ঢাকা: ইসলামী আইন-কানুন ও আচার-আচরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো হালাল ও হারামের বিধিবিধান। কুরআন হাদীসে এ ব্যাপারে বিস্তারিত দিকনিদের্শনা এসেছে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে যে সকল কাজের অনুমতি রয়েছে এবং সে সম্বন্ধে কোন নিষেধবাণী নেই তাকে হালাল বা বৈধ বলে। এটি হারামের বিপরীত। হালাল দ্রব্যাদি এ দুনিয়ায় অফুরন্ত যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। পক্ষান্তরে, হারাম দ্রব্য সীমিত। এরপরও বহু মানুষকে দেখা যায় হালাল বাদ দিয়ে হারাম দ্রব্যাদির দিকে নাক গলাতে। বস্তুত হারাম তো তাই যা ধর্মীয়ভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
মানবজীবনে হালাল বস্তু গ্রহণের ফায়দা ও উপকারিতা অপরিসীম। শরীয়ত মানুষের কল্যাণই চায়। আমরা যে সকল বস্তু খেয়ে থাকি তার সার পদার্থ আমাদের দেহের শিরা- উপশিরায় পৌঁছে দেহকে সবল ও সতেজ করে। হারাম খাদ্য ও পানীয় বস্তুতে এমন কিছু উপাদান আছে যা মানুষের সুস্থ মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটায় এবং উন্মাদনা সৃষ্টি করে, স্মৃতিশক্তি লোপ করে দেয়। কাজেই ওসব আহার্য আমাদের জন্য সম্পূর্ণ অবৈধ। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণার দ্বারা হিংস্র্র প্রাণীর দেহে এমন সব জীবাণু আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলো মানবদেহের পক্ষে ক্ষতিকর। কাজেই এসব প্রাণীও আমাদের জন্য হালাল হতে পারে না। ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যাপারগুলো তিন পর্যায়ের : হারাম, মাকরুহ তাহরীমী, মাকরুহ তানজীহী। মাকরুহ অর্থ খারাপ বা নিন্দনীয়। তাহরীমী অর্থ হারামকারী অর্থাৎ যে মাকরুহ হারামের কাছাকাছি। যে সকল কাজ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই, তবে কোন কোন হাদীসে এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাকে মাকরুহ তাহরিমী বলে। যে সকল কাজ শরীয়তের দৃষ্টিতে ঘৃণাজনক কিন্তু এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ কোন নিষেধাজ্ঞা নেই বরং পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাকে মাকরুহ তানজীহী বলে। আদর্শ মুসলমানগণ মাকরুহ তানজীহীও পরিত্যাগ করেন।
হালাল-হারামের বিধান দিতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, হে মানবমন্ডলী, পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ কর আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো এ নির্দেশই তোমাদের দেবে যে, তোমরা অন্যায় ও অশ্লীল কাজ করতে থাকো এবং আল্লাহর প্রতি এমন সব বিষয়ে মিথ্যারোপ করো যা তোমরা জান না। আর যখন তাদের কেউ বলে যে, সেই হুকুমেরই আনুগত্য কর যা আল্লাহতায়ালা নাযিল করেছেন, তখন তারা বলে কখনও না, আমরা তো সেই বিষয়েরই অনুসরণ করব যাতে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের দেখেছি।
যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানত না, জানত না সরল পথও। বস্তুত এহেন কাফেরদের উদাহরণ-এমন যেন কেউ এমন জীবকে আহ্বান করছে-যা কোন কিছুই শোনে না, হাঁকডাক আর চিৎকার ছাড়া, বধির, মূক এবং অন্ধ। সুতরাং তারা কিছুই বোঝে না। হে ঈমানদারগণ, তোমরা পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার করো যেগুলো আমি তোমাদের রুজী হিসেবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর। (সূরা বাকারা)
‘হাল’ বা হালাল শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো গিট খোলা। যেসব বস্তুসামগ্রীকে মানুষের জন্য হালাল বা বৈধ করে দেয়া হয়েছে তাতে যেন একটা গিট খুলে দেয়া হয়েছে এবং সেগুলোর উপর থেকে বাধ্যবাধকতা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। হযরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, মুক্তি বা পরিত্রাণ লাভ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল : ১. হালাল খাওয়া, ২. ফরজ আদায় করা এবং ৩. রাসূলে করীমের (স) সুন্নাতসমূহের আনুগত্য ও অনুসরণ করা। (মা’আরিফ-অখ--৮৪)।
সূরা বাকারার উদ্ধৃত আয়াতে যেমন হারাম খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে হালাল ও পবিত্র বস্তু খেতে এবং তা খেয়ে শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কেননা, হারামে মন্দ অভ্যাস সৃষ্টি হয়, ইবাদতে আগ্রহ স্তিমিত হয়ে যায় এবং দোয়া কবুল হয় না। হালাল খানায় অন্তরে এক প্রকার নূর সৃষ্টি হয়, যার মাধ্যমে অন্যায়-অসচ্চরিত্রতার প্রতি ঘৃণাবোধ এবং সততার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়; ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি অধিকতর মনোযোগ আসে, পাপের কাজে মনে ভয় আসে এবং দোয়া কবুল হয়। এ কারণেই আল্লাহতায়ালা তাঁর সমস্ত নবী-রাসূলগণের প্রতি হেদায়েত করেছেন যে, ‘ইয়া আয়্যুহার রুসুলু কুলু মিনাত্ তোয়াইয়্যেবাতি ওয়া’মিল সোয়ালিহা’-আমার রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র খাদ্য গ্রহণ কর এবং নেক আমল কর।’ পবিত্র মাহে রমজানে আমাদের সাহরী ও ইফতার গ্রহণে হালাল হারামের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার তাগিদ করা হয়েছে।
অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক