শ্রাবণ মাসের ভর দুপুর। মেঘের বাঁধা ডিঙিয়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। পিজ ঢালা পথের একপাশে অগোছালোভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাল আর সুপারি গাছ। পথের অপরপ্রান্ত মিশে গেছে হোগলা পাতার ঝাড় হয়ে মাঠের সঙ্গে। এমন পথ ধরেই হাঁটছিল কাঞ্চন। হাঁটতে হাঁটতে পথের দুপাশে চোখ রাখতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। কিছুটা সুখানুভব আবার কিছুটা কান্নার সুর। মনে পড়ে গেল আট থেকে নয় বছর আগের দিনগুলোর কথা। যখন সে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র ছিল। স্কুলে যাওয়ার একটি পথই ছিল এটি। যে পথের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবনে প্রথম কোন মায়াবতী ললনাকে ভাললাগার সুখ স্মৃতি। স্কুলে যাওয়ার পথে কিংবা ফেরার পথে এই পথেই ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। ক্ষণিকের মধ্যে মানসপটে ভেসে উঠলো মায়াবী সেই মুখচ্ছবি। কুসুম, তার নাম। সত্যিই সে কুসুম। গোলাপ ফুলের সঙ্গে তুলনা করলে মনে হয়, তুলনায় সে কম হয়ে গেল বুঝি। হাসনা হেনা, বেলী, কামিনী না খুবই নগন্য। তার রুপের তুলনা যেন একটি মাত্র ফুলে হয় না। তাই সব ফুলের সমাহার সে একজন কুসুম। দু জোড়া চোখ যেন শীতল স্রোতস্বিনী। ঘন চোখের পাতার ঝাঁপ ফেলানো দেখলে যে কেউ টাসকি খেয়ে পড়ে যাবে। পিরামিডের মতো খাড়া নাক। কোমড় অবদি কাল কেশ আর গোলাপি বর্ণের ঠোঁট। সত্যিই সে অসাধারণ রূপসী।
কাঞ্চন আর কুসুম একই ক্লাসে পড়তো। কাঞ্চন ছিল ক্লাসে ভাল ছাত্রদের একজন। পাশাপাশি যে ভাল গান, কবিতা আবৃত্তি, আর্ট আর বাকপটু ছিল। কাঞ্চনের এসব গুনকে খুব পছন্দ করতো কুসুম। এটি ভাল করেই জানতো দুর্দান্ত কাঞ্চন। আর তাই ক্লাস এইট থেকেই কুসুমের অজান্তেই তাকে পছন্দ করে কাঞ্চন। কুসুম যখন হাসতো, কথা বলতো তখন অপলক তাকিয়ে থাকতো কাঞ্চন। বন্ধুদের অগোচরে লুকিয়ে লুকিয়ে ক্লাস চলাকালেও কাঞ্চন কুসুমকে দেখতো। মাঝে মাঝে দুই হাতে মুখ ঢেকে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে কুসুমের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকতো কাঞ্চন। এসব করতে ভাল লাগতো তার।
কুসুমও কাঞ্চনের সঙ্গে খুব মিসতো। কাঞ্চনের মন খারাপ হলে, কুসুম জানতে চাইতো কী হয়েছে, কেন এমন।
কুসুমের কোন এককা- মনে করে হাঁটতে হাঁটতে হাসি থামাতে পারলো না কাঞ্চন। একদিন কোন একটি আড্ডায় কাঞ্চনকে টিপ্পনি কেটে কথা বলেছিল কুসুম। কাঞ্চনের লেগেছিল। সে দুদিন কুসুমের সঙ্গে কথা বলেনি। এটি বুঝতে পারলো কুসুম। কিন্তু ক্লাসে বন্ধুদের সামনে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাস করার সুযোগ পেল না। ছুটি শেষে তারা যখন বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো তখন কুসুম কাঞ্চনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু কাঞ্চন বুঝতে পেরে আগে থেকেই দূরত্ব বজায় রেখে চলতে থাকলো। কারণ যার যার প্রতি যতবেশি ভালবাসা তার প্রতি ততবেশি রাগ। এভাবে তিনদিন চলে গেল। অবশেষে তাসলিমা নামে এক বান্ধবীর মাধ্যমে কাঞ্চনের রাগ ভাঙলো।
এভাবে ক্লাস নাইন টেন চললো দুজনের। কাঞ্চনের মনে কুসুমের জন্য অগাধ ভালবাসা জমাট বাঁধতে থাকলো। এর মধ্যে কাঞ্চনের বন্ধু ওহি কুসুমকে পছন্দ করে বসলো। এমকি কুসুমকে প্রস্তাব দেয়ার জন্য কাঞ্চনকে বারবার অনুরোধ করতে থাকলো। ওহি মাঝে মাঝে ক্লাসে কুসুমকে চোখ মরতো, পিছনে বসে চিমটি কাটতো। এগুলো সবই জানা ছিল কাঞ্চনের। কিন্তু কুসুমের হাঁটা চলা, কথা বলা, চোখের চাহনী সর্বোপরি একটা মানুষকে মনের মধ্যে প্রতিমার মতো যতেœ ধরে রাখা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারতো না কাঞ্চন। কুসুমকে নিয়ে কখনো তার মনে খারাপ, নোংরা চিন্তা মাথায় আসেনি কাঞ্চনের। কুসুমের প্রতি তার উৎসাহ ছিল কিন্তু কখনো তা আসক্তিতে পরিণত হয় নি। যে কারণে কোন এক পরীক্ষার আগে নকল করার জন্য কুসুমের বান্দবীরা যখন বই গোপনে রাখল। কাঞ্চন সেটি স্যারকে ধরিয়ে দিতে চাইলে কুসুম ও তার বান্দীরা তাকে ঘিরে ফেলে হাত থেকে বই নেয়ার চেষ্টা করে। অনেক চেষ্টার পর কাঞ্চন নিজেই কুসুমদের বই দিয়ে দেয়। এ ঘটনা দূর থেকে কাঞ্চনের এক বন্ধু দেখে বললো, দোস্তা দারুণ সুযোগ ছিল। কিছু একটা করতে পারতি। অথচ কাঞ্চনের মনে এমন কোন চিন্তাই ছিলনা।
