সামাজিক মিডিয়ায় একটা ছবি প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়। রবীন্দ্রনাথ আয়েশী ভঙ্গিতে আরাম কেদারায় আধোশোয়া অবস্থায়, তাঁর পায়ের কাছে মোড়ায় বসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু। তাঁরা হয়ত কোনো গভীর আলাপে মগ্ন ছিলেন। হয়ত আলাপ করছিলেন জরুরি কিছু। এই ছবিটি দারুণ প্রিয়তা পেয়েছে। শেয়ার আর লাইকের বন্যায় ভেসে যাওয়া ছবিটি আমাকেও আপ্লুত করেছে। একজন কবির কাছে নতজানু অথবা বিনয়ী সরকারপ্রধানকে দেখলে আমাদের মন ভরে যায়। কারণ আজকাল এর উল্টো বা বিপরীত ছবি দেখেই ক্লান্ত আমরা।
সরকারপ্রধান তো দূরের কথা মন্ত্রী এমনকি সামান্য এমপিদের দৌরাত্ম্যও এখন ভয়ংকর। ঢালাও না হলেও প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এর কিছু না কিছু নমুনা দেখা যায়। রাজনীতির সেই নীতিবাক্যও পাল্টে দিয়েছে আজ। এককালে আমরা জানতাম প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিংই হচ্ছে জীবনবোধ। তখন মানুষ পাঞ্জাবি-পায়জামাতে সন্তুষ্ট। মা-বোনেরা বাংলার শাড়িতে। অবসরের সঙ্গী ছিল বাংলা সিনেমা, বই ও পত্র-পত্রিকা। এরপর চালু হলো হাই লিভিং আর প্লেইন থিংকিং। পাকি আমলে এটার শুরু। সেনাশাসনের দেশে জেনারেলরা অকারণে মেডেল ঝুলিয়ে বিদেশি কাপড় পরে আমাদের শিখিয়েছিলেন এটাই নিয়ম। চালু হলো সে অধ্যায়। বাড়তে লাগল পোশাকের বাহার। কমতে লাগল দর্শন আর চিন্তার জগৎ। এরপর শুরু হলো জীবন ও আদর্শ বিনষ্টের ষড়যন্ত্র। নেমে এলো হাই লিভিং ও নো থিংকিংয়ের জমানা। এই জমানায় কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক বা বুদ্ধিজীবীরা আসলে কেউ নন। তাদের মাথার ওপর থাকা গডফাদাররাই হলেন নিয়ন্ত্রক। রাজনীতি এমন ভীতি আর ত্রাসের সৃষ্টি করে রাখল যাতে মাথার ওপর থেকে এদের ছায়া সরানো যাচ্ছে না। সম্ভাবনাও কম।
তারপরও আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই আমাদের চমকে দেন। তিনি একাধারে নেত্রী ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা। কখনো কখনো তাঁর দ্বিতীয় পরিচয়টি যখন বড় হয়ে ওঠে তখন পুলকিত হওয়ার বিকল্প থাকে না। তাঁকে একটানা ভালোবাসার মানুষ যতই থাকুক বিরোধিতার মানুষও কম নয়। যারা তাঁর বিরোধিতা করেন, আমি বলছি অন্ধ বিরোধিতা যারা করেন, খুঁজে দেখুন দেখবেন এদের কোথাও না কোথাও আছে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধিতার সূত্র। কারো পিতা, কারো দাদা-নানা বা পরিবারের কারণে তারা আজো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা নিঃশর্তভাবে মেনে নিতে পারেননি। এদের অন্তত চেনা যায়। বোঝা যায় কেন তারা শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেন।
কিন্তু হাল আমলের বিরোধিতাকারীদের চেনা আরো কঠিন। এরা এককালের কড়া বাম। যারা মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলতেও দ্বিধা করত না। মগজে পচন ধরা বামদের ভেতর এখন তারাও আছেন যারা এককালে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে মুখে ফেনা তুলতেন। কি নিদারুণ ভাগ্য আমাদের। যারা মানুষকে বদলে দেওয়ার নাম করে মাঠে নেমেছেন তারাও দেশ বদলে দেওয়া, ভাগ্য বদলে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পছন্দে রাখতে পারেননি। কেন? আমি এই প্রশ্নের