প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৯:৪৭:৫৩আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৯:৫১:৫০
শিক্ষামন্ত্রী কি পারবেন?
মাহবুব রেজা
রাজনৈতিক অবস্থান আর ক্ষমতার উত্তাপ কিংবা দম্ভ কখনো কখনো মানুষকে দিশেহারা করে তোলে। কি বলা উচিত অথবা কি বলা উচিত নয় সেটা বোঝার হিতাহিত বোধ তার মধ্যে কাজ করে না। ব্যাপারটা অনেকটা এরকমÑ চামড়ার মুখ আছে সুতরাং যা মুখে এলো আর বলে ফেললাম হয়ে গেল। সাম্প্রতিককালে ক্ষমতাসীন দলের অনেক আঁতকা নেতা (এরা দলে হঠাৎ/রাতারাতি কিংবা হাইব্রিড নেতা হিসেবে চিহ্নিত) কিংবা মন্ত্রিসভার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল সদস্যের লাগামহীন উলটা পালটা বক্তব্য সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে গিয়ে এসব নেতা, মন্ত্রীদের অন্তঃসারশূন্য, বেফাঁস বক্তব্য যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে পর্যন্ত কোণঠাসা করে ফেলে সেটা তাদের মাথার ত্রি-সীমানাতেও থাকে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ধরনের অতি বিপ্লবী নেতাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। কিন্তু তারপরও কি এই ধরনের নেতা, মন্ত্রীদের বেফাঁস কথাবার্তা বন্ধ হয়েছে। রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ধরনের বেফাঁস কথাবার্তা বললে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা নাকি ব্যাপক হারে চাঙ্গা হয়। তারা বলছেন বিএনপির মধ্যবর্তী নির্বাচনের হুমকি ধামকিকে সামনে রেখে এই ধরনের নেতারা এখন মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করার মহান দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। অসম্ভব রকমের সততায় তিনি তার অবস্থানটি আর সবার চেয়ে ভিন্ন এক উচ্চতায় ধরে রাখতে পেরেছেন। রাজনৈতিক বিরোধিতাকারীরাও তাকে তার পরিচ্ছন্ন রাজনীতির জন্য হিসাবের মধ্যে রাখেন। সব মিলিয়ে নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তার কর্মকা- নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক মহলে একটা কথা বেশ প্রচলিত আছে যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা, বিরোধিতা থাকতেই পারে কিন্তু ব্যক্তি নুরুল ইসলাম নাহিদের ব্যাপারে কোনো কথা বলতে গেলে ভেবে বলতে হবে। সময়ের পরিবর্তনে সেই অবস্থা বদলেছে।
সাম্প্রতিককালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বেশ কিছু বক্তব্য দিয়ে তার চিরাচরিত চেহারা থেকে সরে এসে দলের আঁতকা নেতা সাজা নেতাদের বলয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরাও তার বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন শিক্ষামন্ত্রী সম্ভবত তার অতীত দিনের গৌরব ভুলে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের উলটা পালটা, বেফাঁস কথাবার্তা বলা নেতাদের দ্বারা দিনদিন প্রভাবিত হয়ে পড়ছেন। বিষয়টিকে তারা দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন। কী বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী?
