আজকালতো প্রশ্ন করলেই হয় না, সঙ্গে আবার এটাও বলে দিতে হয় "সিরিয়াসলি" জিজ্ঞেস করেছি কি না। তো হ্যা, ‘সিরিয়াসলি’ জিজ্ঞাস করলাম। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলে সমস্যা কি?
আমি উত্তরে বলবো, কোনো সমস্যা নেই। আর এটা মানতে যদি আপনার কষ্ট হয় তাহলে বুঝতে হবে আপনার মধ্যে কয়েকটা বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি আছে।
তার মধ্যে বড় বিভ্রান্তি, আপনি মনে করেন আমেরিকা নামের দেশটা চালায় এর জনতার ভোটে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এটা মোটেই সত্য না।
পৃথিবীর আরো অনেক দেশের মতই আমেরিকার মূল চালিকাশক্তি হল এর করপোরেট সমাজ। মোটা দাগে বললে আমেরিকার করপোরেট সমাজের হাতে বিশ্বের বিরাট একটা অংশ জিম্মি। এটা কোন কষ্ট কল্পনা নয়, কিংবা কোন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের গন্ধ খোঁজাও এতে অর্থহীন।মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীর ক্যাম্পেইন থেকে শুরু করেও ভাল অফিস চালানো পর্যন্ত, সব ব্যাপারেই রয়েছে করপোরেট দর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ। পেন্টাগন আর হোয়াইট হাউজের ওপর এদের প্রভাব প্রতিপত্তি কতখানি সেটা শুনলে আপনি চমকে উঠবেন। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের মতন ৯৯% মানে আমেরিকার খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত বনাম ১% মানেজোচ্চোর ধনকুবেরদের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত এক শতাংশই জয়ী হল, কেননা বিলিয়ন ডলারের বেলআউট নিয়ে মার্কিন সরকার ঠিকই দাঁড়িয়েছিল তার করপোরেটদের রক্ষা করতে। অথচ লাখ লাখ লোক চাকরি হারালো অর্থনৈতিক মন্দায়। নিজের ঘরবাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা খেয়ে পথের ফকিরের মতন বেরিয়ে যেতে বাধ্য হল।
এখন আমাদের বুঝতে হবে বিজনেস টাইকুন ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু মূলত সেই করপোরেট সমাজেরই অংশ এবং তিনি সরাসরি তাদের প্রতিনিধি এবং এর আগে ঠিক এতোটা খোলামেলাভাবে করপোরেটদের কেউ ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেনি। তাই ঘাড়ের উপর দিয়ে হাত ঘুরিয়ে নাক দেখানোর ভণ্ডামিটা এবারের নির্বাচনে যদি বাদ যায়, তাতে মন্দ কি? যারা আসলেই দেশ চালায় তাদের প্রতিনিধিই যদি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে সেটাই বরং ভালো। তাতে ভাঁওতাবাজি খানিকটা হলেও চোখে কম লাগে।
আরেকটা বড় বিভ্রান্তি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আর ট্রাম্পের মধ্যে তুলনা করার একটা অদ্ভুত বাতিকের মধ্যে লুকিয়ে আছে। ট্রাম্প চাঁছাছোলা, বাজেবকা, প্রায় অভদ্র এবং ক্ষেত্রবিশেষে অশ্লীল একটা লোক, বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে এটা অস্বীকার করার সব পথ ট্রাম্প নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন।
