logo ০১ জুলাই ২০২৫
জীবনযুদ্ধে জয়ী ওরা চারজন

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
২১ জানুয়ারি, ২০১৪ ১৮:১২:৪৫
image


টাঙ্গাইল: কিছু মানুষ আছেন যারা সহসা অন্যের দ্বারস্থ হন না। শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যায় তারা। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলেই যেন তারা খুশি। শূন্য থেকে লড়াই করে জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া টাঙ্গাইলের এমন কয়েকজনকে নিয়ে লিখেছেন মো. রেজাউল করিম।

অন্ধ প্রতিবন্ধী বাণিজ্যের জীবন সংগ্রাম

বেকারত্ব যেখানে দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা সেখানে দেশে বেকারত্ব আছে বলে বিশ্বাস করে না এমন এক অন্ধ প্রতিবন্ধীর নাম বাণিজ্য। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ধুলটিয়ায় পিতা আব্দুল লতিফ মিয়ার ঘরে ১৯৮১ইং সালে বাণিজ্যের জন্ম। চার বছর বয়সে বাণিজ্যের যখন খেলাধুলা করার বয়স ঠিকসেই সময়ে, দুরারোগ্য ব্যাধি কেড়ে নেয় তার দু’চোখের আলো। অন্ধ প্রতিবন্ধী হয়ে মুহূর্তের জন্যও ছিটকে পড়েনি তার জীবনের লক্ষ্য থেকে। লুইবেন হেলেন ক্লারের ব্রেইলি পদ্ধতিতে এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এখন দুই ছেলেমেয়ের বাবা অন্ধ বাণিজ্য। বাড়ি থেকে প্রায় তিন-কিলোমিটার দূরে পাথরাইল বাজারে পায়ে হেঁটে প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের কাজ।  তাঁত শিল্পের গ্রাফ কাটেন আর কাগজের নকশার মালা গাঁথেন। টাকা চিনতে আর মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে তার মোটেও সমস্যা হয় না। অবসরে তিনি প্রচার কাজের মাইক ম্যানের কাজ করেন। রাতে বাঁশ ও বেতের নানান জিনিস তৈরি করেন। এছাড়া চেয়ার ও মোড়ার ছাউনি তৈরিতে রয়েছে তার পারদর্শিতা। রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও রয়েছে তার মুখে হাসি। তিনি বলেন, আমি বেকারত্ব বিশ্বাস করি না। তিনি মনে করেন, সময় ও কাজের প্রতি অবহেলা আর অসৎ সঙ্গই একজন মানুষকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দেয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও বিত্তবানদের কাছে তার চাওয়া পাওয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কারো অনুগ্রহ পছন্দ করি না। তবে আমাকে উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচার কাজে মাইকিং করার সুযোগ দিলে আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।  





