logo ২৪ এপ্রিল ২০২৫
নিরাপত্তার জুজু

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
১৪ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:১৫:৩৮
image

যেন এক ভয়ঙ্কর জায়গা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে পশ্চিমাদের মনে নিরাপত্তা শঙ্কা এতটাই জেঁকে বসেছে যে, এ দেশে আসতেই দুইবার ভাবতে হচ্ছে তাদের। সফর বাতিল করেছে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল, আসবে না জানিয়েছে দেশটির ফুটবল দলও। সময় মতো আসছে না সাউথ আফ্রিকার নারী ক্রিকেট দলও। এ সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ঢাকায় এক ইতালীয় এবং রংপুরে জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনাটি যেন আগুনে ঘি ঢালে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, পশ্চিমাদের এই শঙ্কা কেন? এর পেছনে কী যুক্তি আছে। তারা যখন নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত তখন ঢাকায় ফুটবল খেলছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হওয়া উজবেকিস্তান, খেলছে ভুটান, শ্রীলঙ্কাও। তারা ভয় পায়নি এতটুকু। স্টেডিয়ামে আসা-যাওয়ার পথে এমন বাড়তি কোনো নিরাপত্তা তাদের দেওয়া হচ্ছে তাও নয়।


১৬ কোটি মানুষের একটি অংশ প্রতিদিনও এখান থেকে সেখানে যাতায়াত করছে। মাঝেমধ্যে দুর্বৃত্তদের হামলা হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু সংঘবদ্ধ পরিকল্পিত হামলায় প্রাণহানি বা জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মতো ঘটনা গত এক দশকে কটি ঘটেছে? পশ্চিমারা সরাসরি না বললেও তাদের উদ্বেগ যে ধর্মভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী নিয়ে তা বুঝতে বাকি নেই। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদীদের তৎপরতা একেবারে নেই সেটা বলা যাবে না। তবে তা একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, সেটা বলার কোনো সুযোগ নেই।


এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশকে নিয়ে ভয় কি জুজু? পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা কোনো সংগঠিত শক্তির কাজ কি না, সেটা তদন্তে প্রমাণের বিষয়। কিন্তু কেবল এই দুটি ঘটনা দিয়ে সরকারি হিসাবেই দেশে বসবাসরত প্রায় দুই লাখ বিদেশির নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। তবে বিষয়টি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য ভাবমূর্তির প্রশ্ন। এই দুটি খুনের সুরাহা হলে পশ্চিমাদের আস্থা ফেরাবে নিশ্চিতভাবেই। আর যদি এর সুরাহা না হয় তবে আস্থার সংকট তৈরি হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও তা অশনি সংকেত হতে পারে। সরকার অবশ্য বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে।


কোন দিক থেকে অনিরাপদ বাংলাদেশ?    


৮০’র দশকে আফগানিস্তাকে রুশ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মুজাহিদদের সঙ্গে লড়াইয়ে বাংলাদেশ থেকেও গেছে কেউ কেউ। সেই থেকে শুরু। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতার পর সেখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তৈরি দল-উপদলের একটি অংশ লোক সংগ্রহ ধর্মকে পুঁজি করে এগিয়ে যায়। উদ্ভব ঘটে ধর্মভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীর।


৯০ দশকের শেষ দিকে আফগানিস্তানেই মাদ্রাসাভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন তালেবান ক্ষমতার লড়াইয়ে সামনের সারিতে চলে আসা, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মদদ আর ২০০১ সালে সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল কায়দা দৃশ্যপটে আসার পর বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন যুদ্ধের শুরু হয়। পশ্চিমা শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকে ধর্মভিত্তিক উগ্র গোষ্ঠীগুলো, যাদের আক্রমণের কৌশল মূলত আত্মঘাতী। নিজেদের জীবন দিয়ে আতঙ্ক ছড়াতে অন্যের জীবন নেওয়ার কৌশল এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করে বিভিন্ন দেশেই।


এই জঙ্গিরা ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করেছে দেশে দেশে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ৯০ দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে তৎপরতা শুরু হয় এদের। ওই দশকের মাঝামাঝিতে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, শেষের দিকে রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় প্রশ্ন উঠে বাংলাদেশেও কি আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে?


২০০৫ সালে জামাআতুল মুজাহিদিন- জেএমবি সারা দেশে একযোগে পাঁচশরও বেশি জায়গায় বোমা হামলা চালিয়ে ভীতির সঞ্চার করে। তবে এক দশকের চেষ্টায়ও তারা খুব একটা আগাতে পারেনি, সেটা বলা যায় জোর দিয়েই। গত কয়েক বছরে দেশে বড় ধরনের কোনো জঙ্গি তৎপরতার ঘটনা ঘটেনি। যাও ঘটেছে ব্যক্তি পর্যায়ে। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতে ব্লগার ও লেখক হত্যার অভিযোগ আছে। এর বাইরে বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হামলা দেশে ঘটেনি। নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে জঙ্গিরা, এখনও গ্রেপ্তার হচ্ছে। এছাড়া দেশে সন্ত্রাস পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক অবস্থায় আর নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সতর্কতায় অনেকাংশেই কমে এসেছে এসব অপতৎপরতা। একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ, এ কথা বলা যাবে না। কারণ সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতের ঘটনা তো প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় মিলছে। তবে সার্বিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘রেড অ্যালার্টে’র পর্যায়ে যায়নি। এ কথা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোরই।


সপ্তাহ দুয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্য জরিপকারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির সুনামই তুলে ধরা হয়েছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০তম। এদিক থেকে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স ও ভারতের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া ‘বৈশ্বিক আইনশৃঙ্খলা সূচক ২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, জরিপে ৮৯ স্কোর পেয়ে তালিকায় সিঙ্গাপুর সবার ওপরে রয়েছে। আগের বছরও দেশটি শীর্ষে ছিল। তালিকায় ৩০ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের স্কোর ৭৮। জাপান ও নিউজিল্যান্ডের স্কোরও তাই। ৩৮ নম্বরে থাকা যুক্তরাষ্ট্র এবং ৩৯ নম্বরে থাকা অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ৭৭। ৪৪ নম্বরে থাকা ফ্রান্সের স্কোর ৭৫। ৬৩ নম্বরে থাকা ইতালির স্কোর ৭১ এবং ৭৭ নম্বরে থাকা ভারতের স্কোর ৬৭।


অথচ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের পেছনে থাকা অস্ট্রেলিয়া কদিন আগে তার দেশের ক্রিকেটারদের ‘নিরাপত্তাহীনতার’ অজুহাতে বাংলাদেশ সফরে আসতে দেয়নি। অথচ ওই নিষেধাজ্ঞার পরপরই গত ২ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে বন্দুকধারীদের গুলিতে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।


আইএসের দায় স্বীকার নিয়ে বিভ্রান্তি


কদিন আগে ঢাকার গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেল্লা এবং রংপুরে হোশি কোনিও হত্যার পর কূটনীতিক মহলের একটি অংশ দেশের নিরাপত্তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেই বসেছে, বাংলাদেশকে তারা নাকি আরও আগেই বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিল। অথচ তাদের দেশের একটি জরিপই স্পষ্ট বলছে, বাংলাদেশে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে।


নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ‘নিরাপত্তাহীনতা’ নামে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র যে ‘জুজু’র ভয় দেখাচ্ছে আদপে তার কোনো শক্ত ভিত্তি নেই। দুজন বিদেশি নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা প্রমাণ করে না যে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঝুঁকিতে রয়েছে। কিংবা এ দেশে জঙ্গি তৎপরতা রয়েছে। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পর হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথিত আইএস এই দুটি হত্যার যে দায় স্বীকার করেছে তা কতটুকু সঠিক, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ আসলেই ওই স্বীকারোক্তিমূলক স্ট্যাটাস বা বার্তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটাকে সত্যি হিসেবে ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই।


হোশি কোনিও হত্যার পর জানা গেছে তিনি গত রোজায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, ভালোবেসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীকে কেন ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী হত্যা করবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও মনে করেন এই প্রশ্ন উঠাই যৌক্তিক। তিনি বলেন, আইএসের নামে কারা দায় স্বীকার করে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছে তা যাচাই করে দেখছি আমরা। ধর্ম পাল্টে কেউ মুসলমান হলে তাকে আইএসের কেউ হত্যা করবে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না।


নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে এ কথা বলা যাবে না। কিন্তু জঙ্গিরা দেশে সংগঠিত এ কথাও মেনে নেওয়া যাবে না। কারণ গত কয়েক বছরে দেশে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান প্রমাণ করে দেশে জঙ্গিবাদ থাকলেও তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যে কারণে জঙ্গিরা কোথায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেই তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে অপরাধকে শূন্যভাগে নামিয়ে আনা সত্যিই কঠিন। তবে দেশে বর্তমানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমে এসেছে। দুজন বিদেশি নাগরিক খুন হওয়ার ঘটনার পেছনে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার চেয়ে রাজনৈতিকহীন স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। তা না হলে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশে সফর বাতিল করার পরপরই এসব ঘটনা ঘটল কেন?’


সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন অবশ্য এই দুটো ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে চান না। তিনি বলেন, ‘দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার পেছনে কে বা কারা জড়িত তা খুঁজে বের করার আগে এ নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। তবে আইএসের নামে টুইটারে বার্তা দিয়ে বিদেশি নাগরিক হত্যার বিষয়ে যেসব তথ্য প্রচার করা হচ্ছে, কতটুকু সঠিক সেটাও জানার চেষ্টা করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা কমবেশি থাকতে পারে, তাই বলে আইএস এভাবে প্রকাশ্যে মানুষ মেরে তার দায় স্বীকার করবে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।’


জঙ্গি আছে আইএস নেই!


গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেল্লা হত্যার পর বিদেশ থেকে একটি টুইট বার্তায় দাবি করা হয়, আইএস ওই হত্যা করেছে। বিষয়টি নিয়ে দেশের সর্বত্র যখন তোলপাড় তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান স্পষ্টই জানালেন, বাংলাদেশে আইএস নেই। এই হত্যাকাণ্ড আইএস ঘটায়নি। এর কদিন পর রংপুরে মেরে ফেলা হলো জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওকে। প্রচার আছে জাপানি ওই নাগরিক মৃত্যুর আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হোশি কোনিও হত্যার পর আইএস একই কায়দায় হত্যার দায় স্বীকার করে। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবারও স্পষ্টই বললেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গি আছে কিন্তু আইএস নেই। এসব টুইট বার্তার ভিত্তি নেই।’


রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের মত হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে থেকে কোনো বিষয়ে তদন্ত হওয়ার আগেই মন্তব্য করে বসা কখনই ভালো ফল বয়ে আনবে না। মন্ত্রী এভাবে আইএসের সংশ্লিষ্ট উড়িয়ে না দিয়ে তদন্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন। এতে তদন্ত কাজও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে হতো। এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এই হত্যার পেছনে আইএসের দায়কে একেবারেই ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন তখন তদন্ত কাজ কতটুকু নিরপেক্ষ বা সুষ্ঠু হবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।


দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা নিয়ে আতঙ্ক কি বাড়াবাড়ি?


নিঃসন্দেহে কোনো হত্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবে অগ্রহণযোগ্য হলেও সভ্যতার শুরু থেকেই খুনসহ নানা অপরাধের মোকাবেলা করতে হয়েছে মানুষকে। এই খুন বাংলাদেশে যেমন হয় তেমনি জাপানে, ইতালিতে, যুক্তরাষ্ট্রে, অস্ট্রেলিয়ায় এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলোতেও হয়।


কোনো দেশই সন্ত্রাসমুক্ত নয়। বিদেশে কাজ বা চাকরি করতে গিয়ে প্রতি বছরই দুর্বৃত্তদের হামলায় মারা যায় বাংলাদেশের নাগরিকরাও। তাই বলে বাংলাদেশ সরকার সে সব দেশে যাওয়ার বিষয়ে নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছে এমনটি নয়।


গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেবল লিবিয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে নাগরিকদের। স্বভাবতই দেশটির স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর চারটি অঞ্চলে চারটি সরকার থাকে যে দেশে, যেখানে যেকোনো সময় জঙ্গি হামলায় প্রাণহানি হতে পারে, সে সব দেশের বিষয়ে সতর্কতা জারি করাই যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ কি এমন কোনো অঞ্চল?


অস্ট্রেলিয়ার সফর বাতিল নিয়ে চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছে বিসিবি


সফরের দিনক্ষণ যখন ঘনিয়ে এলো ঠিক সেই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর বাতিল করার ঘটনা অবাক হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বের অনেকে। কারণ মাস কয়েক আগেই ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে। তাদের দীর্ঘ সফরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বরং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল খুবই স্বাভাবিক। এর আগে ২০১৪ সালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে দেশজুড়ে নাশকতা চলার সময় বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলে গেছে ২০টি দল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এসে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে পড়েনি কেউ।


নিরাপত্তার শঙ্কার কারণে পাকিস্তানে যাচ্ছে না আন্তর্জাতিক কোনো দল। সে দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলার কারণে স্বভাবতই আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তার ওপর ভয় উপেক্ষা করে ২০০৯ সালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই সফরে যাওয়া শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দলের ওপর লাহোরে হামলার পর ছয় বছর আর দেশটিতে যায়নি কোনো দল।


তবে চলতি বছর নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে ঘুরে এসেছে জিম্বাবুয়ে। খেলে এসেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলও। অথচ নিরাপত্তহীনতার ধুয়া তুলে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের সফর বাতিলের সিদ্ধান্ত ভিন্ন কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ক্রিকেট বোদ্ধারাই বলছেন, এর পেছনে ক্রিকেটীয় কোনো বড় স্বার্থ থাকতে পারে। কারণ বিগত দুটো সিরিজেই বাংলাদেশ ভালো করেছে। বিশ্ব ক্রিকেটের তালিকায় এগিয়ে থাকা দুটো দল ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই ভালো খেলে সিরিজ নিজেদের ঘরে তুলেছে বাংলাদেশ। এটি যে অস্ট্রেলিয়ার জন্য আতঙ্কের কারণ হয়নি, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।


অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার ইয়ান চ্যাপেল তার দেশের সফর বাতিলের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলছেন, যে যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে তার দেশ, একই যুক্তিতে ভারত সফর তারা বাতিল করত কি না। এখানেই প্রশ্নটি এসে যায়। ২০০৮ সালে ভারত সফররত ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল সাত ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের পাঁচটি খেলেই পাড়ি জমিয়েছিল নিজ দেশে। ভারতের মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলায় ১৬৪ জন নিহত এবং প্রায় ছয়শ জন আহত হওয়ার পর ইংলিশরা সিরিজের সব ম্যাচ না খেলে ফিরে গেলেও স্থগিত হয়ে যাওয়া দুটি টেস্ট খেলতে একই বছরের ডিসেম্বরে আবার ভারত ফিরে আসে ইংল্যান্ড।


এ সব কারণেই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল এবং সাউথ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিত হওয়া কোনো চক্রান্তের অংশ কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসির বোর্ড সভায় তুলবে।


বিদেশি নাগরিক হত্যা নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি


পর পর দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ। আওয়ামী লীগ তরফে বলা হচ্ছে, এই ঘটনার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন রয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে বলেছেন, একটি রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী যারা মানুষ পুড়িয়ে মারে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, তারাই বাংলাদেশে ইতালীয় নাগরিক হত্যার মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে। বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিক দল হলেও সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী। ইতালীয় নাগরিক হত্যায় আইএস জড়িত আছে এটা আমি মনে করি না। এ ব্যাপারে বিএনপির এক নেতা উৎসাহী হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এটা সন্দেহজনক।’ দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনেও দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার পেছনে বিএনপি-জামায়াতকেই দোষারোপ করেন তিনি।


পাল্টা প্রতিবাদও জানিয়েছে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দুজন বিদেশি নাগরিক খুনের ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত না করেই সরকার ‘বিরোধী দলকে’ ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে অপপ্রচার শুরু করেছে। বিরোধী দল ও মতকে দমন করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও অন্য নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে।’ গত বুধবার পাঠানো বিবৃতিতে বিদেশি দুই নাগরিক হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিও তুলেছে বিএনপি।


রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনায় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাদা ছোড়াছুড়ি না হলেই ভালো হতো। কারণ হত্যার ঘটনা তদন্তের আগে কারোরই এ ব্যাপারে কিছু বলা ঠিক নয়। কারণ এর দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়।


