আর যখন তাদের মধ্যে থেকে এক সম্প্রদায় বলল, “কেন সে লোকদের সদুপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা আযাব দিতে চান কঠিন আযাব”? তারা বললঃ “তোমাদের পালনকর্তার নিকট দায়িত্বমুক্তির জন্য এবং যেন তারা সাবধান হয় এজন্য”।
(আল আরা’ফ ১৬৪)
সুরা আল আরা’ফের ১৬৪ নং আয়াতটিতে বনী ইসরাইলদের (তৎকালীন মুসলিম) একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুতঃ ঘটনাটি শুরু হয়েছে আগের আয়াত অর্থাৎ ১৬৩ নং থেকে। আল্লাহ্ সুবাহানতালা বনী ইসরাইলদের (তৎকালীন মুসলিম) পরীক্ষা করার জন্য ছ্যাবাতের দিন (শনিবার) মাছ ধরতে নিষেধ করেন। আল্লাহ্র নির্দেশেই শনিবারগুলোতেই রাজ্যের মাছ নদীতে এসে হাজির হতে থাকে, এমনকি লাফঝাঁপ করতে থাকে। এই প্রলোভন থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখা এক শ্রেণীর বনী ইসরাইলদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং তারা আল্লাহ্র আদেশ অমান্য করে ছ্যাবাতের দিন কূটবুদ্ধি খাটিয়ে মাছ ধরে ফেলে। বনী ইসরাইলদের অপর একটি দল আল্লাহ্র নিষেধ মান্য করে এবং শনিবারে মাছ ধরতে উদ্যত হয় না। এখানে প্রধান দুইটি দল; একদল যারা হালাল-হারামের গ্রাহ্য করে নি এবং আরেকটি দল যারা আল্লাহ্র নিষেধ মান্য করেছিল। দ্বিতীয় দলটি আবার দুই দলে বিভক্ত হয়। একটি দলের মনভাব সীমালঙ্ঘনকারী দলটির (যারা আল্লাহ্র আদেশ অমান্য করে ছ্যাবাতের দিন মাছ ধরে ফেলে) প্রতি ছিল এইরূপ যে, “তারা একটি ব্যপারে সীমালঙ্ঘন করেছে ঠিকই, তবে তারা এখনো আমাদের ভাই। যে কোনভাবেই হোক, তাদের ভুল হয়ে গেছে। আমাদের উচিৎ তাদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলা যে, ‘কাজটা তোমরা ঠিক করো নি, তোমাদের আল্লাহ্কে ভয় করা উচিৎ’, তাদেরকে ভুলের মধ্যে ফেলে রাখা ঠিক কাজ হবে না”।
অপর দলটি, সীমালঙ্ঘনকারী দলটি সম্পর্কে খুবই নেতিবাচক মনভাব প্রকাশ করে এবং বলল, “ এইসব লোক উদারপন্থী, প্রগতিশীল এবং সবার উপরে সত্যত্যাগী। এরা আমাদের কেউ না। এদের উপর আল্লাহ্র গজব অবশ্যম্ভাবী। এদের বোঝানো/ না বোঝানো একই কথা, শুধুই সময় নষ্ট। এরা সব মুনাফেক, এরা দোযগের আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরুক”।
এই আয়াতটি (সুরা আল আরা’ফ ৭:১৬৪) এই কথোপকথনের উপর আলোচনা করা হয়েছে যে, দুইটি আল্লাহ্ ভীরু মুসলিম দল, সীমা লঙ্ঘনকারী মুসলিমদের দলের সাথে কথা বলবে, নাকি বলবে না?
وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِّنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا ۙ اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا
[ বাংলা ভাবার্থঃ “আর যখন তাদের মধ্যে থেকে এক সম্প্রদায় বলল, কেন সে লোকদের সদুপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা আযাব দিতে চান কঠিন আযাব”?]
