গ্যাসের দাম বাড়ায় অটোরিকশার ভাড়া আবার বাড়ল। মালিক-শ্রমিকদের আবদারে একলাফে প্রায় দ্বিগুণ করা হলো ভাড়া। কিন্তু জানা গেল না, ভাড়া বাড়ার পরও তারা আইন অনুযায়ী মিটারে চলবেন কি? যাত্রীদের ইচ্ছামতো গন্তব্যে যাবেন কি? বাড়ল বাসভাড়াও। কিন্তু জানা হলো না, যে হারে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি হারে কেন এখনই যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। জানা গেল না প্রশাসনের হাত এত লম্বা থাকলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা কেন যাত্রীদের জিম্মি করে যাচ্ছেন। জানা হলো না, বারবার হুঁশিয়ারি দিলেও সরকার কেন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ভাড়া বাড়ার পর অটোরিকশা মালিক- শ্রমিকরা আইন মেনে চলার অঙ্গীকার করেছেন। আইন না মানলে কঠোর সাজা পেতে হবে, মিটারে না গেলে নিবন্ধন বা রুট পারমিট বাতিল হবে প্রশাসন এমন হুঁশিয়ারিও দিয়েছে বারবার। কিন্তু কার্যত আরো বেপরোয়া হয়েছে অটোরিকশা চালকরা। সরকার নির্ধারিত ভাড়া যাই হোক না কেন, চালকদেরকে চুক্তি অনুযায়ী মেটাতে হয় ভাড়া। আবদার আরও আছে। অটোরিকশা মিটার চলবে, কিন্তু এতে ভাড়া কত উঠবে তা অবান্তর। কারণ আপনি আগেই ঠিক করে নিয়েছেন তাকে কত টাকা দেবেন। পথে পুলিশ ধরলে আবার আপনাকে মিথ্যা বলতে হবে যে, গাড়ি চলছে মিটারে। ঝুঁকি নিয়ে বলে ফেলা যায়, অটোরিকশার ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হলেও সেই একই ভোগান্তি থাকবে যাত্রীদের।
সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজির দাম ইউনিটপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা করার পর অটোরিকশার ভাড়া কেন একলাফে দ্বিগুণ হলো তার ব্যাখ্যা দেয়নি সরকার। প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ২৫ টাকা থেকে করা হয়েছে ৪০ টাকা। পরের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ৭ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে করা হয়েছে ১২ টাকা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলছেন, নতুন এই ভাড়া কার্যকর হবে কোরবানির ঈদের পর। এর মধ্যে অটোরিকশার মিটার মেরামত করতে হবে। সরকারের সঙ্গে বৈঠকে আইন মেনে অটোরিকশার মালিক-শ্রমিকরা মিটারে চলার অঙ্গীকার করেছেন বলেও জানান মন্ত্রী। আগের মতোই হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি, মিটারে না চললে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভাড়া বেড়েছে বাসেরও। প্রতি কিলোমিটারে ১০ পয়সা। যে প্রস্তাব দিয়ে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়েছে তাতে যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে পরিবহন মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে। সরকার তা যাচাই বাছাই না করেই বাড়িয়েছে ভাড়া। বাস ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবে দেখানো হয়েছে, ঢাকায় প্রতিটি বাসে প্রতি ট্রিপে যাত্রী হয় আসনের ৮০ শতাংশ। ছুটির দিনেও যেখানে যাত্রী বোঝাই হয়ে থাকে, সেখানে এই কথা সত্য ধরে নিয়ে বাস ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার।
অটোরিকশার মতোই বাস ভাড়ায়ও আছে নৈরাজ্য। ন্যূনতম সেবাও পায় না যাত্রীরা। প্রতিটি বাসে গরমের দিন ঠেসে তোলা যাত্রীর কারণে হাঁস-ফাঁস অবস্থা হয় প্রায় সবাই। মোড়ে মোড়ে যাত্রীর জন্য হাঁকডাকের কারণে বিরক্তি নিয়েই চলতে বাধ্য হয় যাত্রীরা। আর নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেওয়া হয় নানা অজুহাতে।
রাজধানীতে হিসাব করলে দেখা যায়, নতুন যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে সরকার, বাস বা অটোরিকশায় আগে থেকেই এর চেয়ে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। যাত্রীদের সঙ্গে প্রকাশ্য প্রতারণা হলেও চোখ বুঁজে আছে পুলিশ বা বিআরটিএ।
এসব নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে শ্রমিকদের বাকবিতণ্ডা, হাতাহাতি ঘটলেও সমাধান মেলে না।
চালকদের অজুহাতের শেষ নেই
মিটারে চলবে, এমন অটোরিকশা কই ঢাকায়? এরপর শুরু হয় মিটার টেম্পারিং। মিটার ছাড়াই ইচ্ছানুযায়ী তিনগুণ-চারগুণ ভাড়ায় চলাচল শুরু হয়। শুরুর দিকে মিটার খারাপ বলে ১০ বা ২০ টাকা বেশি দাবি করত চালকরা। পরে ধীরে ধীরে মিটার চালু করে চুক্তিতে চলাই নিয়ম বানিয়ে ফেলেছেন চালকরা।
তারেক নামে এক বেসরকারি চাকুরে মোহাম্মদপুর থেকে তেজগাঁও তার অফিসে যাবেন। ছয় কিলোমিটার সড়কের জন্য অটোচালক ভাড়া দাবি করে বসলেন ২৫০ টাকা। কোনোভাবেই কমাতে রাজি করাতে না পেরে চেপে বসলেন গাড়িতে। অফিসে গিয়ে দেখলেন, যানজটে আটকে থাকার জন্য অপেক্ষার ভাড়াসহ মিটারে ৮০ টাকা উঠেছে।
এর মধ্যেই মালিক ও চালকদের দাবির পর কয়েক দফা বাড়ানো হয় অটোরিকশার ভাড়া। কিন্তু ভোগান্তি কমেনি যাত্রীদের। চালকদের অভিযোগ, দৈনিক ৬৫০ টাকা জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও কোনো মালিকই তা মানেন না। তাই যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিতে বাধ্য হন তারা। এবার এ কারণে মালিকদের জমা ৬৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০০ টাকা করেছে সরকার। আর এ জন্য ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু চালকরা কি সুপথে ফিরবেন?