এমনিভাবে কাঞ্চন মাঝে মাঝেই দুষ্টমি করে কুসুমকে আলতো করে মুষ্টি কিল মারতো, পায়ে পা দিতে চেষ্টা করতো। পবিত্র একটা জায়গা থেকে কুসুমকে ভালবাসতো কাঞ্চন। যে কারণে বিকালে মেঠো পথের পরে বসলে কুসুমকে ভাবতো কাঞ্চন, রাতে পড়তে বসলে বইয়ের পাতায় পাতায় লিখত কুসুম+কাঞ্চন। আবার বাবা মায়ের ভয়ে এর উপর দিয়ে ওভার লেপিং করে তা নিরুদ্দেশ করে ছিল ভালবাসা, ভাললাগা। কাঞ্চনের এক পক্ষের ভাললাগা ভালবাসা এক পর্যায়ে তারা দশম শ্রেণির বাছাই পরীক্ষা শেষ প্রান্তে চলে আসল।
তখনই কাঞ্চনের মনো হল-আর বুঝি দেখা হবে না কুসুমের। দূরে সরে যেতে হবে আমাদের। সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির ঝোপ-ঝাড়ে হারিয়ে ফেলবো কুসুমকে। কিন্তু তাকে যে আমি ভালবাসি। এটি তো তাকে জানানো উচিত। আমি যদি না জানাই তবে সে জানবে কী করে।
হা-হুতাশ শুরু হলো কাঞ্চনের। কীভাবে জানানো যায়, কী করা যায়? কীংকর্তব্যবিমূঢ় কাঞ্চন। পড়ার টেবিলে মন বসে না। কেমন উতলা-উতলা ভাব। অবশেষে ভালবাসার জানান দিতে মরিয়া হলো কাঞ্চন। সে বুদ্ধি আটলো কুসুমকে একটি চিঠি লিখবে। কিন্তু ভাষার ব্যঞ্জনায় চিঠি আর লিখা হলো না। কোন এক বিকেলে কুসুমের কথা ভাবতে ভাবতে আমন ধানের মাঠে যায় কাঞ্চন। পাকা ধানের হলুদ রং দেখে মনে মনে একটি উপায় খুঁজে পায়। ধান দিনে একটি কার্ড লিখে কুসুমকে দেয়ার চিন্তা করল। যেই চিন্তা সেই কাজ। খেত থেকে ধান তুলে সেই সন্ধ্যায় শক্ত কাগজে ফ্রেম তৈরি করে ধান দিয়ে আর্ট করে দিলে ‘আমার অন্তরে তুমি থাকবে চিরকাল’। কার্ডের মধ্যে জলছাপ রাখলো কুসুম+কাঞ্চন, কুসুম +কাঞ্চন।
কার্ড তৈরী, কিন্তু কী ভাবে দেয়া যায়। এ আবার নতুন টেনশন। কিন্তু দিন ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। কী করা যায়, কী উপায়? ভাবতে থাকে সে। তখন মনে পড়ে গেল তারা এখনো একই সঙ্গে কোচিং করে। এই সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাইলো না কাঞ্চন। কোচিংয়ে গিয়ে কুসুমের সাজেশনটা চাইলো সে। বললো আমার কিছু বিষয় দাগিয়ে নিতে হবে, তোমার বইটা দেবে? কুসুম বইটি আগ্রহ ভরে আগিয়ে দিল।এরপর সাজেশনের মধ্যে কার্ডটি রেখে বইটি শার্টের নিচ দিয়ে লুকিয়ে রাখলো কাঞ্চন। কোচিং শেষে যখন চিরচেনা এ পথে বাড়িতে ফিরছিল, তখন এক বন্ধুকে সাইকেল নিয়ে আসতে বললো কাঞ্চন। বন্ধু জাকির যখন সাইকেল নিয়ে আসলো, কাঞ্চন কুসুমের হাতে বইটি দিয়ে সাইকেল ভর করে তৎক্ষণাত স্থান ত্যাগ করল।
এরপর কার্ড দেখে কুসুম কী মনে করবে, কী ভাববে, কী হবে? এই সব নিয়ে জাকিরের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতে করতে দিন কাটলো কাঞ্চনের। কিন্তু কুসুমের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেলনা। তবে হ্যা, কার্ড পাওয়ার পর তার বাসায় কাঞ্চনকে একদিন যেতে বলছিল কুসুম। কিন্তু কার্ডের লিখা মনে করে লজ্জায় আর কুসুমের সামনে যাওয়া হয় নি কাঞ্চনের। তবে এসএসসি পরীক্ষার সময় একদিন কি দুদিন কুসুমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কাঞ্চনের।
তখনও তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটি অজানা সংকোচে পিছিয়ে যেত কাঞ্চন। এরপর এইচএসসি তে দুজন ভর্তি হলো দুই কলেজে। এরপর আর খুব বেশি দেখা হয় নি কুসুমের।
শ্রাবণের এ দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে কাঞ্চন বলে উঠলো ‘কুসুম, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে ভালবাসা। বিকশিত হলো না। ফুটতে চাওয়া ফুলের ফোঁটা হলো না। বৃন্তেই বন্দি হয়ে থাকল ভালবাসা’।