জমিদারির খোঁজে ময়মনসিংহে
মনোনেশ দাস, ময়মনসিংহ
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১০:৩৪:৪৮

জমিদারি আমল থেকেই রমরমা অবস্থা ছিল ময়মনসিংহে। রাজা-মহারাজাদের কল্যাণে শহরে গড়ে উঠেছিল নান্দনিক সব অট্টালিকা। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এর কিছু এখনো টিকে আছে। অনাদর-অবহেলা আর বেদখলে এর অনেক আবার হারিয়ে গেছে, কোনো কোনোটি বিলুপ্তপ্রায়। যেগুলো আছে সেগুলো ময়মনসিংহের ইতিহাস-ঐতিহ্য সগৌরবে জানান দিচ্ছে। আসুন এমন কিছু জমিদারি কীর্তির কথা জেনে নেই।
শশীলজ
মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী নিজ পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ করেন দ্বিতল ভবন ‘শশীলজ’। ময়মনসিংহের রাজবাড়ি বলতে মহারাজ সূর্যকান্ত নির্মিত দৃষ্টিনন্দন শশীলজ কটেজকেই বুঝে থাকেন। গঙ্গাদাস গুহ রোডে জেলা পরিষদ ভবনের বিপরীতে এর বিশাল উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে বাড়িটির দিকে তাকালে সবুজ গাছ-গাছালির সমাবেশে সাদা পাড় মেরুন বাড়িটি অদ্ভুত সুন্দর নারী ভাস্কর্যসহ যে কাউকে চমকে দেয়। বিশাল এ বাড়িটিতে আছে অসংখ্য দুর্লভ বৃক্ষের সমারোহ। ১৯৫২ সাল থেকে শশীলজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের একমাত্র সরকারি মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ।
আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল
শশীলজ থেকে সামান্য দূরেই মহারাজের বাগানবাড়ি। আয়তন বিবেচনায় বাগানবাড়িটি বেশ কিছুটা বড়। ময়মনসিংহ শহরের উল্লেখযোগ্য এক স্থাপত্য আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল এ বাগানবাড়িতে অবস্থিত। এটি লোহার কুঠি নামেও সমধিক পরিচিত। বাড়িটি তৈরি করতে লোহার পরিমাণ বেশি লেগেছিল তাই এই নামকরণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহসহ অনেক অভিজাত ব্যক্তি এ বাগানবাড়িতে রাত কাটিয়েছেন।
ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, ১৮৭৯ সালে ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এ জমিতে নির্মাণ করা হয় বাংলো আদলের সুরম্য বাগানবাড়ি লোহার কুঠি বা আলেকজান্দ্রার ক্যাসেল। ক্যাসেলের ভেতরে ছিল শ্বেতপাথরের ফ্লোর। যদিও এখন আর তা নেই। আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের প্রতিষ্ঠাতা ময়মনসিংহের খ্যাতিমান জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। তিনি প্রায় ৪২ বছর জমিদারি পরিচালনা করেন। ১৯২০ সালে বাংলার গভর্নর রোনাল্ড তাকে মহারাজা উপাধি দেন। তিনি ছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক।
আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল এখন শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলে অবস্থানকালে একটি বিশালাকার বৃক্ষতলে বসে অনেক কবিতা রচনা করেছেন। গাছটি এখনো ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করে। বৃক্ষটির নিচে বসলে ব্রহ্মপুত্র নদের শীতল বাতাসে শরীর-মন জুড়িয়ে নেন বিশ্বকবির মতো অনেকেই। ১৯৪৮ সালে আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের ২৭ দশমিক ১৫ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। প্রথমে শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী সময়ে কলেজে বেশ কয়েকটি সুবিশাল ভবন নির্মিত হলে ক্যাসেলের দোতলায় স্থানান্তরিত হয় শিক্ষকদের বাসভবন। পরবর্তীতে গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল। আট কক্ষবিশিষ্ট ভবনে রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার গ্রন্থ।
গৌরীপুর লজ
গৌরীপুরের সংস্কৃতিমনা জমিদারের কাষ্ঠ নির্মিত দোতলা বাড়ি এটি। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে খান বাহাদুর ইসমাইল হোসেন সড়কে রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কসের পাশে এর অবস্থান। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের পর দ্বিতল বাড়ি নির্মাণের অনুমতি না থাকায় কাঠের বাড়িটি নির্মাণ করেন গৌরীপুরের জমিদার রাজেন্দ্র কিশোর। এর জন্য তিনি চীন থেকে কারিগর নিয়ে আসেন। বর্তমানে এটি সোনালী ব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আরও কিছু জমিদারবাড়ি
ধনবাড়ির জমিদারদের সুদৃশ্য ভবন। রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কসের পেছনে এ বাড়িতে একসময় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের জেলা অফিস ছিল। বর্তমানে ব্যবহার অনুপযোগী বলে পরিত্যক্ত। হাসান মঞ্জিলের বিপরীতে একই রাস্তায় অবস্থিত। বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ জেলার তারাইল উপজেলার তালজাঙ্গায় জমিদারদের বসতবাড়ি সি কে ঘোষ রোড রেলক্রসিংয়ের পাশে। বর্তমানে আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কালিবাড়ি রোডের বাড়িটি বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মহারাজা রোডের সুদৃশ্য এ বাড়িতে বর্তমানে সরকারের কৃষি বিভাগের খামার বাড়ির উপপরিচালকের দপ্তর অবস্থিত। শহরের প্রধান সড়ক রামবাবু রোডের এ বাড়িটি বর্তমানে ময়মনসিংহ কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মদন বাবু রোডের এ বাড়িটি বর্তমানে সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হরিকিশোর রায় রোডের এ বাড়িটি সত্যজিৎ রায়ের প্রপিতামহ হরিকিশোর রায়ের বাড়ি। বাড়ির আদি নাম ‘পুণ্যলক্ষ্মী ভবন’। বর্তমান পরিবর্তিত নাম ‘দুর্লভ ভবন’। বাড়িটি বর্তমানে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ঢাকাটাইমস/১৮সেপ্টেম্বর/প্রতিনিধি/এমএইচ