ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় পার করছে বাংলাদেশ এই সময়ে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম সে সময়ে যারা দেশের স্বাধীনতায় বিরোধিতা করেছিল আজ সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে তাদের বিচার হচ্ছে স্বাধীন ভূমিতে এবং চার দশক পর। পুরনো আর বর্তমান বন্ধুদের সহায়তায় এই বিচারে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করেছিল তারা। সব বাধা দুমড়ে-মুষড়ে বিচারের রায় কার্যকর করার মাধ্যমে জাতিকে সম্মানিত করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বড় পরিচয় তিনি এই বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তাঁর বাবা এ দেশের স্থপতি। এ দেশের মানুষ ছিলেন তাঁর আত্মজা। ভালোবাসতেন নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি। প্রাণ দিয়ে সেই প্রমাণ তিনি রেখেছেন। নিঃস্বার্থ এই ভালোবাসার প্রতিদানে তিনি পেয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি। সেই উপাধিতে তিনি পরিচিত বিশ্ববাসীর কাছেও। উপাধি আর নাম মিলে এক হয়ে গেছে; যেন পরিপূরক, এমন নজির বোধহয় পৃথিবীতে আর নেই। থাকলেও হাতেগোনা।
আজ কে না স্বীকার করবে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সন্তান শেখ হাসিনা। সে সাক্ষর তিনি রেখে যাচ্ছেন তাঁর কর্মের মাধ্যমে। সম্প্রতি দেশে আসা যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শন শেষে মন্তব্য ডায়েরিতে লিখেন, ‘কাপুরুষোচিত সন্ত্রাসীরা এক মেধাবী ও সাহসী নেতৃত্বকে বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ আজ তাঁর কন্যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’ তাছাড়া শেখ হাসিনাও বারবার দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রী, তার চেয়ে বেশি গৌরব বোধকরি আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। সর্বমহল আজ তাঁর নেতৃত্বকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অবিচল ভূমিকা তাঁর নেতৃত্বকে আরও আলোকোজ্জ্বল করেছে।
কে না জানে নিজেদের অর্থ আর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর কাশেম আলী কতটা ক্ষমতাশালী ছিলেন। ফলে কতটা বেগ পেতে হয়েছে এই বিচারের রায় কার্যকর করতে তা কেবল শেখ হাসিনাই জানেন। আমরা দূর থেকে কিছুটা ধারণা নিতে পারি। তিনি সাপের লেজে পা দিয়েছেন কেবল এই দেশকে সুদূরপ্রসারী বিপদ ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে পৌঁছার লক্ষ্যে। আজ সেই স্বপ্নের পথে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বিশ্বকে অবাক করে।
এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র কখনই চায়নি এই দেশ নিজস্বতা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াক। তাতে ওদের বহুমুখী লাভ। যদি এই দেশ ব্যর্থ হয় তাহলে তারা নিজেদের সাজানো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবে অনায়াসে। সেভাবে সাজানো ছিল সাংগঠনিক কর্মকা- এবং নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাদের প্রজন্ম। বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে তারা স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে যে স্বপ্ন লালন করত সেই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া ছিল সবসময়। আর সে প্রমাণ বেশি ফুটে ওঠেছে যখন তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় বসেছে তখন। বিএনপিকে ঘুম পাড়িয়ে কিংবা বুঝিয়ে জামায়াত দেশব্যাপী গড়ে তোলে একাধিক জঙ্গি সংগঠন। দিয়েছে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা। তারপরের বাংলাদেশ তো আমরা দেখেছি, আজও দেখছি। দেখার মধ্যে বড় নির্মমতা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা এবং জঙ্গির শক্ত নেটওয়ার্কের অবস্থান জানান দিয়েছিল ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একই সময়ে ৫শ স্থানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়ে। কাকতালীয় নয়, ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকেই এ মাস তাদের কাছে মিশন সাকসেসফুল হিসেবে বিবেচিত। প্রমাণিত সত্য। আবার কেউ কেউ ওই গোষ্ঠীকে উৎসাহ দেওয়ার স্বার্থে জন্মদিনের মতো আনন্দের দিন স্থানান্তর করে আগস্টের শোকের দিন বেছে নেন!
শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আমরা আজ ভীষণ খুশি। তা স্বাভাবিক বটে। কিন্তু এখানেই যদি তৃপ্তি প্রকাশ করে অমনোযোগী থাকা হয় তাহলে বরং দেশকে আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হবে। মৃত্যুদ- কার্যকরে ব্যক্তি নিজামী, মুজাহিদ, মীর কাসেমের বিচার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের আদর্শে বেড়ে ওঠা পরিবারের সদস্যদের তারা রেখে গেছেন নিরাপদে যোগ্য করে; পাশাপাশি বিপুল অর্থ-সম্পদ তো রয়েছেই। ভুলে গেলে চলবে না, একাত্তরে তারা যে অপরাধ করেছে তা তারা একটি আদর্শকে টিকে রাখার স্বার্থে করেছে, সেই আদর্শ বাস্তবায়নে তারা এখন তাদের প্রজন্মকে রেখে যাচ্ছে। এরপর তাদের সন্তানরা দেশকে অস্থিতিশীল করা কিংবা বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি প্রতিশোধ নিতে জঙ্গি অর্থায়ন দ্বিগুণ করবে না সেই নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারবে? বরং সম্ভাবনাই বেশি। কারণ রায় কার্যকর পূর্ববর্তী কিংবা পরবর্তী সময়ে আদালতের রায়ের প্রতি স্পর্ধা দেখিয়ে তাদের স্বজনদের হাত উঁচিয়ে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানোর নানা অঙ্গিভঙ্গি প্রদর্শন জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। এই প্রজন্মই পরবর্তী সময়ে জামায়াতের নেতৃত্বে আসবে তা নিয়ে সন্দেহের কিছু নেই। এরই মধ্যে কিছু যুদ্ধাপরাধীর সন্তানরা বিএনপির নবগঠিত কমিটিতে স্থান পেয়েছে।
এখন যুদ্ধাপরাধ সংগঠন হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ করা জরুরি। সমধিক জরুরি যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তিগুলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। মোটা দাগের বক্তব্য হচ্ছে, সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের প্রজন্ম কে কোথায় কি করছে এসব নজরদারি করা দেশের সামগ্রিক শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা উচিত, সাপের বাচ্চা বড় হয়ে সুযোগ পেলে সাপের মতোই ছোবল মারে। সুতরাং বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া বুদ্ধিমানের পরিচয়।
লেখক : আইনজীবী ও নির্বাহী পরিচালক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘স্বপ্ন’