জবাব পেতে চেয়েছি বারবার। একটাই কারন, এরা বাংলাদেশের আগ-পাশ-তলা খাবার পর এখন এর খোল নলচে পাল্টে দেওয়ার ধান্দায় আছেন। একচিমটি লবণ, একচিমটি গুড় ইত্যাদি দিয়ে যেমন স্যালাইন, এদের হাতেও একচিমটি পাক প্রেম, এক খাবলা মুক্তিযুদ্ধ, আর মাথা ভর্তি যৌবন বিভ্রান্ত করার উপাদান। শেখ হাসিনা এদের পথের কাঁটা তখনই যখন তিনি দেশকে যুদ্ধাপরাধীদের হাত থেকে মুক্ত করে নীল আকাশে বিশুদ্ধ নিশ্বাস নিতে সাহায্য করেন। তাঁর পিতার পথ ধরে যখন এদেশের ইতিহাসকে শুদ্ধ করে তোলেন তখন তিনি দুশমন।
অথচ এরাই দেশে রাজাকার দালালদের বিরোধিতায় পঞ্চমুখ। তাদের মিডিয়ায় মুখে লেখায় দেশপ্রেমে দেখেশুনে মনে হবে এরা না থাকলে দালাল অপরাধীদের বিচার হতো না এদেশে। আসলে কি তাই? যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একের পর এক বাধা অতিক্রম করে জামায়াতিদের বিরুদ্ধে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করলেন তখন তারা কি করল? নানাভাবে তাঁর বিরোধিতা, জয় বাংলা স্লোগানের বিরোধিতা আর মানুষের মনে সন্দেহ ঢোকানো। এতে কিছু মানুষ যে দিকভ্রান্ত ও সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন বা পড়েন তাতে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এখানেও টার্গেট শেখ হাসিনা। তাঁর কারণে জন কেরীও যখন ফেল মারেন কোন পরাশক্তি পাকিদের আস্ফালন যখন মিইয়ে যায় এরা মাথা নিচু করে তা মানলেও ভেতরে থাকে অন্ধ বিরোধিতা।
শেখ হাসিনার কত দোষ। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করলে বলে পিতার আদর্শ মানছেন না। পিতার আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে গেছেন তিনি। যখন তিনি শক্ত হাতে হাল ধরেন তখন তারা বলে বাড়াবাড়ি করছেন তিনি। দেশ শাসনে এলেই নাকি দেশ বিক্রি করে দেন। দেশের সীমানা নৌ পথে বাড়ল। ছিটমহলে বাড়ল। তবু এক কথা। এক ইঞ্চি জমিও কাউকে কোনোদিন দেয়নি তাঁর দল। বরং তিনি যে দলের কা-ারী তারাই বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন সৈয়দ নজরুলদের নেতৃত্বে ভয়ংকর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন পুরো দেশ। আর যারা আসলে দেশ বিক্রির নোংরা খেলায় দেশ মাতার ইজ্জত বিক্রি করেন তারাই নাকি দেশের হেফাজতকারী। তিনি এবং তার ইমেজের প্রতি নির্দয় মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদীদের দিকে তাকান। এরা সামনে তাঁকে তোয়াজ করে চললেও ভেতরে বিষধর সাপ। সাম্প্রদায়িকতা ভারত বিরোধিতা আর শেখ হাসিনা বিরোধিতা একাকার করে তোলা এসব বুদ্ধিজীবীই শেষ বয়সে বা বিপদে পড়লে তাঁর কাছে ধরনা দেন। তখন বিগলিত চিত্তে করুণ নয়নে অনুদানের চেক গ্রহণকারীদের দেখে বোঝার উপায় নেই এরাই তাঁর বিরুদ্ধে কূট ষড়যন্ত্রে মত্ত থাকত।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার তাদের বড় একটি অংশ সুবিধাভোগে ব্যর্থতার কারণেও এমন করে থাকে। নাম না বলেই বলতে চাই এদের ডেকে হালুয়া রুটির ভাগ দিলেই কাল থেকে সুর পাল্টে যাবে। তাদের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার জন্য তারা তাঁর বিরোধিতার নামে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ এমনকি ধ্বংসকেও উস্কে দিতে কসুর করেন না। আজ দেশের তারুণ্যের ভেতর যে সহিংসতা, যে উগ্রবাদ তার পেছনে এদের ইন্ধন আছে। কেউ লিখে কেউ বলে কেউ কাজে এদের মদদ দিতে দিতে আজ এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন। কোথায় তারা দেশ ও জনগণকে শুদ্ধপথে নিয়ে যাবেন সেটা না করে অন্যায়ভাবে শেখ হাসিনাকে অন্য কারো সমতুল্য করে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকেন। এই বর্ণচোরাদের চেনা না গেলে বিরোধিতার কারণ বোঝা যাবে না।
শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সময়ের একটি জনপ্রিয় ছবির কারণেই এত কথা। যে ছবিটির কথা দিয়ে এ লেখার শুরু সেই রবীন্দ্রনাথ ও নেহেরুর মতো এদেশের একজন মেধাবী কবি গদ্য লেখক নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকের শয্যাপাশে শেখ হাসিনাকে দেখে বোঝা যায় কতটা আর্দ্র তাঁর হৃদয়। সৈয়দ হক সারা জীবন আওয়ামী লীগের সঙ্গে চলেননি। সেটা না জানার কথা নয় তাঁর। তাতে কি? হুমায়ূন আহমেদও চলেননি। বরং অনেক সময় বেপথে হেঁটেছেন। তাঁকেও তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাংলা সংস্কৃতি সাহিত্য বাংলাদেশের মেধার প্রতি তাঁর টান থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ এই আমরা তাঁর কাছ থেকে সুযোগ নেব, উন্নয়নের বিরোধিতা করে উন্নয়নের ফসল ঘরে জমা করব। কাজে কথায় পোশাকে খাবারে ভ্রমণে আর্থিক প্রগতির পথে ধাবমান দেশের সবকিছু ভোগ করে মনে মনে চাইব তেমন একজন সিংহাসনে বসুক যিনি এদেশের প্রধান কবির কান টেনে দিতে চেয়েছিলেন। যাঁর কাছে শিল্প ও শিল্পীর জন্য ভালোবাসা বলে কিছু নেই। এ কেমন মনস্তত্ত্ব?
বিদেশের বাংলাদেশিদের ভেতরও একধরনের নেতিবাচক মনোভাব দেখি। সাধারণ বাংলাদেশিরা তাঁকে ভালোবাসলেও সুবিধাভোগী, সংস্কৃতি করেন এমন প্রবাসীরাও তাঁর বিরুদ্ধে। তাদের রাগের কারণ মূলত দেশের অগ্রগতি যা তাঁর আমলে তাঁর সরকারের আমলে হয়ে চলেছে। এরা চায় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা রাজপথে জীবন কাটিয়ে দিক। আর উটকো রাজনীতির মানুষরা থাকুক দেশ শাসনে। তাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের রাগের ঝাল মিটবে। সঙ্গে আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর জন্য মায়াকান্নাটাও জমাট হয়ে উঠবে।
সৈয়দ হকের রোগশয্যাপাশে বসা প্রধানমন্ত্রীকে দেখে আমাদের মনে হয়েছে তিনি আছেন বলেই আমরা এখনো আলোর পথে আছি। যারা খেয়ে না খেয়ে তাঁর বিরোধিতা করেন আমি আবারো বলছি তাদের কোথাও না কোথাও আছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিরাগ আর পাকিস্তানের প্রতি মমতা। বাংলাদেশের নেত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা মন্দ বলি, তাঁর সরকারের অনেক কাজ প্রশ্নবিদ্ধ। ষড়যন্ত্র আর দুর্নীতিতে ঠাসা গুজবে মানুষ দিকভ্রান্ত। আছে অন্যায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি। কিন্তু এমন প্রধানমন্ত্রী কোথায় পাব আমরা? যিনি একজন কবি বা লেখকের জন্য ছুটে যাবেন? পাশে বসে পরম মমতায় তার খবর নেবেন? সবদোষ শেখ হাসিনার এই আজগুবি থিওরিওয়ালাদের বলি ছবিটি ভালো করে দেখুন। একদিন তাঁর জন্য কেঁদে আকুল হলেও প্রায়শ্চিত্ত করা হবে না আপনাদের। তাঁকে আলোকিত বন্দরের নেত্রী হিসেবেই চাই আমরা। তিনি ছাড়া আর কার বুকে এত মমতা আর ভালোবাসা পাব? ছবি ও ছবির নেত্রী দীর্ঘায়ু হোক। এটাই বাঙালির প্রার্থনা।