logo ০১ জুলাই ২০২৫
সেই সুরেলা সন্ধ্যাগুলো নেই
আমিনুল হক সাদী, ঢাকাটাইমস
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৮:২৯:৪৫
image




‘প্রথম প্রণাম করি/হস্ত নাহি পদ নাহি তার শরীর,/অখ- মহিমা প্রভুর নির্মল শরীর/ নাহি খায় আবেদানা নাহি যায় ঘুম/কি হালেতে চলে বান্দা সদায় মামুল...।’  ‘গাজী কালুর চম্পাবতী’, ‘বিষাদসিন্ধ’ কিংবা ‘পদ্মপুরাণ’- পুঁথিপাঠের শুরুটা হতো এভাবেই। মাটিতে বিছানো হোগলা কিংবা চাটাইয়ে বসে সুর করে পুঁথি পাঠ করে চলতেন পাঠক। তার চারপাশ ঘিরে বসা শ্রোতারা তা শুনত নিবিষ্ট মনে। পুঁথির কাহিনী কখনো আনন্দের শিহরণ ছড়াত, কখনো বা বিষাদে ছেয়ে যেত অন্তর।



কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে একসময় সন্ধ্যার পরপর বসত এমনই পুঁথিপাঠের আসর। এসব সন্ধ্যাকালীন বিনোদনের আসর এখন আর তেমন দেখা যায় না। ভেসে আসে না সেই সুরেলা কাহিনী বর্ণন।



দেশের দূরগ্রামেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ আর তথ্যপ্রযুক্তি। নানা বিনোদনের মাধ্যম এখন হাতের নাগালে। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরছে মানুষ। তারা সেখান থেকে  খুঁজে নিচ্ছে নিজেদের বিনোদনের খোরাক। ফলে গ্রামীণ এই প্রাচীন ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে।



তবে প্রবীণ প্রজন্মের কেউ কেউ এখনো নিয়মিত পাঠ করেন পুরনো পুঁথি। ৯০ বছরের আবদুল গফুর মুন্সী তাদেরই একজন। সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের পুঁথিপাঠক আব্দুল গফুরের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে সেকালের পুঁথিপাঠের আসরসহ নানা মজার তথ্য।



বাড়ির উঠান কিংবা বারান্দায় হারিকেনের আবছা আলোতে বসত পুঁথিপাঠের আসর।  চোখে চশমা আঁটা বয়োবৃদ্ধ পণ্ডিত সুর করে পাঠ করতেন পুঁথি। পাঠের সঙ্গে দুলত তার শরীর। জুড়ি, দোতরা, খঞ্জনিসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তাকে সঙ্গত করতেন দোহাররা। সামনে থাকত হুক্কা, তামাক, পান প্রভৃতি সরঞ্জাম।



আবদুল গফুর বলেন, পুঁথিপাঠের আসরে জড়ো হতো কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সব বয়সের নারী-পুরুষ। পুঁথির কথা আর সুর আনন্দ-বেদনার দোলা দিয়ে যেত সবার মনে। কোনো আনন্দ ও বিজয় আখ্যানে ছেলে-ছোকরার দল মুহুর্মুহু হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করত পাঠককে। আবার কান্নার সুরে যখন দুঃখের কাহিনী বর্ণনা হতো, শাড়ির আঁচলে ঘন ঘন চোখ মুছত নারীরা। এ সময় পাঠকও আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলতেন।



গ্রামাঞ্চলে বিশেষ দিনগুলোতেও এ ধরনের পুঁথিপাঠের আসর বসত। নবান্ন, আকিকা, খাৎনা- এসব দিনে প-িতদের দাওয়াত করে এনে পুঁথিপাঠ শুনত লোকজন।



যে বাড়িতে পুঁথিপাঠের আসর বসত, ওই বাড়ির বউ-ঝিরা আগে থেকেই রান্নাবান্নাসহ সব কাজ সেরে অপেক্ষা করত সন্ধ্যার জন্য। আশপাশের বাড়িতে দাওয়াত দেয়া হতো পুঁথিপাঠ শোনার জন্য। দিনটি পরিণত হতো এক উৎসবে।



পুঁথিতে যেমন ছিল প্রেমোপাখ্যান, তেমনি ছিল যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনা। ধর্মীয় নানা উপাখ্যান নিয়েও রচিত হয়েছে অনেক পুঁথি।



আবদুল গফুর বলেন, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পুঁথিগুলোর মধ্যে ছিল ‘গাজী কালুর চম্পাবতী’,  ‘ইউসুফ-জোলেখা’, ‘বিষাদসিন্ধু’ (শহীদ কারবালা নামে পরিচিত), ‘সাত ভাই চম্পা’ ইত্যাদি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘মঙ্গলকাব্য’, ‘অন্নদামঙ্গল’, ‘চর্যাপদ’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘দ্বিজবংশী দাস’, ‘পদ্মপুরাণ’ প্রভৃতি।



বলতে বলতে পুঁথিপাঠক আবদুল গফুর সুর করে গেয়ে ওঠেন, ‘প্রথম প্রণাম করি/হস্ত নাহি পদ নাহি তার শরীর,/অখ- মহিমা প্রভুর নির্মল শরীর।/ নাহি খায় আবেদানা নাহি যায় ঘুম/কি হালেতে চলে বান্দা সদায় মামুল...।’ তার হাতে মেলে ধরা পুঁথি। কত না পুরনো সেই বই! পাতাগুলো হলদে হয়ে গেছে।কিন্তু কালো হরফের লেখাগুলো দিব্যি খালি চোখে পড়ে যাচ্ছেন এই বৃদ্ধ।



পুঁথির বই নিয়ে স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হন আবদুল গফুর। কালের পরিক্রমায় প্রায় হারিয়ে গেছে আদিকালের সেই পুঁথি আর পুঁথিপাঠ। বলেন, ‘আগের দিনে কোনো ছাপাখানা ছিল না। হাতে লেখা হতো বিভিন্ন কাহিনীর পুঁথি। আমার কাছে সে রকম  কয়েকটি পুরনো বই ছিল। হারিয়ে গেছে। আহা রে! আগে যখন পুঁথি পড়তাম, কতই না ভক্ত ছিল আমার! আজ পুঁথির সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আমার জীবনের আলো।’



বিষণ্ন চোখে জানালার বাইরে তাকান আবদুল গফুর। যেন বা খোঁজেন সেই স্বপ্নীল সন্ধ্যাগুলো।











(ঢাকাটাইমস/২০সেপ্টেম্বর/মোআ)