুক অভিযানে ১০হাজার অশ্বারোহী এবং ২০ হাজার উষ্ট্রারোহী ও পদাতিক সৈন্য সংগৃহীত হলো। আবু বকর, আলী ও মুহাম্মদ বিন মাসলামাকে মদীনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করে মহানবী (সাঃ) গ্রীষ্মের সেই অগি্নঝরা মরুর বুকে মুসলিম বাহিনীসহ সিরিয়ার পানে যাত্রা করলেন।

দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার সময় মুসলিম বাহিনী হিজবের কুপের নিকট কিছুক্ষণ অবস্থান ও তৃষ্ণা মিটাবার সংকল্প করলো। কিন্তু দূরদর্শী সেনাপতি শ্রান্ত সৈনিকদেরকে বিশ্রাম ও পানি পান করতে নিষেধ করলেন। এমনকি ওযূ করতেও দেওয়া হলো না। ঈমানের বলে বলীয়ান মুজাহীদ বাহিনী প্রবল তৃষ্ণা সত্ত্বেও নেতার আদেশ পালন করলো। সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগল তারা। অনতিবিলম্বে মরুর আকাশ থেকে রহমতস্বরূপ বৃষ্টির ধারা নেমে এল। পরম কৃতজ্ঞতায় আল্লাহ্ পাকের প্রতি মুসলমানদের অন্তর আপ্লুত হয়ে গেল। অনেকে মনে করলো নিশ্চয়ই মহান নবীর মু'জিযার জন্য অসময়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি সম্পন্ন নবী (সাঃ) বললেনঃ "এটা প্রকৃতির নিয়ম, মেঘ থেকেই বৃষ্টিপাত হয়।"

মুসলমানরা যথাসময়ে তাবুকে পৌছাল। অনুচর মারফত রোমন সম্রাট খবর পেলেন যে বিপুল সংখ্যক মুসলমান এই অভিযানে শরীক হয়েছে। মুসলমানদের মুকাবিলার জন্য দাম্ভিক সম্রাট সাহস পেলো না। মাত্র দু'বছর পূর্বে তিন হাজার মুসলমানের সাথে রোমানদের লক্ষাধিক সৈন্যের যুদ্ধ অভিজ্ঞতা তাদের মনে আছে। আর এবার তার দশগুণ সৈন্য। শুধু তাই নয়, এই বাহিনীর সেনাপতি স্বয়ং আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সাঃ)। রোমান সম্রাট যুদ্ধ এড়াবার জন্য সীমান্ত থেকে সৈন্য পশ্চাতে অপসারণ করলেন। বিশদিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাবুকে শত্রুর অপেক্ষা করলেন। কিন্তু রোমানদের পক্ষ থেকে কেউ অগ্রসর হলো না।

এখানে একটি বিশেষ দিক উল্লেখযোগ্য যে, পৃথিবীর অন্য কোন পার্থিব সারথদ্ধারকারি সেনাপতি হলে শত্রুর এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করতেন। মুহাম্মদ (সাঃ) যথোপযুক্ত আয়োজনসহ তৎকালীন অন্যতম পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সিরিয়া সীমান্তে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু বিপক্ষ দল পরিস্থিতি উপলব্দি করে যুদ্ধ এড়িয়ে গেল, তিনিও যুদ্ধের জন্য কোন আগ্রহ দেখালেন না। ইচ্ছা করলে তিনি আরও অগ্রসর হতে পারতেন। মদীনার বুকে বসে যে রোমানদের যুদ্ধায়োজনের কথা শুনে তিনি বহির্গত হয়েছিলেন, শত্রুর সীমান্তে পৌঁছে শত্রুর নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ করে তাদের দুর্বলতা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কাজেই শত্রুর এই নাজুক পরিস্থিতিতে তাদের সম্পদ লুন্ঠন ইত্যাদি কাজও করা যেত। কিন্তু ইসলাম আক্রমণাত্বক নীতিতে বিশ্বাসী নয়। এমনকি যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েও শত্রুপক্ষ থেকে তীর নিক্ষেপ ও অস্ত্রাঘাতের জন্য মুসলমানদের অপেক্ষা করতে হয়। তাবুক অভিযানেও সেই নীতিরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। এ ব্যাপারে কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ হলোঃ

"এবং যুদ্ধ কর আল্লাহ্র পথে তাদের বিরুদ্ধে, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু সীমা লংঘন করো না।" .....(২:১৯০)

তাবুক অভিযানে মহানবী (সাঃ)-র জীবনের শেষ যুদ্ধাভিযান। এই অভিযানে মদীনার উত্তরের বিভিন্ন গোত্র মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত  হয়। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যে দ্বিতীয় হিজরীতে ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) যখন তাঁর নবজাত রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, বদরের প্রান্তরে তখন তাঁর সাথে ছিল মাত্র ৩০৫ জন সৈন্য। আর মাত্র সাত বছর পর যখন বিশ্ববিজয়ী রোমানদের সম্ভাব্য আক্রমণের প্রতিরোধের জন্য তাবুকে অভিযান চালালেন, তখন তাঁর সাথে ছিল ৩০ হাজার সৈন্য। এর দু'বছর পর একাদশ হিজরীতে যখন মহানবী (সাঃ) ইন্তিকাল করেন, তখন তার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা সিরিয়া থেকে এডেন এবং ইরাক থেকে জেদ্দা পর্যন্ত তথা এক মিলিয়ন বর্গমাইল বিস্তুৃতি লাভ করেছিল। অথচ এত বড় একটা সাম্রাজ্য কায়েম করতে যে অনুপাতে রক্তপাত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, তা-ও হয়নি। কারণ তাঁর প্রতিটি যুদ্ধই ছিল প্রতিরক্ষামূলক। যদি তিনি আলেকজান্ডার বা অন্যান্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকারীদের মতো দেশ জয়ে বের হয়ে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করতেন, তাহলে লাখো লাখো মানুষের রক্তে পৃথিবীর মাটি সিক্ত হতো। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, শত্রুপক্ষে মাত্র ১৫০ জন লোক নিহত হয়েছিল: তাও বিশ্বাসঘাতক ইয়াহুদী গোত্র বনু কুরাইযাদের ধর্মানুসারে মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে। আর মুসলমানদের পক্ষে শহীদ হয় দশ বছরের মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে একজন করে।


(ঢাকাটাইমস/২৩নভেম্বর/ইসলাম/এসএ/ঘ)