শোকরানা জানাতে হচ্ছে শুরুতেই। কারণ পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে পেরেছি। ঈদে যারা ঘরমুখো হয়েছিলেন, আমি সেই দলে ছিলাম না। ঢাকা ছেড়ে ছিলাম ঈদের তৃতীয় দিন। ফিরে এসেছি পঞ্চম দিন। দিনটি ছিল শনিবার। আমার গন্তব্য ছিল উত্তরমুখী। ঈদের তৃতীয় দিন সকাল আটটায় ঢাকা ছেড়ে আমি দশটায় সিরাজগঞ্জ পৌঁছে যাই। বাকিপথ অর্থাৎ নীলফামারীর চিলাহাটি, ধীমেতালে চলেও পৌঁছে যাই বিকাল চারটায়। উত্তরবঙ্গমুখী পথে যানবাহন কম। পথে মানুষ কম। বাজার তখনো জমতে শুরু করেনি।
ঈদের আমেজ, ছুটির ঝিমুনি ছিল। বিপরীত দিক থেকে ঢাকায় ফেরার পথেও পরিবহনের ভিড় কম ছিল। শহরে ফেরার তাড়া ছিল না। সামনে শুক্র ও শনিবার ছিল, ওই দুই দিন ছুটি কাটিয়ে ফেরার পরিকল্পনা ছিল হয়ত অনেকের। এছাড়া এবার শহর ছেড়ে বাড়ি পৌঁছবার যে ঝক্কি, বিড়ম্বনা, দুর্ভোগ ছিল, তাতে খুব তাড়া না থাকলে একটু জিরিয়ে নিয়েই হয়ত রাজধানীতে ফিরতে চাচ্ছিলেন অনেকে। তবে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার কবলে খুব একটা পড়তে হয়নি ঘরমুখো মানুষকে। ফিরতি পথেই প্রাণ হারাতে হয়েছে যাত্রীদের। এবারের ঈদ যাত্রায় ২১১টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬৫ জন। ৭ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
উত্তরবঙ্গ যাওয়ার পথে দেখছিলাম বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পাশে বিআরটিসির দোতলা বাস দাঁড়িয়ে আছে। সংখ্যায় বেশ কয়টি। এই বাসগুলো সবই ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। বাসগুলোর অবস্থাও জরাজীর্ণ। একই সঙ্গে রাজধানীর মিরপুর, গুলশান, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর রুটে চলাচলকারী বাস, মিনিবাস, লেগুনাকেও দেখা গেল। কয়েকটি বাস, মিনিবাস, লেগুনাকে ঢাকায় ফিরতেও দেখছিলাম। এই পরিবহনগুলোর মহাসড়কে চলাচলের অভ্যাস নেই। যারা চালক তারা শহরের রাস্তায় চালাতে অভ্যস্ত। মহাসড়কের ভাষা তারা জানে না। একইভাবে পরিবহনগুলোর প্রায় ৯৮ শতাংশেরই ফিটনেস নেই। মহাসড়কে যে গতি নিয়ে চলার কথা, সেই গতিতে তারা চলতে পারে না। বরং চলার চেষ্টা করতে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে আর গতিকে সামাল দিতে পারে না। যার ফলাফল দুর্ঘটনা।
ঈদের পঞ্চম দিন রাজধানী ফিরে আসার সময় রংপুর পর্যন্ত এসেই আতঙ্কিত হলাম। সকাল দশটাতেই শংকিত হয়ে পড়লাম, পরের দিনের সূর্যোদয়ের মধ্যে ঢাকা পৌঁছতে পারা যাবে তো? এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকা এবং টাঙ্গাইলে সড়ক দুর্ঘটনার খবর পেলাম। একই পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যুর খবর আমাদের আরো আতঙ্কিত করে তোলে। রংপুর পীরগঞ্জের যানজট ডিঙিয়ে গাইবান্ধা,পলাশবাড়িতে পা টিপে টিপে চলার মতো করে এগুতে হয়েছে। তবে সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা হলো ঢাকামুখী পরিবহনের বৈচিত্র্য।
মহাসড়কে নিয়মিত চলাচলকারী উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটের বাস, প্রাইভেটকার, বিআরটিসির দোতলা বাস, ঢাকা মহানগরের রুটের বাস, লেগুনা, মিনি ট্রাক সবাই ছুটছে ঢাকার দিকে। গতি বেপরোয়া, কেউ লেইন মেনে চলছে না। পথের মাঝখানে বাহন রেখে মই দিয়ে যাত্রী তোলা সবাই দেখতে হচ্ছিল। এই বিশৃঙ্খল ছুটে চলা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য হাইওয়ে পুলিশ বা স্থানীয় পুলিশকে তৎপর দেখা যায়নি। কোথাও কোথাও ট্রাফিক পুলিশ দেখা গেছে। তবে একা কোনো ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে এই বিশৃঙ্খলা সামাল দেওয়া সম্ভবও নয়। স্থানীয় থানা ও জেলা পুলিশের পেট্রলভ্যানকে ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে দেখা গেছে, তবে যানজট বা বেপরোয়া পরিবহনকে সামাল দিতে নয়, তারা সামলাচ্ছিলেন ভিআইপিদের। যানজট ঠেলে ভিআইপিদের বের করে দিয়ে আসতে গিয়ে তারা যানজটকে আরো ঘন করছিলেন।
