ভিয়েনায় রয়েছে সুসজ্জিত সব ভবন আর পার্ক। গণপরিবহন ছাড়াও সাইকেলের প্রভূত ব্যবহার শহরে প্রতিদিনের পরিবহনের খরচ সম্প্রতি ১ ইউরোতে নিয়ে এসেছে নগর কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া ১৭ লাখ বাসিন্দার এ শহরে গুরুতর অপরাধের ঘটনা বিরল। ভিয়েনা, লোয়ার অস্ট্রিয়া প্রদেশে উত্তর-দক্ষিণ,পূর্ব-পশ্চিমে উভয়দিকে ৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট সুন্দর, ছবির মতো সাজানো গোছানো একটি শহর। খ্রিষ্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতেই ভিয়েনার গোড়াপত্তন হয়। তবে ভিয়েনার আধুনিক নগর যাত্রার শুরু ৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে। এর বয়স ১০০০ বছরের বেশি হলেও এখনো এটি যেন চির নতুন এক শহর। ভিয়েনা মোট ২৩টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। একেকটি প্রশাসনিক অঞ্চল বাংলাদেশের একেকটি ইউনিয়ন পরিষদের মতো পরিসরের অথবা কোনো কোনোটি এর চেয়েও ছোট। এ প্রশাসনিক অঞ্চলগুলো করা হয়েছে ঠিক এভাবে, যেন যে কোনো সমস্যায় ৫ মিনিটের ভেতর পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড অথবা জরুরি বিভাগে কর্মরত ডাক্তাররা ওই এলাকায় যেতে পারেন। এখানে যদিও কেবল ভিয়েনার কথাই বলছি, পুরো অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক ধরনটা ঠিক ওরকম।
প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলের কাউন্সিলর ও ভিয়েনার মেয়র জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও কার্যত ভিয়েনার পুরো প্রশাসন পরিচালনা করেন প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলের সরকার নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটরা। প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলে ঠিক কতজন লোক বাস করছে তার সঠিক হিসাব এসব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রয়েছে। ভিয়েনায় রয়েছে রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা। ফলে কেউ বাসা পরিবর্তন, অন্য প্রদেশে বসবাস অথবা দেশান্তরী হতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতেই হবে।
উদাহরণস্বরূপ, কারো ছেলের কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সময় হয়েছে, তখন ম্যাজিস্ট্রেটরাই চিঠি দিয়ে জানাবেন, সে প্রশাসনিক অঞ্চলের কোন কিন্ডারগার্টেনে তার ছেলে বা মেয়েকে ভর্তি করাবেন। প্রসঙ্গত বলা দরকার, আমাদের বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেন এর মত নয় এখানকার কিন্ডারগার্টেন।
ভিয়েনার সব কিন্ডারগার্টেন সরকারি। বেসরকারি কোনো কিন্ডারগার্টেন নেই এখানে। সকাল ৭টা থেকেই বাবা মায়েরা সন্তানদের কিন্ডারগার্টেনে রেখে আসে। প্রতি ৮ বা ১০ জনের এক একটি শিশুদলের পরিচর্যার জন্য কিন্ডারগার্টেনে রয়েছে ফুফু অথবা খালাম্মারা। কিন্ডারগার্টেনে স্যার বা ম্যাডাম বলে কোনো শব্দ নেই। বাবা-মায়ের মতোই খুব যতœ ও আদরে সেখানে আনন্দ ও বিনোদনমূলক শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের ইচ্ছামাফিক খাবার ও পানীয় সরবরাহ করে সরকার বিনামূল্যে। কিন্ডারগার্টেনগুলোতে শিশুদের বেশিরভাগই শৃঙ্খলা শেখানোর চেষ্টা করা হয়। একটু বড় হলে ওই শিশুদের নেয়া হয় রাস্তায় ট্রাফিক লাইটের সংকেত চেনানো, সিনেমা হলে শিশুতোষ ছবি দেখানো এবং রাস্তাঘাটে উচ্চস্বরে কথা বলা অভদ্রতাÑ এসব শেখানো হয়। ভিয়েনাতে শিশুরা কিন্ডারগার্টেন এত উপভোগ করে যে বিকেলে বাসায় না ফেরার জন্য অনেক ছেলেমেয়েকে কান্নাকাটি করতেও দেখেছি।