খেয়াল করুন তারা ছিল ‘তৎকালীন মুসলিম’।
কারণ, সেই সময় তাদেরকে আল্লাহ্র বানী শোনানোর জন্য অধিকাংশ নবী-রাসুল পাঠানো হয়েছিল। বর্তমান মুসলিমদের মধ্যেও এর ব্যতিক্রম হয় নাই। এখনকার মুসলিমদের মধ্যেও আপনি দেখবেন দুটি প্রধান দলসহ সাব-দল দুটি বর্তমান। তারা অন্য মুসলিমদের কর্মকাণ্ডের প্রতি এতোটাই জাজমেনটাল এবং সমালোচনায় মুখর যে যখনি কেউ একটু ভুল করবে বা পা ফসকাবে, এক মুহূর্ত দেরি না করে সে তাকে “ফাসেক, মুনাফেক, মুরতাদ, কাফের” এর ট্যাগ দিয়ে দিবে। এবং তাদের থেকে এমন ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিবে যেন এদেরকে তারা চিনতই না! তারা নিজেরা খুবই নিশ্চিত যে তারা অবশ্যই বেহেশতে প্রবেশ করবে, এবং অন্যদের জন্য তারা পান থেকে চুন খসলেই জাহান্নামের আগুন তাদের ‘জ্বলে-পুড়ে ছাই’ হবার ছবি চোখের সামনে দেখতে পায়! এরা কিভাবে এতোটা নিশ্চিত হয় (নিজের এবং অন্যের ব্যপারে), তা আমি বুঝি না! তারা কিভাবে জানে যে, অন্য পক্ষ তউবা করবে না? আল্লাহ্ তাঁদের তউবা কবুল করে তাদেরকে হিদায়াত দিবে না? শুধু তাই নয়, তারা তাদের ‘বেহেশত স্বপ্নে’ এতোটাই বিভোর যে, অন্য কোন মুসলিম যদি সেই পথভ্রষ্ট মুসলিমদের সাথে কথা বলতে যায় বা বুঝিয়ে চেষ্টা করে তাদের (পথভ্রষ্ট মুসলিমদের) ফিরিয়ে আনতে, তাহলে তাদেরকেও একই পাল্লায় তুলে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করতে পিছপা হয় না! সুবাহান’আল্লাহ!
যারা পরামর্শ দেয়ার পক্ষে ছিল তারা কিন্তু এই বলে তাদেরকে সতর্ক করেনি যে, “তোমরা যা করছ, এই সব হারাম; তোমরা অবশ্যই দোযগের আগুনে জ্বলে-পুড়ে খাক হবে”।
এখানে যে শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে সেটা হোল, “লিমা তা’ইবুনা কাওমা-ন”।
এর অর্থ হোল, যথেষ্ট কোমল এবং সহজভাবে উপদেশ ও পরামর্শ দেয়া, ফলে যেন তা হৃদয়ে প্রবেশ করে (advice and counselling which is soft enough to penetrate of the heart)।
এখানে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। দাও’য়া (আহ্বান করা) [Da'wah (making an invitation)] করার উদ্দেশ্য শুধু অন্যের ছিদ্রান্বেষণ করা নয়। হাবেভাবে এবং আচার-আচরনে “দেখ আমি কত ভালো আর তুমি নরকের কীট”, ফুটিয়ে তোলাও দাও’য়ার উদ্দেশ্য নয়। অথবা, সরাসরি “এটা করো না, এটা কর” কাউকে বলা। বরং দাও’য়া হতে পারে মাঝে মাঝে বুদ্ধিমত্তার সাথে এমন ভঙ্গিতে কথা বলা যেন তারা আমাদের কথাতে আগ্রহবোধ করে। তাদেরকে এইভাবে বলা যেতে পারে, যেমনঃ “আল্লাহ্ আমাদের সৃষ্টিকর্তা। আমাদের কল্যান তিনি ছাড়া আর কে বেশী চাইবে, বল? তুমি কি জানো না যে, আমাদেরকে একদিন আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহি করতে হবে? আমাদের সবারই উচিৎ আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা; যথাযথভাবে (যেভাবে আল্লাহ্ বলেছেন) আল্লাহ্কে ভয় করা এবং সময় থাকতে তউবা করা।” দাও’য়া করার ভঙ্গি আক্রমণাত্মক না হয়ে বরং আমন্ত্রণসূচক হওয়া অধিক বাঞ্ছনীয়; এবং একই সাথে অধিক ফলপ্রসূ। কে হারাম করছে সেটা তাকে প্রথমেই না মনে করিয়ে দিয়ে বরং তাকে আল্লাহ্কে বেশী বেশী করে স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। এমনও হতে পারে যে, তারা যদি হিদায়াত চায় তাহলে আল্লাহ্ রাহমানুর রাহিম তাদের হিদায়াত করবেন এবং একসময় সে বুঝতে সমর্থ হবে যে সে ভুল পথে বা সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এবং আল্লাহ্র হুকুম থাকলে দেরি হবার আগেই তারা অন্তর থেকে তউবা করবে।
আল্লাহ্ ভীরু যে দলটি সীমা লঙ্ঘনকারীদের দলটির সাথে কথা বলতে চাইছিল, লক্ষ্য করুন কি চমৎকার শব্দ ব্যবহার করে তারা তাদের কর্মের পক্ষে যুক্তি পেশ করলো।
قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَىٰ رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُو
[তারা বললঃ “তোমাদের পালনকর্তার নিকট দায়িত্বমুক্তির জন্য এবং যেন তারা সাবধান হয় এজন্য”।]
তাদের প্রথম যুক্তি ছিলঃ “মা’দিরাতান ইলা-রাব্বিকুম” যার অর্থ হোল, “তোমাদের পালনকর্তার নিকট দায়িত্বমুক্তির জন্য”।
কার দায় মুক্তি? নিজেদের দায়মুক্তি!