পশ্চিমাদের তথ্যই বলছে বাংলাদেশ নিরাপদ


যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৯টি দেশের বিষয়ে ‘ট্রাভেল ওয়ার্নিং’ এবং ছয়টি দেশের বিষয়ে ‘ট্রাভেল অ্যালার্ট’ রয়েছে। এর কোনোটিতেই বাংলাদেশ নেই। ট্রাভেল ওয়ার্নিংয়ের মেয়াদ কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত অস্থিতিশীল সরকার, গৃহযুদ্ধ, ভয়াবহ অপরাধ বা সহিংসতা অব্যাহত থাকা কিংবা প্রায়ই সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে ‘ট্রাভেল ওয়ার্নিং’ দিয়ে মার্কিন নাগরিকদের সে দেশে না যেতে জোরালোভাবে উৎসাহিত করা হয়। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, সৌদি আরবের মতো দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ট্রাভেল ওয়ার্নিং’ রয়েছে। অন্যদিকে ‘ট্রাভেল অ্যালার্ট’ হয় স্বল্প মেয়াদে। নির্বাচন, বিক্ষোভ, সমাবেশ, সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব এসব কারণে সাধারণত ‘ট্রাভেল অ্যালার্ট’ দেওয়া হয়। তিউনিসিয়া, তাঞ্জানিয়ার মতো দেশের ক্ষেত্রে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের এমন অ্যালার্ট রয়েছে।


যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ সফর নিয়ে তার নাগরিকদের সতর্ক করলেও একই সময়ে বাংলাদেশ সফর করে গেছে চার সদস্যের ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদল। দলটি ঢাকা ও সিলেট সফর করে বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে এবং অনেক শপিং মলে গিয়েছে। দলের নেতা অ্যানি মেইনের মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘আমরা কোনো ঝুঁকি অনুভব করিনি।’


জানা গেছে, ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেল্লা হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এর দায় স্বীকার করে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। এতে নতুন শঙ্কা দেখা দেয়। বিদেশি দূতাবাসগুলো এর সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা শুরু করে।


এক আরব দেশের রাষ্ট্রদূত একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। বিভিন্ন দেশে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে তারা মনে করেন, বিশ্বের অনেক স্থানের চেয়ে বাংলাদেশ নিরাপদ।


অন্য এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে ডামাডোল দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। যিনি নিহত হয়েছেন তিনি কূটনীতিকও নন, একজন সাধারণ বিদেশি। হতে পারে, ঘটনাটি কূটনৈতিক এলাকার কাছাকাছি ঘটেছে। কিন্তু তাও দূতাবাস থেকে দূরে। আমাদের সহকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনায়ও এ বিষয়ে তেমন কোনো কথা হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা বিশ্বের কোথায় ঘটে না? আরব বিশ্বের অনেক নেতা ইউরোপের সুরক্ষিত দেশগুলোতে হত্যার শিকার হয়েছেন।’


সতর্কবার্তা সরিয়ে ফেলেছে ইতালি দূতাবাস


২৯ সেপ্টেম্বর ইতালি দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়, সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে সিজার তাবেল্লাকে হত্যার উদ্দেশ্য এখনো ¯পষ্ট নয়। আইএসের ওই হত্যার দায় স্বীকারের বিষয়টিও এখনো যাচাই করা যায়নি। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর ইতালি দূতাবাস তার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বার্তায় আইএস প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে বলে, সিজার তাবেল্লা হত্যার বিষয়টি এখনো পুলিশ কর্তৃপক্ষের তদন্তাধীন। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ইতালি দূতাবাস তার নাগরিকদের চলাফেরা সীমিত করতে, বিশেষ করে হেঁটে চলাচলের সময় জনসমাগমের স্থানে পারতপক্ষে না যাওয়া এবং বিদেশিরা সচরাচর যায় এমন স্থানগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ইতালি দূতাবাস ১ অক্টোবর সেই বার্তাটিও সরিয়ে ফেলেছে।


গত সপ্তাহে সতর্কবার্তা জারির পরও পশ্চিমা কূটনীতিকরা কূটনৈতিক এলাকার অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দিয়েছেন। এমনকি পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের কেউ কেউ সচিবালয়ে গিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। সরকার কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করেছে।


গত কয়েক বছরে দেশে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান প্রমাণ করে দেশে জঙ্গিবাদ থাকলেও তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যে কারণে জঙ্গিরা কোথায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেই তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে অপরাধকে শূন্যভাগে নামিয়ে আনা সত্যিই কঠিন। তবে দেশে বর্তমানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমে এসেছে। দুজন বিদেশি নাগরিক খুন হওয়ার ঘটনার পেছনে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার চেয়ে রাজনৈতিকহীন স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। তা না হলে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশে সফর বাতিল করার পরপরই এসব ঘটনা ঘটল কেন?