শত মানুষের কর্মসংস্থানের স্রষ্টা শাহআলম

স্বাধীনতা সংগ্রামের বছরে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বর্ণী গ্রামে শাহআলমের  জন্ম । অকালে পিতা সেফাত উল্লাহ’র মৃত্যুর পর মা জয়তুন্নেছা তাকে পড়ালেখার খরচ চালান। যে ছেলে এক সময় মায়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল আজ তার প্রতিভার ছোঁয়ায় শতশত লোক কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে। শাহ আলম বাঁশ শিল্পের মাধ্যমে বদলে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী ৫ গ্রামের মানুষের ভাগ্যের চাকা। বাথুলী, কোপাখী, প্রয়াগজানী, বর্ণী ও বারপাখিয়া গ্রাম ঘুরে বাঁশ শিল্পে জড়িতদের বাস্তবতা মেলে। তার প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলের নারী পুরুষ খুঁজে পেয়েছে সারা বছরের কর্মসংস্থান। অবসরেই তারা এখন মাসে ৬,৭ হাজার টাকা আয় করছেন। তিনি জানান, এসব অঞ্চলের দু’শ বছরের ঐতিহ্য  বাঁশ শিল্পে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছেন তিনি। শখের বশে পাঠশালায় থাকাবস্থায় ২৭ বছর আগে বাঁশ শিল্পের টুকটাক কাজ শুরু করেন। অভাবের তাড়নায় ৭ম শ্রেণীতে পড়াবস্থায় এ শিল্পের সাথে পুরোদমে জড়িয়ে পড়েন। আকস্মিকভাবে বাঁশ শিল্পের সামগ্রীর চাহিদা কমতে থাকে। বেকার হয়ে যায় এ অঞ্চলের বহু লোক। শাহআলম ভাবতে শুরু করেন। কিভাবে সবাইকে বেকারত্বের গ্লানি থেকে রক্ষা করা যায়। পরে আজক ইন্টারন্যাশনালের সাথে চুক্তি হয় বাঁশের তৈরি পাখির বাসা বিদেশে রপ্তানির। অল্প সময়েই কর্মচঞ্চল হয়ে উঠে এ অঞ্চল। ১৯৯২ সালে দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আড়ং এর ডিজাইনার চন্দ্র শেখর সাহা তাকে বাঁশের তৈরি সৌখিন পণ্য তৈরির পরামর্শ দেন। শাহআলম নমুনা হিসেবে ৫টি পণ্য তৈরি করে আড়ং এ জমা দেন। তার পণ্যগুলো পছন্দ হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে তৈরির অর্ডার পেয়ে যান তিনি। শুরু হয় নতুনভাবে পথ চলা। তিনি নিজেই নতুন নতুন সৌখিন পণ্যের ডিজাইন করে শ্রমিকদের দেন। তারা সেভাবেই তৈরি করে। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে শাহ আলমের বাঁশ শিল্পের সুনাম। পরে প্রবর্তনা, বাংলার মেলা, অনন্যা ক্রাফট, উবিনীগসহ দেশের স্বনাম ধন্য প্রতিষ্ঠানে তিনি বাঁশের তৈরি সৌখিন পণ্য সরবরাহ করেন। তিনি বাংলাদেশ কারু শিল্প পরিষদ ২০০২-এ সেরা কারু শিল্পীর পুরস্কার পেয়েছেন। সরকারিভাবে নেপাল, ভারত ও চীন সফল করেছেন। তিনি বর্তমানে ট্রে, প্লেস ম্যাট, ফুলদানী, টেবিল ল্যাম্প, ড্রিংক বক্স, ওয়াল ম্যাট ও বিভিন্ন ডিজাইনের ঝুড়িসহ আধুনিক সৌখিন পণ্য তৈরি করছেন। বর্তমানে তার নতুন আবিষ্কার বাঁশের সৌখিন গহনা। প্রতি মাসে তিনি শুধু ঢাকায়ই প্রায় ৮-১০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন। এ ব্যাপারে বর্ণী গ্রামের বাঁশ শ্রমিক নাজমুল বলেন, আমি ১২ বছর যাবত কাজ করছি। প্রতি মাসে ৬-৭ হাজার টাকা আয় করা যায়। শাহ আলম ভাই আমাদের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করছেন।  এখন এ শিল্পের সাথে জড়িত আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ সারা বছরই কাজের সুযোগ পাচ্ছে। বর্ণী সুফিয়া ওমর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কালিদাস চন্দ্র মন্ডল বলেন, বাঁশ শিল্পের কারণে সারা বছরই কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে শাহআলম বলেন, আমি সব সময়ই আমার আশে পাশের লোকদের নিয়ে ভাবি। তাদের স্বল্প খরচে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য নাটিয়াপড়ায় একটি হাসপাতাল বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সরকার এবং বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে এ শিল্পের আরও উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।

আলোকিত মানুষের ব্যতিক্রম প্রচেষ্টা

সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কেউ না ভাবলেও এদের ভবিষ্যৎ  নিয়ে স্বপ্ন দেখেন জুয়েল। তিনি মনে করেন এরা দেশ ও সমাজের বোঝা নয় বরং সম্পদ। এদের জন্য একটু সময়, একটু শ্রম বা সামান্য কিছু আর্থিক সহযোগিতা করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই দেশের সম্পদে পরিণত হতে পারে। আর এ বিশ্বাস থেকে টাঙ্গাইল শহরের মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র জুয়েল আহমেদ শহরের আদি টাঙ্গাইলে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ফ্রেন্ডশিপ স্কুল।

প্রারম্ভেই ঝরে পড়ারোধ করতে তার এ প্রচেষ্টা। জুয়েলের স্কুলে বর্তমানে শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত শিশু পড়ালেখা করছে। শুধু বিনে পয়সায় পাঠদান নয় বরং তাদের খাতা-কলমও জুয়েল বিনে পয়সায় সরবরাহ করে।