“হে আল্লাহ্, আমি তাদেরকে পাপের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। তাদের নিষেধ করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি কারন তাদের উপর আমার কোন জোর-জবরদস্তি করার ক্ষমতা নাই। কিন্তু, তারা আমার মুসলিম ভাই-বোন। অন্ততঃপক্ষে আমি যথেষ্ট কোমল এবং সহজভাবে তাদেরকে উপদেশ ও পরামর্শ দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমি ব্যর্থ হয়েছি কিন্তু তাদের থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নেই নি, তুমি তো সবই জানো, আমি চেষ্টা করেছিলাম”।
আল্লাহ্ করুনাঃবশত যাদের হিদায়াত করেছেন এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করার মত প্রজ্ঞা দিয়েছেন, তাদের সকলের উচিৎ তাদের পথভ্রষ্ট ভাইবোনদের প্রতি অনেক বেশী সংবেদনশীল আচরণ করা। কারন আল্লাহ্ আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, “তারা কি তোমার মুসলিম ভাই/বোন ছিল না?’ ‘তবে কেন তুমি তাদের থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নিলে? কেন তুমি তোমার যথাসাধ্য চেষ্টা করলে না?” হিদায়াতের মালিক শুধুই আল্লাহ্। কিন্তু আমাদের ব্যবহার, আচার-আচরন, বাচনভঙ্গি যেন আল্লাহ্র নির্দেশিত সঠিক পথ বেছে নিতে এই সকল বিভ্রান্ত ভাইবোনদেরকে সাহায্য করে; এই চেষ্টাটুকু অন্তত আমাদেরকে করতে হবে। আমরা যদি সত্যি বিশ্বাস করি যে, মুসলিম উম্মাহ একটি শরীরের মত। তাহলে শরীরের এক বা একাধিক অংশ পেছনে ফেলে অসম্পূর্ণ একটি দেহ নিয়ে কি বেহেশতে প্রবেশ করা ঠিক হবে?
দ্বিতীয় যুক্তিটি হলঃ “ওয়া লা’আল্লাহুম ইয়াত্তাকুন”।
যার ভাবার্থ দাড়ায়, “এবং যেন তারা সাবধান হয় এজন্য”।
এমনও হতে পারে, তারা ভবিষ্যতে তাকওয়া অর্জন করবে। আল্লাহ্র হিদায়াত পেলে হয়তো তারা একসময় আমার চাইতেও ভালো মুসলিম হয়ে যেতে পারে। আমি কিভাবে নিশ্চিত করে জানবো যে, ভবিষ্যতে কি হবে? আমি অন্যকে যাচাই করে বিচার করার মত যোগ্যতা কি অর্জন করেছি?
এই আয়াতটি থেকে চিন্তাশীলদের জন্য দুইটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেরনা (motivation) রয়েছে। আমরা যখন আমাদের সীমালঙ্ঘনকারী ভাইবোনদের কাছে ইসলামের দাও’য়া করবো, তখন মনে রাখতে হবে প্রথম প্রেরণাটি হচ্ছে আল্লাহ্র সামনে আমাদের নিজেদের দোষমুক্তির জন্য। এবং দ্বিতীয় প্রেরণাটি হল, তাদের জন্য এই আশায় যে হয়তো একসময় তাদের ভুল ভাঙবে। আল্লাহ্তালা আমাদের সকলকে কুরআনের আয়াতসমূহ বুঝে পড়ার তৌফিক দান করুন এবং তার সঠিক মর্মার্থ বুঝে সেই ভাবে জীবনকে পরিচালিত করার মত হিকমাহ, সাহস ও ধৈর্য দিক।
[লেখকের কথা: নোমান আলী খানের Quranic Gems সিরিজের এই ভিডিওটি দেখে ভাবার্থ অনুবাদ না করে থাকতে পারলাম না। অনেক দ্রুত কাজটি শেষ করার কারনে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকাটাই স্বাভাবিক। আশাকরি আমার এই অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যা কিছু কল্যাণকর তার সম্পূর্ণই আল্লাহ্র তরফ থেকে, আর যা কিছু ভুল সেটি সম্পূর্ণ আমার।]
(ঢাকাটাইমস/৩০নভেম্বর/ইসলাম/এসএ/ঘ)