আমাদের মহাসড়কগুলো রোগাক্রান্ত। মহাসড়কের প্রকৃত চরিত্র বেশিরভাগেরই নেই। চলনবিলের ওপর দিয়ে যাওয়া নাটোর-রাজশাহীমুখী মহাসড়কটি প্রকৃত চরিত্রের অনেকটা কাছাকাছি। তারপরও ওই মহাসড়কও দুর্ঘটনামুক্ত নয়। অন্যান্য মহাসড়কে সার্ভিস সড়ক নেই। সার্ভিস সড়ক দিয়ে ধীরগতির যানবাহন চলাচল করার কথা। সার্ভিস সড়ক না থাকার কারণে মূল মহাসড়ক দিয়ে রকমারি গতির পরিবহন চলছে। ফলে তাদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়ে পড়ছে অনিবার্য। মহাসড়কের পাশে বাজার-হাট বসানো, ত্রুটিযুক্ত সেতু-কালভার্ট এবং বিপজ্জনক বাঁক তো আছেই। সড়ক- মহাসড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ অনেক এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো কোনো ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত স্থানের ত্রুটি সারানোর পর আবার তৈরি হয়েছে নতুন ব্ল্যাক স্পট। কিন্তু নতুন ব্ল্যাক স্পটগুলোর কথা জানে না সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
১৯৯৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত নির্ণয় করে এক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট ২০৯টি ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করে। ইমপ্রুভমেন্ট অব রোড সেইফটি অ্যাট ব্ল্যাক স্পট অন ন্যাশনাল হাইওয়ে নামে প্রকল্পে ২০১৪ সালে অনুমোদন দেয় একনেক। সেখানে চিহ্নিত করা হয় ১৪৪টি ব্ল্যাক স্পট, বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৬৫ কোটি টাকা। ততদিনে অনেক বাঁকা সড়ক যেমন সোজা হয়েছে, তেমনি পরিধিও বেড়েছে অনেক সড়কের। দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকার পরিবর্তন ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রকল্প পরিচালকের বরাবর তিনটি চিঠি পাঠান। যেখানে উল্লেখ করা হয়, সাত বছরের উপাত্তের ভিত্তিতে ব্ল্যাক স্পটে কাজ করলে তা ফলপ্রসূ হবে না। কিন্তু এই চিঠিকে আমলে না নিয়েই পুরনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই কাজ করে যাচ্ছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
আমরা দেখতে পাই উৎসব এলেই যোগাযোগমন্ত্রী ছুটোছুটি করতে শুরু করেন। সড়কে-মহাসড়কে ঘুরে হুমকি, ধমক দিতে থাকেন নানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। তার জন্য দুর্ভাগ্য হলো সড়ক ও জনপথ, সেতু বিভাগের কর্মচারী-কর্মকর্তারা তার কথা শুনলেও পুলিশ শুনছে না। পুলিশকে তিনি ধমক বা নির্দেশ দেওয়ারও দুঃসাহস দেখান না। কারণ পুলিশের আলাদা মন্ত্রী আছেন। স্থানীয় প্রশাসনের জবাবদিহিতা অন্যত্র। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বাস মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধেও তিনি কোনো টু-শব্দটি করেন না। কারণ তারা আবার অন্য মন্ত্রীর ছায়ায় চলেন। মহাসড়ক তদারকি আসলে একক মালিকানায় চলতে পারে না। কারণ এখানে নানা সংস্থার সম্পৃক্ততা রয়েছে। কিন্তু সেই সংস্থাগুলো নিষ্ক্রিয় থাকায় তাদেরকে সমন্বিত করার ব্যর্থতায় সড়কে-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিলকে দীর্ঘ করছে। তুষার আবদুল্লাহ : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি