ঢাকা: আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৮ সালে। সৌদি আরবে গড়ে ওঠা এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নিহত ওসামা বিন লাদেন। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ চলাকালে আফগানিস্তানের মুজাহিদিন ক্যাম্পে সংগঠনটি গড়ে ওঠে।
১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকসের সামরিক বাহিনী এবং আফগানিস্তানের কমিউনিস্টবিরোধী গেরিলাদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। সোভিয়েতদের উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ, এর মাধ্যমেই কেবল যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব ছিল। আফগানিস্তান তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দেশ ছিল। তাই এ অঞ্চলে একটি ব্রিজহেড স্থাপন করে মার্কিনরা অনায়াসেই সোভিয়েতদের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত সংস্পর্শ তৈরি করতে পারত।
সোভিয়েত আগ্রাসন যথারীতি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আলোড়ন তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আফগানিস্তানের ইসলামী প্রতিরোধ বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য একটি নতুন কর্মসূচি হাতে নেয়। যার নাম দেয়া হয় ‘মুজাহিদিন’। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯১-এ সোভিয়েত ইউনিয়েনের পতন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এই কর্মসূচির অধীনে আফগানিস্তানকে আনুমানিক ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য দেয়।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ‘জেনেভা অ্যাকর্ড’ স্বাক্ষরের মাধ্যমে ১৯৮৯ সালে এই যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। জেনেভা অ্যাকর্ডের পরও মার্কিন সরকার অ্যাকর্ডের শর্ত লঙ্ঘন করে জঙ্গিদের অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে। অ্যাকর্ড-পরবর্তী এই অস্ত্র সাহায্য জঙ্গিগোষ্ঠী গঠনের ভিত্তি তৈরি করে। এই সাহায্যের মাধ্যমেই আফগানিস্তানে জঙ্গিগোষ্ঠী বিকশিত হয়। একই সঙ্গে, আরব বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের সাহায্য আসার পথটাও সহজ হয়। ওই সময়ে গঠিত এসব ইসলামী মৌলবাদী দলগুলোর মধ্যে আল-কায়েদা অন্যতম।
যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর তালেবান নামক সংগঠনটিকে কাছে টেনে নেন বিন লাদেন। তালেবান হয় আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্রে মাটিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা ছিল সেটি। পরে একই বছরের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র।
যুদ্ধের প্রথম বছরই মার্কিনরা দেশটিতে অবস্থানরত আল-কায়েদা ও তালেবান জঙ্গিদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু দেশটির সীমান্তবর্তী বিভিন্ন উপজাতি এলাকায় আশ্রয় নিয়ে এবং দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা গেড়ে জঙ্গিরা বিচ্ছিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে যায়। মার্কিনদের প্রধান লক্ষ্য ওসামা বিন লাদেন যুদ্ধের শুরু থেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। প্রায় ৯ বছর পর ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনের অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ২০১১ সালের ২ মে মার্কিন কমান্ডোদের হাতে নিহত হন ওবামা।
লাদেনের মৃত্যুর পর ২০১১ সালে আল-কায়েদা প্রধান হন আয়মান আল জাওয়াহিরি। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইয়েমেন ও সৌদি আরবের ইসলামি জিহাদিদের নিয়ে আরব উপসাগরীয় আল-কায়েদা গঠিত হয়। আল-কায়েদা ইন দ্য অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা (একিউএপি) নামের ওই সংগঠনটিতে আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত জিহাদিরা যোগ দেয়। একিউএপির শীর্ষ নেতা আনোয়ার আল আওলাকি ২০১১ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। বর্তমানে একিউএপির প্রধানের দায়িত্বে আছেন নাসির আল ওয়াহাসাহি।
একিউএপি সংগঠনটি ইয়েমেনভিত্তিক হলেও আফ্রিকার প্রায় প্রতিটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক আছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে দীর্ঘ মার্কিন সামরিক অভিযানে এ অঞ্চলের আল-কায়েদা দুর্বল হয়ে পড়লে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। বর্তমানে আল-কায়েদার শাখা সংগঠনগুলোর মধ্যে একিউএপিই সবচেয়ে শক্তিশালী।
মার্কিন আগ্রাসনের বিপরীতে ২০০৩ সালে একটি সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী গড়ে ওঠে ইরাকে। ২০০৪ সালে ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদার সঙ্গে এ জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা জানান দেয়। ইরাকি আল-কায়েদা সংগঠনটি জিহাদি সংগঠন আল-কায়েদা নামে আত্মপ্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র্রবিরোধী হামলায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছে ১০ বছর ধরে। ২০০৬-০৭ সালে এ সংগঠনটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালায়। ২০০৮ সালে মার্কিন হামলায় দুর্বল হয়ে পড়ে ইরাকি আল-কায়েদা। তবে ২০১৩ সালে ইরাকি আল-কায়েদার হামলায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে দুটি কারাগার ভেঙে বন্দি মুক্তির দায় স্বীকার করেছে সংগঠনটি।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় সেখানেও আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছে আল-কায়েদা। আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরি সিরিয়াকে ইসলামিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ইরাক সরকার সিরিয়ার আল নূসর ফ্রন্টকে সমর্থন দিয়েছে যেন সেখানেও একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আল নূসর ফ্রন্ট ইরাক সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ঘোষণা দিয়েছে তারা আল-কায়েদার অঙ্গসংগঠন।
অনেক আগে থেকেই পূর্ব আফ্রিকায় আল-কায়েদার নেটওয়ার্ক সক্রিয়। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাইরোবি ও দারুস সালাম দূতাবাসে হামলা চালায় সেখানকার আল-কায়েদা গোষ্ঠী। এসব হামলার জন্য মিসর, সুদান, কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, কমোরাস ও সৌদি আরব থেকে জিহাদিদের ভাড়া করা হয়। এসব জিহাদির অনেকেই সোমালিয়ায় গোপন প্রশিক্ষণ নেয়। মধ্য ও দক্ষিণ সোমালিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে সেখানকার জঙ্গি সংগঠন আল শাবাব। ২০১২-তে আল শাবাব ঘোষণা দেয় তারা আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন। ২০১০ সালে এ সংগঠনটি উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় হামলা চালায় যাতে ৭৬ জন মানুষ নিহত হয়। সম্প্রতি সেখান থেকে আল শাবাবকে উৎখাত করলেও এখনো অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ আছে।
উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার বিশাল মরু অঞ্চল বিশেষ করে সাহারা মরুভূমি ও সাহেল মরুভূমি ইসলামী জিহাদিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আল-কায়েদার শাখা ইসলামী মাগরেব এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। ইসলামী মাগরেবের উত্থান ভূমি আলজেরিয়া হলেও সাহারা মরুভূমির কল্যাণে সংগঠনটি মালি ও নাইজারে আস্তানা গড়তে সক্ষম হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৯০-এর দশকে আলজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ইসলামী মাগরেব জিহাদি গোষ্ঠীর জন্ম। এ সংগঠনের নেতা আবু মোসাব আবদেল ওয়াদুদ। এ সংগঠনের আরেক নেতা মোক্তার বেলমোক্তারের নেতৃত্বে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আলজেরিয়ার ইন অ্যামেনাস গ্যাসক্ষেত্র হামলা হয় এবং এতে ৬৯ জন মানুষ মারা যায়।
এশীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে আল-কায়েদা গোষ্ঠী সক্রিয়। জেমাহ ইসলামিয়াহ সংগঠনটি ইন্দোনেশিয়ায় সক্রিয়, যারা ২০০২ সালে বালিতে মারাত্মক হামলা চালিয়েছিল। এদিকে ফিলিপাইনে আবু সায়্যাফ সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আছে, যারা আল-কায়েদার সঙ্গে পরে যুক্ত হয়ে লড়াই করছে। তারা মিন্দানাও ও সুলু দ্বীপে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
ইউনাইটেড ন্যাশনস সিকিউরিটি কাউন্সিল, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিসটেন্ট ফোর্সের মতো প্রতিষ্ঠান আল-কায়েদাকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আল-কায়েদার কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
(ঢাকাটাইমস/১৯ফেব্রুয়ারি/জেএস)