২০ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে ‘শিক্ষার উন্নত পরিবেশ, জঙ্গিবাদমুক্ত শিক্ষাঙ্গন’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বিভাগের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের উদ্দেশে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ছাত্রকে যিনি চিনবেন না, তার শিক্ষক হওয়ার কোনো যোগ্যতা থাকে না। আমরা এখন সেই তথ্য নিচ্ছি, কে তার সব ছাত্রকে নামে চেনেন না, চেহারায় চেনেন না, তার (শিক্ষকের) এমপিও হলে কেটে দেব, সরকারি চাকরি হলে বাতিল করে দেব। একই বক্তব্যে তিনি আরও বলেছেন, কোনো উপায় নেই। কারণ, আমার শিক্ষক যদি তার ছাত্রকে না চিনলেন, কেন জনগণের টাকা আমি তাদের দেব।
মন্ত্রী হিসেবে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের এ পর্যন্ত হয়ত মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এরপর তিনি বললেন ‘আমাকে কোনো কোনো শিক্ষক বলেন, এত ছাত্র আমরা কী করে প্রত্যেককে চিনব? আপনি আমার ছাত্রকে চিনবেন না, আর আপনি লেখাপড়া শেখাবেন, এটা কোনোদিন সম্ভব নয়। চিনতেই হবে।’
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মন্ত্রীর এই বক্তব্যের ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন। তারা বলছেন একজন শিক্ষকের পক্ষে তার হাজার হাজার ছাত্রকে ইচ্ছা থাকলেও চেনা সম্ভব নয়। মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যকে তারা দায়সারাগোছের হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা বলছেন এখন একজন নুরুল ইসলাম নাহিদকেও যদি চলতি হাওয়ায় মিশে গিয়ে আওয়ামী লীগের হাইব্রিড নেতাদের মতো হাল্কা কথা বলতে হয় তাহলে বিষয়টি দুঃখজনক।
একই বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম জঙ্গিবাদকে সমর্থন না করে বলেছেন, কোনো সন্তানকে তার মা-বাবার চেয়ে আর কে বেশি ভালোবাসতে পারে। সেই মা-বাবা তার সন্তানের লাশটা পর্যন্ত নিচ্ছেন না। বিপথগামী এসব জঙ্গির উদাহরণ টেনে মন্ত্রী বলেন, ‘তুমি এতই গুনার কাজ করেছ, এতই লজ্জার কাজ করেছ যে, মা-বাবা পর্যন্ত স্বীকার করছেন না। আর আল্লাহর তৈরি মানুষকে তুমি হত্যা করবা আর আল্লাহ তোমাকে নিয়ে হুরপরির কোলে বসাইয়া বেহেশত দিয়ে দেবে। এত সহজ নয়।’
শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ভর্তি নীতিমালা বাস্তবায়ন, যথাসময়ে ক্লাস শুরু, নির্দিষ্ট দিনে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, ৬০ দিনে ফল প্রকাশ, সৃজনশীল পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা, তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রভৃতি ব্যাপক কার্যক্রম, স্বচ্ছ গতিশীল শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট করে ঝরেপড়া বন্ধ করা ও শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথম বছরই ২০১০ শিক্ষাবর্ষে স্কুল ও মাদ্রাসায় সব ধরনের শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ১৯ কোটি বই বিনামূল্যে যথাসময়ে পৌঁছে দেওয়া যুগান্তকারী ঘটনা। এছাড়া ২০১৪ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী বিরোধী দলের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ফলে সৃষ্ট অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও সময়মতো পরীক্ষা গ্রহণ, ফল প্রকাশ এবং বছরের প্রথম দিনে সারা দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬৭২ জন শিক্ষার্থীর হাতে ২৯ কোটি ৯৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৮টি পাঠ্যপুস্তক তুলে দেওয়ার সাফল্যও তার মন্ত্রণালয়ের।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জাতীয় সংসদে (২৫ জুলাই, ২০১৬ ) আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইনের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনেছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘সাংসদরা অনুরোধ করেন বলে আমাদের নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দিতে হয়। এক কথায় সদস্যদের চাপে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার অনুমতি দিতে হয়। আমরা সে সময় বলে দিই অনুমতি দিচ্ছি, তবে বেতন দিতে পারব না। যদিও আমরা নৈতিকভাবে বেতন দিতে বাধ্য।’ সংসদে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘এবার যারা এসএসসি পাস করেছে, তাদের সবাই ভর্তি হওয়ার পরেও সারা দেশের সাত লাখ আসন ফাঁকা আছে। বোঝেন তাহলে কত কলেজ আমরা খুলেছি। ৪৮টি প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য একজন ছাত্রও আবেদন করেনি। ৭০০ প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছে এক থেকে দুজন করে। তবুও নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতি এবং শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার বিষয়টি সমন্বয় করতে নতুন আইন করা হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ যদি তার সারা জীবনের অর্জনকে পথের ধুলোয় বিসর্জন দিতে চান তাহলে এখন তিনি যেভাবে অতিকথনের পরীক্ষায় নেমেছেন সেটা ধরে রাখলে তাকে আর কিছুই করতে হবে না। এখন দেখার বিষয় শিক্ষামন্ত্রী তার পরীক্ষা কতটুকু সফলভাবে দিতে পারেন। মাহবুব রেজা : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক