গুলশান-১ থেকে পূর্বদিকে চলে গেছে পথ। খানিক বাদেই লেক। লেক ধরে সামনে কিছুদূর এগুলেই রাস্তার উত্তর পাশে সুরম্য অট্টালিকা। মধ্যবাড্ডার এ কে খন্দকার সড়কের পাশে গুলশান লেকভিউ সোসাইটিতে এমন বাড়ি হাতেগোনা দু-চারটে। ৯/১১ হোল্ডিংয়ের এই বাড়িটির মালিক ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ কাইয়ুম। যিনি এখনো এলাকার মানুষের কাছে ‘কমিশনার কাইয়ুম’ বলেই পরিচিত। বাড়িটির দক্ষিণ পাশের দেয়ালে দেদার সেঁটে দেওয়া হয়েছে টু-লেট। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বাধা।
‘কোথায় যাবেন?’ নিরাপত্তাকর্মীর প্রশ্ন।
‘বাইরে অনেক টু-লেট দেখছি, বাসা ভাড়া হবে?’
‘না হবে না।’
‘কিন্তু বাইরে যে টু-লেট ঝুলছে?’
একটু সময় নিলেন পর্যবেক্ষণের জন্য। বললেন, ‘ভেতরে আসেন। আসলে দিনকাল ভালো নয়।’
‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না। মাইনষের চোখ লাগছে। শত্রু লাগছে স্যারের পিছে।’
‘কোন স্যার?’
“কমিশনার কাইয়ুম স্যার। কেন পত্রিকায় দেখেন না ‘বড় ভাই’ লেখতাছে...”
বাসা ভাড়ার আলোচনা খুব বেশিদূর এগুলো না। বেরিয়ে এসেই কথা হয় একজন সেলুন মালিকের সঙ্গে। পবিত্র কু-ু নামে ওই ব্যক্তি জানান, দুই যুগের বেশি সময় ধরে ওই এলাকায় আছেন তিনি। ব্যবসা করছেন। তার চোখের সামনেই হয়েছে সব পরিবর্তন। ‘কী আর কমু। কওয়ার কিছু নাই। আল্লায় দিছে, হেও (কাইয়ুম) কামাইছে। এহন তো দৌড়াদৌড়ি শুরু হইছে।’
আলোচনায় যোগ দিলেন আরও একজন। একটু নিচু গলায় বললেন, ‘ভাই, পুরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও প্রতাপ কমে নাই। এমন কোনো কুকর্ম নেই যে, কাইয়ুম কমিশনার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা করে নাই। এলাকার মাদক বাণিজ্য, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি সবই তাদের লোকজন করে। জমিজমা দখল কইর্যা শত শত কোটি টাকার মালিক হইছে। এখন খেসারত দিতে হবে।’ কথা শেষে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘শুধু উত্তরে (রাস্তার উত্তর পাশে) না, দক্ষিণেও (দক্ষিণ পাশে) তার কয়েকটা বাড়ি আছে।’
ঠিক রাস্তার ওপারে ঢোকার পথেই মাথার ওপর বড় সাইনবোর্ডে লেখা ‘বাড্ডা হাইস্কুল। প্রতিষ্ঠাতা : আলহাজ এম এ কাইয়ুম।’ এই রাস্তা ধরে ১৫ থেকে ২০ কদম এগুলেই হাতের বাঁয়ে ঢুকে গেছে গলিপথ। গলির ডান পাশে ‘অফ হোয়াইট’ রঙের তিনতলা বাড়িটিও কাইয়ুমের। বাড়ির মুখেই লাগানো আছে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা।’ গেট বন্ধ। চাইলেই ঢোকা যাবে না। অনুমতি লাগবে। জানা গেল, এই বাড়িতেই স্ত্রী-পরিজন নিয়ে থাকতেন কাইয়ুম। কথা হয়, বাড়িটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা আসাদের সঙ্গে। ‘স্যার বিদেশে। অসুস্থ মানুষ। চিকিৎসার জন্য গেছে। ম্যাডাম (কাইয়ুমের স্ত্রী) আর স্যারের মেয়েরা এখানে থাকে।’
‘কথা বলা যাবে ম্যাডামের সঙ্গে?’