আবদুর রশিদ নামে এক চালক বললেন, ‘আমাগো কথা পরিষ্কার। জমা কমলে মিটারে যাব। না হলে এখন যেমন চলছে এভাবেই চলবে।’ পাশে দাঁড়ানো অন্য একজন তার কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘গাড়ির চাহিদা বেশি এই সুযোগে টাকা বেশি নেয় মালিকরা। ড্রাইভারদের বেশি টাকা দিয়ে গাড়ি না নেওয়া ছাড়া উপায় আছে?’
বাসেও নানা অজুহাতে যাত্রীর পকেট কাটা
নগরীতে দুই ধরনের বাসের সরকার নির্ধারিত ভাড়া দুই রকম। বড় বাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৬০ পয়সা আর মিনিবাসের এক টাকা ৫০ পয়সা। বড় বাসের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ভাড়া সাত টাকা আর ছোট বাসের সর্বনি¤œ পাঁচ টাকা।
কিন্তু বড় বাসে সাত টাকা নেওয়া হয় না কোথাও। সর্বনি¤œ ১০ টাকা আর যাত্রীদের সিটিং বা ডাইরেক্টের ফাঁদে ফেলে সংক্ষিপ্ত পথেও পুরো পথের ভাড়া দিতে বাধ্য করে মালিক-শ্রমিকরা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বাড়বে ১০ পয়সা। কিন্তু ন্যূনতম ভাড়া বাড়ানোর আবদার মেনে নেয়নি সরকার। তবে কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, অটোরিকশার মতোই সরকার নির্ধারিত ভাড়া নেওয়া হয় না বাসেও। যদিও এসব দেখার যেন কেউ নেই।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ভাড়া বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এই সিদ্ধান্ত যাত্রীদের স্বার্থবিরোধী হয়েছে। যেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে সেগুলো মিথ্যা। এছাড়াও ভাড়া পুনঃনির্ধারণ কমিটিতে যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি ছিল না।
মিথ্যা তথ্যগুলো কি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে দেখানো হয়েছে ঢাকার রাস্তায় যে গাড়িগুলো চলে সেগুলো নতুন। কিন্তু বিগত কয়েক বছর রাজধানী এবং চট্টগ্রামে নতুন কটি গাড়ি নামানো হয়েছে? এছাড়াও মালিকরা দাবি করছেন, তারা প্রত্যেক বছর চালক-শ্রমিকদের বেতনের পাশাপাশি বোনাসও দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই দাবিতে সত্যের লেশমাত্রও নেই। রাজধানীর বেশির ভাগ গাড়ি চলে চুক্তিভিত্তিক।
তবে বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা কিলোমিটারপ্রতি ১৫ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর দাবি করেছিলাম। কিন্তু যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম।’
অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া থামবে কি?
সরকার নির্ধারিত ভাড়া পরিবহন মালিক ও চালক-শ্রমিকরা মানবেন কি না জনমনে শঙ্কা রয়ে গেছে। গণপরিবহনে চলাচল করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আশিক আহমেদ বলেন, ‘যতই বলা হোক যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া গুনতেই হবে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শুরুর দিকে কদিন মিডিয়ার নজর থাকবে এ নিয়ে। বিআরটিএ হয়ত ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাবে। এরপর শুরু হবে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়। কোনো বড় বাসে এখন সাত টাকার টিকিট আছে?’
পুলিশের দাবি, যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে তারা যথেষ্ট চেষ্টা করেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া নেওয়ার অপরাধে আমরা অনেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু জরিমানার পরও তারা পুরনো পথে ফিরে যায়। তবে এর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলবে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী মাসে নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। তখন কেউ অতিরিক্ত ভাড়া নিলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
আর বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে এমন অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’ তিনি বলেন, ‘সিএনজি চালিত মোটর গাড়ি যদি মিটারে না যায় বা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে তাহলে যাত্রীরা যেন আমাদের কাছে অভিযোগ করে। এই ক্ষেত্রে যাত্রীকে অবশ্যই গাড়ির নম্বর এবং সময় উল্লেখ করতে হবে।’
অতিরিক্ত ভাড়া তো এখন নেওয়াই হয়, তাহলে কেন তা ঠেকানো যাবে না, এ প্রশ্নের কোনো জবাব কিন্তু সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাই দিতে পারেননি। বিআরটিএর জবাব, তাদের কাছে প্রতিকার চেয়ে কেউ অভিযোগ করে না। আর যাত্রীদের অভিযোগের প্রতিকার করতে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমাণ দল আছে তাদের। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।