কিন্ডারগার্টেন থেকে এরপর প্রাইমারি স্কুল হয়ে হাইস্কুল পর্যন্ত শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপারটা মা বাবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটরাই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেন।
এবার আসি যোগাযোগ ব্যবস্থার কথায়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিস্ময়কর এক অগ্রগতি সাধন করেছে। ভিয়েনায় চলাচলকারী বাস, ট্রেন, ট্রাম এবং আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেলÑ সবই সরকারি। ৩০ ইউরো দিয়ে একটি যাতায়াত কার্ড কেনার পর জনগণ সারা মাস ভিয়েনার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাতায়াত করতে পারে। ভিয়েনার যে কোনো প্রান্তে যাতায়াতের জন্য প্রতি ৫ মিনিট পরপর বাস, ট্রেন, ট্রাম ও মেট্রোরেলের ব্যবস্থা রয়েছে। বাস, ট্রেন, ট্রাম ও মেট্রোয় সাধারণত টিকিট চেকিং হয় না। জনগণ নিজ দায়িত্বেই টিকিট কেটে থাকেন। ভিয়েনায় রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ডÑ১, আন্ডারগ্রাউন্ডÑ২ এবং আন্ডারগ্রাউন্ডÑ৩ মেট্রোরেল, যার মাধ্যমে পুরো শহরকে অতি অল্প সময়ে যানজটহীন দ্রুত যাতায়াতের এক শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করেছে।
এবার আসি নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথায়। অস্ট্রিয়ায় গুরুতর অপরাধ অথবা খুনোখুনির ঘটনা একেবারেই বিরল বলা চলে। অন্যভাবে বলা যায়, অস্ট্রিয়া একটি পুলিশি রাষ্ট্র। পুলিশ কঠোর হস্তে এখানে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে। ভিয়েনার প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে এক একটি থানা। সে সব থানা কর্তৃক রয়েছে সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা। রয়েছে ওয়াটার পুলিশ, যারা ভিয়েনার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত দানিয়ুব নদীতে টহল দিচ্ছে প্রতিদিন। রয়েছে আকাশ থেকে হেলিকপ্টার যোগে শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে নিরাপত্তা তল্লাশি। এছাড়া ভিয়েনার ওয়াটার পুলিশ কর্তৃক প্রতি সপ্তাহে একবার করে ডুবুরি দিয়ে দানিয়ুব নদীর তলদেশ তল্লাশির ব্যবস্থা রয়েছে। ভিয়েনায় যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় পুলিশকে ৩ থেকে ৫ মিনিটের ভেতর হাজির হতেই হবে। দ্রুততম সময়ের ভেতর উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রতিটি পাড়ায় এক একটি থানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৩ থেকে ৫ মিনিটের ভেতর হাজির হতে না পারলে রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা। পুলিশের জন্য রয়েছে সার্বক্ষণিক মানসিক ডাক্তার, যাদের কাজ হচ্ছে পুলিশদের চাঙ্গা রাখা। যাতে কোনো ব্যর্থতায় অথবা অসফল অপারেশনের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে না যায়।
পুলিশ হচ্ছে অস্ট্রিয়ায় সবচেয়ে সম্মানিত চাকরি। স্কুল কলেজগুলোতে শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের চাকরি হচ্ছে পুলিশ। গত বছর জনমত জরিপে জনবিশ্বাসের দিক থেকে অস্ট্রিয়ার পুলিশ ১ নম্বরে, বিচারবিভাগ ২ নম্বরে এবং রাজনীতিকগণ ৩ নম্বরে স্থান পেয়েছেন।
দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ বিবদমান কোনো পক্ষ থেকে অথবা বাইরের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ১ গ্লাস পানি পান করাও দ-নীয় অপরাধ। চা, কফি পান অথবা টাকা-পয়সা নেয়া তো দূরের কথা। আইন এখানে গরিব, ধনী সবার জন্য সমান।
দায়িত্ব পালন ব্যতিরেকেও পুলিশ তার অবসরে অথবা ছুটির সময়ে কারো কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিতে পারবে না। পুলিশের কনস্টেবল থেকে অফিসার সবার বেতন ১৫০০ থেকে ২০০০ ইউরোতে বাঁধা। বেতনের বাইরে এক কানাকড়িরও পুলিশ এখানে প্রত্যাশা করতে পারে না।
পুলিশি নিরাপত্তার বাইরে ভিয়েনায় রয়েছে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। প্রতিটি হাসপাতাল এখানে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে চলেছে রোগীদের।
ভিয়েনা তো বটেই বরং অস্ট্রিয়ার সব হাসপাতালে রয়েছে সর্বাধুনিক হেলিকপ্টার অ্যাম্বুলেন্স। ভিয়েনার যে কোনো স্থানে যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় প্রতি ৫ মিনিটের ভেতর রোগীর কাছে ডাক্তারকে পৌঁছাতে হবে। না হলে জরুরি বিভাগ এবং দুর্ঘটনা বিভাগের ডাক্তার ও নার্সদের চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা রয়েছে।
ভিয়েনায় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অথবা ডায়াগনোসিসের জন্য ডাক্তারদের কোনো ফি দিতে হয় না জনগণকে। ফার্মেসি থেকেও ওষুধ কিনতে হয় না নিজের খরচে। রাষ্ট্র এখানে স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে নিশ্চিত করেছে।
যে কোনো কারণেই হোক না কেন ভিয়েনায় ডাক্তাররা রোগীর অথবা রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অসংযত আচরণ করতে পারবে না। ব্যবস্থাপত্র দেয়ার আগে রোগীর কেস হিস্ট্রি অথবা চিকিৎসা-ইতিহাস শুনতে হবে ডাক্তারকে নিরুদ্বিগ্ন হয়ে।
এমনকি চিকিৎসাধীন থাকা ডাক্তারের চিকিৎসা-মান নিয়ে সরাসরি অসন্তুষ্ট রোগীকে জিজ্ঞেস করতে হবে, সে অন্য কোনো ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে আগ্রহী কি না? তাছাড়া সিরিয়াল দেয়া রোগীদের নির্ধারিত সময়ের দশ থেকে পনেরো মিনিটের বেশি বাইরে বসিয়ে রাখা হয় না।
এবার আসা যাক ভিয়েনার ডাক্তারদের চিকিৎসা আর সেবার কথায়। ভিয়েনায় বেশিরভাগ ডাক্তারই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে না। দু’একজন করলেও রোগীরা ব্যবস্থাপত্র নেয় না ওসব ডাক্তারের। ফলে সরকারি চাকরিতেই ফিরে আসতে হয় ডাক্তারদের শেষ পর্যন্ত। একজন ডাক্তার তৈরি করতে সাধারণ জনগণের বিপুল অঙ্কের করের টাকা ব্যয় হয় বলে ওখানকার ডাক্তাররা সনদ অর্জন শেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতেই ফিরে আসেন চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য। আমাদের দেশের মতো ক্লিনিক ব্যবস্থা ভিয়েনায় নেই। ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান সুবিধা নিয়েই সদা-উন্মুক্ত সরকারি হাসপাতালগুলো।
এছাড়া ভিয়েনায় নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড। সড়ক দুর্ঘটনা অথবা অগ্নিকা-স্থলে ৫ মিনিটের ভেতর ফায়ার ব্রিগেড কর্মীদের পৌঁছাতে হবেই। না হলে রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা। তবে ভিয়েনায় বাড়িঘরে সাধারণত আগুন লাগে না। কারণ প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড এবং সেসব ফায়ার ব্রিগেডে রয়েছে প্রতিটি বাড়ি বা দোকানের নম্বরধারী অগ্নিনির্বাপন সফটওয়্যার। কোনো বাসা বা বন্ধ দোকানে আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকলে ফায়ার ব্রিগেড স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানতে পারে ইলেকট্রনিক সংকেতের মাধ্যমে। জনগণকে ফোন করে ফায়ার ব্রিগেডে খবর দেয়ার কোনো দরকার হয় না।
সব ক্ষেত্রেই এমন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবত রয়েছে ভিয়েনায়, যা চোখে না দেখলে লেখা পড়ে আন্দাজ করা কঠিন। আর এ নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ভিয়েনাকে আজ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভেতর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করেছে।
অস্ট্রিয়া প্রবাসী গবেষক ও গল্পকার।