বাংলাদেশের ঐতিহ্যের কথা শুধু দেশবাসী নয় বিশ্ববাসী জানে। কিন্তু কালের বিবর্তনের কারণে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে, যা আজ ইতিহাস। এ রকম কিছু হারানো ঐতিহ্যের কথা জানাচ্ছেন সৈয়দ রশিদ আলম।
মসলিন, এই শাড়িটি এক সময় বাংলাদেশের সোনারগাঁওয়ে তৈরি হতো। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা ও বিক্রমপুরের একাধিক অঞ্চলে মসলিন তৈরি করার উপকরণ পাওয়া যেত। পরবর্তী সময়ে মসলিন শাড়ি তৈরি হওয়ার পর ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যারা এই মসলিন শাড়ি তৈরি করতেন তারা ষড়যন্ত্রকারী ব্রিটিশদের কারণে এ শিল্পকে আর ধরে রাখতে পারেননি। বলা হয়, যারা মসলিন শাড়ি নির্মাণ করতেন তাদের হাতের আঙুল কেটে ফেলা হয়েছিল। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর, ব্রিটিশ জাদুঘরসহ একাধিক জাদুঘরে আজ মসলিন প্রদর্শিত হচ্ছে। মসলিন শাড়িকে নিয়ে প্রায় ৭০ বছর থেকে গবেষণা হলেও এর নির্মাণের কৌশল এখনো আবিষ্কার হয়নি।
বাংলাদেশের উৎসবের একটি বড় অংশ বিয়ে। গ্রামের বাড়িতে নববধূ তুলে আনার জন্য একটা সময় পালকি ব্যবহার করা হতো। যারা পালকি বহন করতেন তাদের সামাজিকভাবে সম্মানিত করা হতো। যেই বাড়িতে নতুন বউ পালকি ছাড়া আসতেন, সেই বাড়িকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হতো। আর যেই বাড়িতে নতুন বউ পালকিতে আসতেন, সেই বাড়ির মর্যাদা অনেক বেড়ে যেত। ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাদেশেই পালকির প্রচলন সবচেয়ে বেশি ছিল। ষাটের দশকে একাধিক চলচ্চিত্রে পালকির ব্যবহার দেখা গেছে। বর্তমানে নাটক-সিনেমা নির্মাতারা যদি মনে করেন তাদের নাটক ও সিনেমায় পালকির প্রয়োজন হবে তাহলে তারা আর পালকি খুঁজে পাবেন না। এর জন্য তাদের যেতে হবে কোনো জাদুঘরে। কিন্তু যারা বাংলাদেশের ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছেন তারা বিশ্বাস করেন সীমিত পর্যায়ে বাংলাদেশে আবার নতুন করে পালকির প্রচলন শুরু করা সম্ভব। যদিও পালকির স্থান প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসের দখলে চলে গেছে।
ধান ও চাল ভাঙানো কাজে ঢেঁকি ব্যবহার বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর একাধিক চাল ও ধান ভাঙানোর কল তৈরি হওয়ার পর আস্তে আস্তে ঢেঁকির প্রচলন কমে যায়। গত ৫ বছরে সারাদেশে সফর করেও ঢেঁকি খুঁজে পাইনি। বাংলাদেশের দুই টাকার একটি ব্যাংক নোটে ঢেঁকির ব্যবহার দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর কোনো মাধ্যমে আমরা ঢেঁকিকে ব্যবহার করতে দেখিনি। নাটক-সিনেমা নির্মাতারাও গল্পের প্রয়োজনে ঢেঁকিকে উপস্থাপন করার প্রয়োজন মনে করেন না। এভাবেই কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে ঢেঁকি।
বর্তমানে আধুনিক যুগে একের পর পর কলম তৈরি হয়ে যাওয়ার পর দোয়াত-কালির অস্তিত্ব চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু সংগ্রহকারী তাদের শোকেসে স্মৃতি হিসেবে দোয়াত-কালি রেখে দিয়েছেন। একটা সময় আপনজনকে চিঠিপত্র লেখার জন্য দোয়াত-কালির প্রয়োজন হতো। এখন মোবাইলের কারণে দোয়াত-কালির অস্তিত্ব শূন্যের কোঠায়।
বাংলাদেশে শীতকালে পালাগানের প্রচলন ছিল। এখন গ্রাম-বাংলার দু-এক জায়গায় পালাগানের অস্তিত্ব থাকলেও তাও প্রায় বিলুপ্তির পর্যায়ে। আধুনিক সিডি, ডিভিডি ও টেলিভিশন চালু হওয়ার পর পালাগানের চর্চা হারিয়ে গেছে। রাত জেগে পালাগান শোনার আগ্রহ আর কারোর মধ্যে নেই।
বাংলাদেশে বিনোদনের বড় মাধ্যম হিসেবে নৌকাবাইচকে মনে করা হতো। বিশেষ করে বিক্রমপুরের নৌকাবাইচের সুনাম শত শত বছরের। সেই বিক্রমপুরেও নৌকাবাইচের প্রচলন তেমন একটা নেই। মাঝেমধ্যে নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতা হলেও সেখানে প্রাণের সেই আবেগ আর নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ একাধিক অঞ্চলে মোরগ লড়াইয়ের প্রচলন থাকলেও আস্তে আস্তে তা বিলুপ্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দু-এক জায়গায় এটি দেখা গেলেও দর্শকদের আর মুগ্ধ করতে পারে না।
বেদে সমাজ বাংলাদেশে সাপ খেলা দেখিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। গ্রামাঞ্চলে গিয়ে তারা যে আদর-যত্ন পেত সেটা আজ ইতিহাস। আর কেউ বেদে সমাজের সাপ খেলা দেখতে রাজি নয়। বেদেরা বর্তমানে সাপ খেলা দেখানো বাদ দিয়ে নানা পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। একমাত্র সাহিত্যের পাতায় তাদের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে পথেঘাটে বেদে দেখা গেলেও তাদের প্রতি কারোর আগ্রহ আর নেই। তারপরও আমরা বিশ্বাস করি হারিয়ে যাওয়া বাংলার ঐতিহ্য আবারো ফিরে আসবে।