মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
ঢাকা: ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (বিবিএ) পড়েন কামরুল হাসান। তিনি দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়েন। বিবিএ শেষ করতে তাকে গুনতে হবে ৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। প্রতি সেমিস্টারে তাকে দিতে হয় ৪৯ হাজার টাকা। ছয় মাসে সেমিস্টার।
তবে এ বছর যারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হবেন তাদেরকে দিতে হবে সাত লাখেরও বেশি টাকা।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অনার্স করতে খরচ হয় ছয় লাখ টাকা। নতুন যারা ভর্তি হবে তাদেরকে গুণতে হবে বাড়তি আরও এক লাখ টাকা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে স্নাতক করতে হলে তাকে মোট ব্যয় করতে হবে আট লাখ টাকা। নতুনদের জন্য এই সংখ্যা নয় লাখের কাছাকাছি।
এই চিত্র দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-লেখা করতে হলে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়। প্রতি বছরই আবার টাকা অঙ্ক বাড়ানো হয়।
কিন্তু কেন ফি বাড়ছে এর কোনো সদুত্তর নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কথাও বলতে চায় না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট আরোপের পর খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সম্প্রতি আন্দোলনে নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই ভ্যাট শিক্ষার্থীদেরকে নয়, দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, সরকারের এমন ব্যাখ্যার পরও পিছু হটেনি ছাত্ররা। ছাত্রদের আশঙ্কা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা অযুহাতে তাদের কাছ থেকেই এই টাকা আদায় করে নেবে এবং এ কারণে তাদের শিক্ষার ব্যয় বেড়ে যাবে।
ভ্যাট ইস্যুতে অতিরিক্ত টাকা বাড়ার আশঙ্কায় ছাত্ররা আন্দোলনে নামলেও প্রায় প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষা ব্যয় বাড়ার বিষয়ে অনেকটাই নীরব তারা। এর একটি কারণ হচ্ছে, ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর কারও খরচ বাড়ে না। এ কারণে পরের ব্যাচের খরচ বাড়লেও এ নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। আর ভর্তি হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে হিসাব জেনে তা মেনেই ভর্তি হয় ছাত্ররা।
আয়-ব্যয়ের হিসাবে গোঁজামিল
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়-ব্যয়েরও কোনো নির্ভরযোগ্য হিসাব নেই। নামমাত্র হিসাব রাখলেও তা আয়-ব্যয় সমান করে দেখায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাভ বেশি হলেও হিসাব দেখায় কম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব অস্পষ্ট। মালিক পক্ষ টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। আমরা মালিকের নির্দেশ মতো হিসাব করি। আয়-ব্যয় সমান দেখিয়ে দেই। কিছু করার নেই। কারণ মালিক পক্ষের সঙ্গে সু-সম্পর্ক না থাকলে চাকরি থাকবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আয়-ব্যয়সহ শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠায়। এতে দেখা যায়, ২০১৩ সালে ৬৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আয় হয়েছিল এক হাজার ৯৬৪ কোটি ২৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ২৯ কোটি ৭৬ লাখ ২১ হাজার টাকা। হিসাবে দেখা যায়, এক হাজার ৯৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা লাভ হয়েছে।
এ অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির। আয়ের পরিমাণ ১৭২ কোটি ৭৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয় করেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। আয়ের পরিমাণ ১৩৭ কোটি ২১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ আয় করেছে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। আয়ের পরিমণ ১০১ কোটি ৭৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন আয় করেছে খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়। আয়ের পরিমাণ ১২ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
তবে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক এর ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘আইনে বলা আছে-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে যে টাকা আয় হবে তা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। সেই কাজটিই করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ’। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আয়-ব্যয় নিয়ে অডিট হয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষান্ত্রণালয়কে তিনটি ভাল অডিট ফার্মের নাম পাঠাতে হয়। এখান থেকে শিক্ষামন্ত্রণালয় তাদের পছন্দ অনুযায়ী অডিটর ঠিক করে দেয়। এরপর তারা অডিট করে। এখানে অনিয়ম হওয়ার সুযোগ কোথায়?’।
তবে ইউজিসি বলছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানছে না অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু স্বার্থের বিষয়টি আসলেই কেবল মেনে চলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
ইউজিসি এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে সুপারিশও দিয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়ে। তারা প্রতিবেদনে বলেছে, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয় সংক্রান্ত নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় আইনানুযায়ী আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ করছে না বলে কমিশন জানতে পেরেছে। এছাড়া বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফি, টিউশন ফি এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য বিষয়ে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া ট্রান্সক্রিপ্ট, সার্টিফিকেট, প্রশংসাপত্র ইত্যাদি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে উচ্চহারে ফি নিয়ে থাকে। কোনো ধরনের যৌক্তিক কারণ ব্যতিরেকেই টিউশন ফি ও ভর্তি ফি বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে’। প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সহজলভ্য ও গরিব মেধাবি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা লাভের পথ সুগম করা অত্যাবশ্যক বলে মতামত দেয়া হয়।’
ইউজিসির এই সুপারিশ থোরাই কেয়ার করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তারপরেও ইউজিসি কার্যকর কিছু করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি নির্ধারণের বিষয়ে ইউজিসির কিছুই করণীয় নেই বলে জানিয়েছে কমিশন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা ইউজিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কমিশনের সুপারিশ করার ছাড়া আর কোনো ক্ষমতা নেই।’
(ঢাকাটাইমস/১৭সেপ্টেম্বর/এমএম/ডব্লিউবি)