আপাতদৃষ্টিতে তাই ট্রাম্পের তুলনায় বারাক ওবামাকে ধোয়া তুলশী পাতা বলে মানতে তেমন একটা কষ্ট হয় না। কিন্তু বারাক ওবামার মতন আপাতভদ্রলোকও কিন্তু ক্ষমতায় থেকে তার কাজকর্মে সেটার সুগভীর কোন ছাপ রেখে যেতে পারলেন না। ক্ষমতা গ্রহণের অল্প দিনের ব্যাবধানে শান্তিতে নোবেল জিতেও বিশ্ব শান্তিতে তাকে খুব কমই ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। বরং কোথাও কোথাও খুবই ভয়ংকর রকমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন যেটা তার বহুদিন ধরে আস্তে আস্তে তৈরি করা শান্তি ও সৌম্যের ইমেজের সঙ্গে একেবারই যায় না। আট বছরে প্রায় সাড়ে চার ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়ন=১০০০ বিলিয়ন) ডলার যুদ্ধের খরচ বাবদ ব্যয় করেছে ওবামা সরকার। যেটা কিনা জর্জ বুশের চেয়ে প্রায় ৮১৬ বিলিয়ন ডলার বেশি। এবং ব্যবস্থাটা এমন ২০১৭ সালে ক্ষমতায় যেই আসুক, আমেরিকার যুদ্ধ ব্যয় বাড়বে বই কমবে না। অর্থাৎ যুদ্ধ থামানো তো নয়ই, বরং ওবামা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে গেছেন। ওবামার আট বছরের শাসনকালে কত নিরীহ মানুষ মারা গেছে ইরাক, আফগানিস্থানে ড্রোন থেকে ছুড়ে দেয়া মারণাস্ত্রের আঘাতে?মানবাধিকারের বুলি কপচানো ওবামা কুখ্যাত কারাগার গুয়ানতানামো বে বন্ধ করেনি ক্ষমতার সাত বছরেও। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামার সময়কার পুলিশ প্রশাসন কতবার চুড়ান্ত বর্ণবাদী আচরণ করেছে? সেই হিসেব করুন, তাহলেই বুঝবেন ট্রাম্প-ওবামা দ্বৈরথে ব্যাবধান বড়ই অল্প।
এদিকে আবার ডোনাল্ড ট্রাম্প আর হিলারি ক্লিনটনের মধ্যে একটা তুলনা করে হিলারিকে ইখানিকটা নিরাপদ ভেবে নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে মার্কিনিরা। কিন্তু সেই হিসেবেও রয়েছে গড়মিল। তার কারণ তাদের এই হিসেব নিকেশে ক্ষমতায় থাকাকালীন হিলারির মুছে ফেলা ৩০ হাজার ‘ব্যাক্তিগত’ ই-মেইল এবং অন্যান্য বিতর্কের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের দাতব্য কাজে ব্যয় করার অর্থ নিয়ে নয়ছয় করার অভিযোগ। তার উপর যুদ্ধরানীর খেতাব তো হিলারির গলায় আগে থেকেই ঝোলানো আছে। সান্তনা এতটুকুই, যুক্তরাষ্ট্রের দুশো বছরের ইতিহাসে প্রথমবার একজন নারী প্রেসিডেন্ট হবেন, যদি নির্বাচনে শেষতক হিলারি ক্লিনটন জিতেই যান।
মোটাদাগে বলতে হলে বলা যায়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই হোন আর হিলারি, তাতে বাকি বিশ্বের খুব বেশি ইতরবিশেষ যাবে আসবে না। আদতে আমেরিকা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শাসক হিসেবে পাওয়ার যোগ্য দেশ, আর এর জনসাধারণের চিন্তা চেতনাও একই ধারার। এরা সোনায় সোহাগা না হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানটার ধারে কাছে আসতেই পারতেন না।
হ্যা, ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট হয় তাহলে খুব সমস্যায় পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের সুশীল সমাজ। মানবিকতার ঝাণ্ডা ধরে যুক্তরাষ্ট্রের তাবৎ বর্ণবাদ, বৈষম্যের গোড়ায় নিয়মিত পানি ঢালা সুশীলরা তখন বড় গলায় বড় বড় কথা বলার ক্ষমতা হারাবে। কেন না যুক্তরাষ্ট্রের সুশীল সমাজের জন্য বর্ণবাদী ট্রাম্প, নি:সন্দেহে খুবই জঘন্য মুখোশ। যুদ্ধবাজ আমেরিকার হিংসা আর অমানবিকতার চেহারাটা ঢাকতে বারাক ওবামার মতই আরেকটা মুখোশ সে দেশের সুশীলদের খুব দরকার।