যাকাত ইসলামের একটি ফরজ বিধান। সমাজে ধনী-গরিবের মাঝে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করা ও সমাজকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেয়া হলো এর উদ্দেশ্য। ইসলাম একজনের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ জমা হওয়াকে পছন্দ করে না। ইসলাম চায় ধনী-গরিব সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করুক। তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ্য করে যাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। যাকাত আদায় করলে আল্লাহপাক সম্পদের মালিকদের বরকত দেন।
একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সা. বলেছেন- ‘সদকা করার কারণে কখনো সম্পদ কমে না।’
দান-খয়রাত করলে সম্পদের পরিমাণ কমলেও সম্পদের বরকত কমে না। আল্লাহপাক এ সম্পদকে তার ভবিষ্যতের জন্য বরকতময় করে দেন এবং তার দান-খয়রাতের কারণে তাকে এর চেয়ে উত্তম সম্পত্তি দান করেন।
আমাদের দেশে যাকাতের আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলছে। ইসলামি বিধান হচ্ছে- যাকাতের অর্থ দিয়ে দরিদ্র মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর। যাতে ভবিষ্যতে তাকে আর মানুষের দ্বারে দ্বারে যেত না হয়। কিন্তু আজকের বিত্তবান সমাজে দরিদ্রদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতার কথা আর ভাবছেন না। সবাই ঝুঁকছেন শুধু শাড়ি-লুঙ্গির দিকে।
রাজধানীর গুলিস্থান, ফুলবাড়িয়া ও ফার্মগেটসহ নানা স্থানে বেশকিছু মার্কেটে ব্যানার টানিয়ে বিক্রি হচ্ছে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি। জাকাতকে কেন্দ্র করে আমাদের অর্থনীতিতে প্রতিবছর হাত বদল হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অথচ এ অর্থে গরিবদের কোন উপকারে আসছে না।
ইসলামি শরিয়া ধনীদের উপর যাকাত ফরজ করেছে যেন তাদের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র সমাজের লোকেরা স্বনির্ভর হয়। কিন্তু আমাদের এই শাড়ি-লুঙ্গির সংস্কৃতিতে ধনীদের টাকায় লাভবান হচ্ছেন শুধু ধনীরাই। গরিবের কপালে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। এছাড়াও জাকাতের টাকায় শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের মাধ্যমে আমাদের সমাজে বিপর্যয় ঘটছে। গত বছরের ৭ জুলাই ময়মনসিংহ পৌরসভা কার্যালয়ের কাছে নূরানী জর্দার মালিক শামীম তালুকদারের জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের সমাগম হয়। এক পর্যায়ে ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই কয়েকজনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ মোট ২৭ জন মারা যান।
আজ আলেম সমাজের ভাবার সময় হয়েছে, এইভাবে যাকাত আদায় করলে আদৌ জাকাত আদায় হবে কিনা?
আমাদের নবী সা. বিভিন্ন হাদিসে মুসলিম জাতিকে যাকাত আদায়ের বিষয়ে সচেতন করেছেন। একটি হাদিসে এসেছে, হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘আমরা রাসূল সা.-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করি নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনার উপর।’
অপর হাদিসে এসেছে, হযরত আবু সায়ীদ রা. বর্ণনা করেন, ‘একদিন রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে নসিহত করছিলেন। তিনবার শপথ করে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজানের রোজা রাখবে, জাকাত প্রদান করবে এবং সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকবে আল্লাহপাক তার জন্য অবশ্যই বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে বলবেন, ‘তোমরা নিরাপদে তাতে প্রবেশ কর’। -নাসায়ী
ইসলামে অর্থনৈতিকভাবে দুইটি বিষয় আমাদের উপর ওয়াজিব করা হয়েছে। ১. সাদাকাতুল ফিতর ২. যাকাত। আমরা যদি নবী সা.-এর এই দুই বিষয়ের হাদিস নিয়ে আলোচনা-পর্যলোচনা করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব এই দুইটা বিষয়ের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। ফিতরা আদায় করি, যেন সমাজের সবাই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারি এই জন্য। কিন্তু যাকাতের উদ্দেশ্য কখনো ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা নয়। যাকাতের উদ্দেশ্য হলো সমাজের দরিদ্র ও অসহায় লোকদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলা। আমাদের সমাজে শাড়ি-লুঙ্গি দেয়ার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। এই সংস্কৃতি যদি চলতে থাকে, তাহলে প্রকৃত যাকাত আদায়ের ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সুতরাং সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান হচ্ছে, নিজেদের সুনাম ও খ্যাতি বৃদ্ধির জন্য নয়, যাকাত প্রদান করুণ ইসলামি শরীয়া অনুযায়ী- তাহলেই সমাজের ও দেশের কল্যাণ হবে।
লেখক : আলেম ও গণমাধ্যমকর্মী