‘না, বাচ্চাদের নিয়ে কোচিংয়ে গেছে। কথা বলতে হলে বিকালে আসেন।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধ্যবাড্ডার গুদারাঘাট এলাকার এই বাড়িটি ’৯০ সালের আগে ছিল ছাপরা ঘর। সময়ের ব্যবধানে পাল্টে গেছে চিত্র। এলাকার অনেকের অবস্থা খুব বেশি না বদলালেও কাইয়ুমের ভাগ্যে লেগেছে সুবর্ণ ছোঁয়া। গুদারাঘাট, বালুরমাঠ এলাকাতেই কাইয়ুমের নামে-বেনামে অর্ধডজন বাড়ি। বারিধারাতেও আছে সুরম্য দালান। প্লট আছে গুলশান, বারিধারা, বনানী, রামপুরা, বাড্ডার বিভিন্ন এলাকায়। তার বাসার কর্মী আসাদই বললেন, ‘এই এলাকায় স্যারের অনেকগুলা বাড়ি আছে শুনেছি। সবগুলা বাড়ির ঠিকানাও আমি জানি না।’
তার নিজস্ব লোকজন ঠিকঠাক জানুক আর নাই বা জানুক স্থানীয়রা ঠিকই জানেন, কীভাবে রাতারাতি ধনকুবের বনে গেছেন এক সময়ের সামান্য বেতনের কর্মচারী কাইয়ুম। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির এলজিআরডিমন্ত্রী আবদুস সালাম তালুকদারের করণিক ছিলেন তিনি। সেই থেকে তার ‘অতি ধনাঢ্য’ হয়ে ওঠা অনেকের কাছে রহস্যই বটে।
তবে এই রহস্যের ভেদ উন্মোচন হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে। ২০০৭ সালে কাইয়ুমের অবৈধ সম্পদের খোঁজে নামে দুদক। অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল সম্পদের হদিসও মেলে। শুধু তিনিই নন, তার স্ত্রী শামীম আরা বেগমের নামেও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পায় দুদক। ওই বছরের ৫ আগস্ট কাইয়ুম এবং তার স্ত্রীকে আসামি করে বাড্ডা থানায় একটি মামলা করে দুদক। মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘এম এ কাইয়ুম এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের তথ্য দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। ২০০৭ সালে এ নিয়ে মামলা করা হয়েছিল। এখনো বিচার শেষ হয়নি।’
১৯৯১ সাল থেকে শুরু। বিএনপি ক্ষমতায় এলে ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন কাইয়ুম। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন ধীরে ধীরে। ‘ক্যাডারভিত্তিক’ রাজনীতিতে সেই থেকে অনেক কেন্দ্রীয় নেতার ‘চেলা’ হিসেবেও পরিচিত তিনি। পদ পান ওয়ার্ড বিএনপিতে। তারপর বাড্ডা থানা। বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয় তাকে। সবশেষে তার পরিচয় হয় ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে। তারই ঘনিষ্ঠরা জানান, খোকার সঙ্গে মিল থাকলেও দলে খোকার ছায়া প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাসের সঙ্গেও সখ্য কম ছিল না। চারদলীয় জোট আমলে, খোকা ও আব্বাস দুজনেরই খুব ‘আস্থাভাজন’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন কাইয়ুম। যে কারণে যাকে তাকে হুমকি-ধামকি দিতেও বাধত না কখনো। বরং তিনি নাকি বলেই বেড়াতেন, ‘আমি খোকা ভাই, আব্বাস ভাইয়ের লোক। ঢাকা শহরে আমাকে কেউ কিছু বলে এমন বুকের পাটা কয়জনের আছে?’
শুধু মুখেমুখেই নয়, কাজেও এর চেয়ে একধাপ এগিয়ে ছিলেন কাইয়ুম। বিএনপি আমলে ঢাকার অপরাধ জগৎ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। দক্ষিণ অংশের যাবতীয় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, লুটপাটসহ বিভিন্ন অপকর্মের নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রয়াত বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন পিন্টুর হাতে। উত্তর অংশ দাপিয়ে বেড়াতেন কাইয়ুম ও তার সহযোগীরা। বাড্ডা অঞ্চলে তৎকালীন কমিশনার কাইয়ুমের কথাই ছিল শেষ কথা। তার কথার বাইরে কথা বলা আর মৃত্যু ডেকে আনা ছিল নাকি সমান কথা! এসব স্থানীয়দের মুখে মুখে।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদের শুরুর দিকে কিছুটা সক্রিয় থাকলেও শেষদিকে এসে পর্দার আড়ালে চলে যান কাইয়ুম। এখন আবারও আলোচনায় তিনি। হয়েছেন ‘টক অব্য দা কান্ট্রি’। নামে নয়, ‘বড় ভাই’ হিসেবেই মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে তার কথা। গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাবেল্লা সিজার হত্যার নির্দেশদাতাদের মধ্যে সন্দেহের তালিকায় শীর্ষেই আছে কাইয়ুমের নাম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আছেন মালয়েশিয়াতে। সেখানে বসেই সব ধরনের পরিকল্পনা করেছেন বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাকে না পেলেও তার সহোদর মতিনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি এখন পুলিশি হেফাজতেই আছেন।
ছিলেন বহাল তবিয়তেই
প্রায় দশ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। তাতে কি আওয়ামী লীগের গত মেয়াদেও কাইয়ুমের দাপট পুরোপুরি অটুট না থাকলেও ম্লান হয়নি। ছিলেন বহাল তবিয়তেই। কারণ, বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তার সখ্যে বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি। বিস্ময়কর হলো, কাইয়ুম গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওয়াকিল উদ্দীনের ব্যবসায়িক অংশীদার। ওয়াকিল উদ্দীন গুলশান থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে এবারও চেষ্টা করেছেন। জানা গেছে, ওয়াকিল উদ্দীন স্বদেশ প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর এম এ কাইয়ুম অন্যতম পরিচালক। গুলশান-২ নম্বরের তাহের টাওয়ারে স্বদেশ প্রপার্টিজের অফিস। উভয়ে প্রায় নিয়মিত সেখানে বসতেন, অফিস করতেন। বৃহত্তর গুলশান এলাকার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রায় সবাই এ কথা জানেন যে, কোনো কারণে পুলিশ যখন এম এ কাইয়ুমের খোঁজে বেরাত তখন তার সময় কাটত আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নীতিনির্ধারকের ‘¯েœহধন্য’ ওয়াকিল উদ্দীনের সঙ্গে।
রাজনীতিতে এসে পেলেন ‘আলাদিনের চেরাগ!’
রাজনীতি নাকি দেশের জন্য, মানুষের জন্য। অথচ এম এ কাইয়ুমের মতো লোকদের দেখলে মনে হবে, রাজনীতি হচ্ছে রাতারাতি ধনকুবের বনে যাওয়ার বিরাট মওকা। তিনি ঠিকঠাক এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন বটে। তা না হলে ছাপরা ঘর থেকে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ডজনখানেক বাড়ি আর প্লটের মালিক বনে যাওয়া চাট্টিখানি কথা! মধ্যবাড্ডার স্থানীয় বাসিন্দা মান্নান মিয়া বলেন, ‘কাইয়ুম কমিশনার বোধহয় আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন। তা না হলে বৈধ পথে সম্পদের এমন উল্লম্ফন সম্ভব হতো না।’
তারই রাজনৈতিক সহকর্মীরা জানান, বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকতে সব ধরনের রাজনৈতিক সুযোগ তিনি কাজে লাগিয়েছেন। ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বাছবিচার ছিল না তার কাছে। মির্জা আব্বাস গণপূর্তমন্ত্রী থাকতে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় যত প্লট বরাদ্দ হয়েছে সব জায়গাতেই নামে-বেনামে বিপুল সংখ্যক প্লটের মালিক হয়েছেন তিনি। ঢাকার গুলশান, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় তার কতগুলো প্লট আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
সূত্র জানায়, সরকারি সুযোগ সুবিধাই নয়, সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে বিভিন্নভাবে অর্থকরীর মালিক হয়েছেন বিএনপির এই নেতা। অনেক সময় তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বসতভিটাও ছাড়তে হয়েছে নিজ দলের নেতা-কর্মীকে। দোর্দ- প্রতাপশালী এই নেতার ভয়ে সবাই সব সময় থাকত তটস্থ। কেউ সাহস করত না তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার। থানায় পর্যন্ত যেতে সাহস করতেন না কেউ।
কাইয়ুমের বাড়ি কয়টা জানে না তার ঘনিষ্ঠরাও!