এ স্কুলে যেসব শিশু পড়ালেখা করছে তারা কেউ ঝড়ে পড়া, কেউবা দারিদ্রতায় লেখাপড়া করতে হিমশিম খাচ্ছিল। বেশিরভাগ শিশুর বাবা মা-ই দিনমজুর বা দরিদ্রসীমার নিচে।

শিক্ষার্থী বাড়ার সাথে সাথে স্কুলে আরও দু’জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন জুয়েল। কলেজ ছাত্র জুয়েল টিউশনি করে যে  মাইনে পান তা দিয়ে এ স্কুলটি তথা বাকি দু’জন শিক্ষককে কিছু সম্মানী দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

জুয়েল বলেন, ক্রমশ শিক্ষার্থীর চাপ বাড়ছে। অসহায় অভিভাবক যখন বলেন, স্যার আমার টাকা-পয়সা নেই, বাচ্চাটা লেখাপড়া করাইতে পারছি না তাই আপনার স্কুলে নিয়ে আসছি, তখন না ভর্তি করে পারি না।

সুধী সমাজের ধারণা, প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে জুয়েলের উদ্যোগ একটি মডেল হতে পারে। হয়ত এদের মত উদ্যোমী যুবকেরাই একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবে।



প্রতিবন্ধীদের কথা ভেবে সংসার করলেন না রফিকুল

১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই টাঙ্গাইলে ঘাটাইল উপজেলার পাকপাড়া গ্রামে স্বাভাবিক শিশুর মতই জন্মগ্রহণ করেন মো. রফিকুল বারী খান। জন্মের দু’বছর পর পাকস্থলীর সমস্যার কারণে দেখা দেয় স্বাস্থ্যহীনতা। বাবা আব্দুর রহিম ভাবেন কৃমির কারণে এমন সমস্যা হচ্ছে তাই স্থানীয় বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসেন কৃমি নাশক ঔষধ। আর সেই কৃমিনাশক ওষুধই কাল হয়ে দাঁড়ায় রফিকুলের। ভুল চিকিৎসার কারণে নিভে যায় তার চোখের আলো।  

প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা সত্ত্বেও ৭০ দশকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার কোনো ভালো ব্যবস্থা না থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা  গ্রহণ করতে পারেননি। ১৯ বছর বয়সে গাজীপুরে প্রতিবন্ধীদের  ই.আর.পি এইচ প্রতিষ্ঠান থেকে কারিগরি শিক্ষা নেন। তৎকালীন বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের বদৌলতে ১৯৮৯ সালে মির্জাপুরে গোড়াইয়ে বস্ত্রমিলে চাকরি পান। ১৩ বছর চাকরি করার পর চলে আসেন ঘাটাইলে। ২০০৩ সালে ঘাটাইলে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘প্রতিবন্ধীদের সম্মলিত শিক্ষা কার্যক্রম প্রশিক্ষণ ও পুর্নবাসন’। ২৫ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু।

তিনি বলেন, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য অর্থনৈতিক সংকট ছিল বড় বাধা। নিজের আয় থেকে সামান্য সম্মানী দিতেন শিক্ষকদের। বর্তমানে স্কুলটি প্রতিবন্ধী মডেল স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

বর্তমানে স্কুলটিতে তিনতলা হোস্টেল ভবনের কাজ চলছে। অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে স্বাবলম্বী করার জন্য ইতিমধ্যে সাবেক জনতা ব্যাংকের ব্যাংকার বাবু প্রবীর চন্দ্র ভট্টাচার্যের সহযোগিতায় এটি গড়ে তোলেন যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১ হাজার। রফিকুল ইসলাম জানান, বর্তমানে হোস্টেল ভবনটি করতে গিয়ে আমি অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়েছি। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যদি ভবনটি নির্মাণে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করত তবে আমার স্বপ্নটাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারতাম। প্রতিবন্ধীদের কথা ভেবে সংসার জীবনের চিন্তা করেনি। তিনি মনে করেন বিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীই তার সন্তান।

 (ঢাকাটাইমস/ ২১ জানুয়ারি/ প্রতিনিধি/এআর)