এক সময় ছাপরা ঘরের বাসিন্দা এম এ কাইয়ুমের ঢাকায় কয়টা বাড়ি আছে সেই খবর নেই তার ঘনিষ্ঠদের কাছেও। পরিবারের লোকজনও নাকি ঠিকঠাক বলতে পারবে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় তার প্রায় দশটি বাড়ি আছে। মধ্যবাড্ডার বালুর মাঠে পাঁচতলা বাড়িটি যে কাইয়ুমের এ কথা স্থানীয় অনেকে জানলেও মুখ খুলতে চায় না কেউ। ৫৬/৭ হোল্ডিংয়ের এই বাড়ির জমি নিয়েও জটিলতা ছিল বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। অনেকটা জোর করেই নাকি দখলে নেওয়া হয়েছিল জমির বড় একটি অংশ। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাড়ি থেকে হাঁটা দূরত্বেও বারিধারায় একটি বিলাসবহুল বাড়ি আছে কাইয়ুমের। ওই বাড়িতেই তিনি থাকেন। ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়ার আসবাবপত্র রাখা হয়েছিল ওই বাড়িতে।
লজিং মাস্টার থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক!
নরসিংদীর অখ্যাত পরিবারের সন্তান কাইয়ুম ঢাকায় এসে বাড্ডায় এক বাসায় লজিং মাস্টার হিসেবে থাকতে শুরু করেন। তার বাবা আবদুল হাই ছিলেন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কেরানি। তার খালু ছিলেন ছবির মাস্টার। যিনি পাকিস্তান আমলে নরসিংদীর রায়পুরা থেকে ঢাকায় আসেন লজিং মাস্টার হিসেবে। কাইয়ুমদের পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দেওয়ায় স্বাধীনতার পর তিনি কাইয়ুমকেও নিয়ে আসেন ঢাকায়। এরপর তার মতো কাইয়ুমও লজিং থাকা শুরু করেন। সে সময় গুদারাঘাট এলাকায় আড়াই কাঠার একটি প্লটও কিনে দেন তার খালু। পরবর্তী সময়ে সেই জমিতে ছনের ঘর তুলে থাকতেন কাইয়ুম ও তার পরিবার। জরাজীর্ণ সেই ঘরের অবস্থা এমন ছিল যে, তাকে ঘর বললেও ভুল বলা হবে। এর মধ্যে একপর্যায়ে ভাগ্যগুণে বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি তার প্রতিষ্ঠানে করণিকের চাকরি নেন। করণিক হলেও বিএনপির এই গুরুত্বপূর্ণ নেতার আস্থা অর্জনসহ তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তিনি। একপর্যায়ে সফলও হয়ে যান। এ সুবাদে বাড্ডা এলাকার ওয়ার্ড বিএনপি কর্মী হিসেবে বিভিন্ন মিছিল মিটিয়ে যোগ দেওয়া শুরু করেন। এরপর কর্মী থেকে নেতা হওয়ার পথটা খুব কৌশলে পাড়ি দিয়ে এসে এখন তিনি কোটি কোটিপতি কাইয়ুম বনে গেছেন।
কাইয়ুমের ব্যাপারে স্থানীয়দের মধ্যেও আতঙ্কের কমতি নেই। স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘নিজের টাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করেই শান্তি ছিল না। কাইয়ুমের লোকজন যেভাবে চাঁদাবাজি করে আসছিল তা কাউকে বলাও যেত না। এখনো তার লোকজন চোখ রাঙায়।’
স্বদেশ প্রপার্টিজের নামে জমি দখলের মচ্ছব
বিএনপির সমর্থন নিয়ে ১৯৯৪ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো কমিশনার হয়ে যান। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। ক্যাডার বাহিনী দিয়ে জমি দখল থেকে শুরু করে সব ধরনের অপকর্মই করেছেন কাইয়ুম। তার অন্যতম ক্যাডার আউয়াল ও টিটু মারা গেছেন। বর্তমানে তার ক্যাডারদের মধ্যে সিরাজ মিয়া, হারুন, স্বপন, ইন্ডিয়ান বাবুল, রূপক, খলিল ও বিমান সুমন অন্যতম। কাইয়ুমের বিরুদ্ধে বাড্ডা ও গুলশান থানায় প্রায় একডজন মামলা তদন্ত ও বিচারাধীন আছে। বাড্ডা থানা পুলিশ জানায়, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাড্ডা থানায় আটটি মামলা রয়েছে। গুলশান থানায় রয়েছে দুটি মামলা। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুলশান-বাড্ডা আসন থেকে বিএনপির টিকিটে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন কাইয়ুম। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি তার।
অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তি আর বিশাল ক্যাডার বাহিনী নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে কাইয়ুম যখন অপ্রতিরোধ্য, ঠিক ওই সময়ই ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় মহাজোট। আর ক্ষমতার দোর্দ- প্রভাব খাটিয়ে তিনি রাতারাতি অন্যতম মালিক হয়ে যান স্বদেশ প্রপার্টিজের। ব্যবসা ও অর্থের লোভে গোপনে তিনি আঁতাত করেন গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক ওয়াকিল উদ্দীনের সঙ্গে। তারা দুজনে সুযোগ বুঝে বিএনপি নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রহমতুল্লাহ ও বিএনপি নেতা এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ভাইয়ের শেয়ার কিনে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মালিক বনে যান স্বদেশ প্রপার্টিজের। এর পরের ঘটনা রীতিমতো হার মানায় ফিল্মি কাহিনিকেও। পেশিশক্তির বলে জমি দখলের মহোৎসবে মেতে ওঠেন দুজন।
স্বদেশ প্রপার্টিজ নামের কো¤পানিটি রাজউকের অনুমোদন না থাকলেও তারা কোনো নিয়মই মানেননি। রাতারাতি দখল করে নেয় তাদের প্রকল্প এলাকা সংলগ্ন অসহায় মানুষের জমি। এর বিরুদ্ধে যারাই মুখ খুলেছে, তাদের ওপরই চড়াও হয়েছে তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী। মামলা-হামলা করে হয়রানি করা হয়েছে জমির প্রকৃত মালিকদের। স্বদেশ প্রপার্টিজের স্বর্ণালী ও সানভ্যালী আবাসন প্রকল্পের নামে তারা দখল করে নেয় ডুমনি-বরুয়া এলাকার একমাত্র পানির উৎস বোয়ালি খালসহ বিল এলাকার নিচু জমি। নিচু জমি ভরাট ও লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে শত শত মানুষকে নিঃস্ব করেছে। এর বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দারা একাধিকবার মিছিল, প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ করলেও শেষ পর্যন্ত প্রাণনাশের হুমকিতে এলাকার লোকজন পিছু হটতে বাধ্য হয়।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েই মহাশক্তিধর হয়ে ওঠেন এম এ কাইয়ুম। গড়ে তোলেন বিশাল সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ বাহিনী। বিএনপি সরকারের আমলে তার দাপটে ও প্রভাবে কেউ প্রতিবাদ করে টিকতে পারেনি। ওই সময় তারই ছত্রচ্ছায়ায় হীনস্বার্থে দলীয় আদর্শ ভুলে ওয়াকিল উদ্দীনও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ওয়াকিল উদ্দীন সরকারের সব মহল থেকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে স্বদেশ প্রপার্টিজকে আরও সম্প্রসারণ করেন। এই দুই মেরুর দুই নেতা দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে ও নিজ নিজ সরকারের আমলে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ হয়ে উঠেন। দুর্নীতি, অবৈধ ও আয়বহির্ভূত স¤পদের জন্য ওয়ান-ইলেভেনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক ওয়াকিল উদ্দীন। ওই সময় ৩৫ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়ে শর্ত সাপেক্ষে তিনি মুক্তি পান। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কাইয়ুমও। ১৯ মাস কারাগারে ছিলেন তিনি।
তাবেল্লা হত্যার পরিকল্পনা হয় ফোনে!
ইতালীয় নাগরিক তাবেল্লা সিজার হত্যা পরিকল্পনার তথ্য প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। তারা বলছে, খুনির সঙ্গে সার্বিক যোগাযোগ হয়েছে ফোনে। তথ্য-প্রমাণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ডিবির দুই সদস্য হত্যার অন্যতম আসামি বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের নাম। যিনি এখন দুবাইয়ে পালিয়ে আছেন। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, জিসানের সঙ্গে ফোনে বিভিন্ন সময় যোগাযোগ করেন কাইয়ুম। তখন তিনি ছিলেন সৌদি আরবে। ওই সময় বিএনপির একজন শীর্ষ নেতাও সেখানে অবস্থান করছিলেন। জিসানকে নিয়ে কাইয়ুম বিএনপির ওই নেতার সঙ্গেও দেখা করেছেন বলে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে। যদিও কাইয়ুম তার বিরুদ্ধে আনা সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তাকে বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে। তিনি এসবের সঙ্গে মোটেও জড়িত নন। জিসানের সঙ্গে তার ফোনালাপও বানোয়াট। অথচ গোয়েন্দাদের হাতে থাকা ফোনালাপ বলছে, তাবেল্লা হত্যার সঙ্গে কাইয়ুমসহ আরও কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।