চৌদ্দ ঘণ্টা আকাশে উড়ে আমাদের প্লেনটা শেষ পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক পৌঁছেছে। টানা চৌদ্দ ঘণ্টা প্লেনের ঘুপচি একটা সিটে বসে থাকা সহজ কথা নয়। সময় কাটানোর নানারকম ব্যবস্থা, তারপরও সময় কাটাতে চায় না। অনেকক্ষণ পর ঘড়ি দেখি, মনে হয় নিশ্চয়ই এর মাঝে ঘণ্টা খানেক কেটে গেছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি পনেরো মিনিটও পার হয়নি!
এয়ারপোর্টে নামার পর ইমিগ্রেশানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রত্যেকবারই নূতন নূতন নিয়মকানুন থাকে। এবারেও নূতন নিয়ম, যাত্রীদের নিজেদের পাসপোর্ট নিজেদের স্ক্যান করে নিতে হবে। কীভাবে করতে হবে খুব পরিস্কার করে লেখা আছে, সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। কিন্তু আমাদের পাসপোর্ট আর স্ক্যান হয় না। দেখতে দেখতে বিশাল হলঘর প্রায় খালি হয়ে গেছে, শুধু আমি আর আমার স্ত্রী পাসপোর্ট নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করছি! কিছুতেই যখন পাসপোর্ট স্ক্যান করতে পারি না, তখন শেষ পর্যন্ত লাজ-লজ্জা ভুলে, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ অফিসারের কাছে গিয়ে মিন মিন করে বললাম, “আমার পাসপোর্ট কিছুতেই স্ক্যান হচ্ছে না।”
আমার কথা শেষ করার আগেই পুলিশ অফিসার আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, “আপনি জাফর ইকবাল না?”
পুলিশ অফিসার বাঙালি। শুধু যে বাঙালি তা নয়, আমাকে চেনে। দেশের এয়ারপোর্টে এটা অনেকবার ঘটেছে। কিন্তু নিউ ইয়র্কের এয়ারপোর্টেও এটা ঘটবে কল্পনা করিনি।
বলা বাহুল্য, এরপর আমার পাসপোর্ট মূহূর্তে স্ক্যান হয়ে গেল (কী কারণ জানা নেই, আমার পাসপোর্টে পুরনো পাসপোর্ট লাগানো থাকে, সে কারণে সাইজ মোটা এবং স্ক্যান করার জন্যে যন্ত্রের মাঝে ঢোকানো যায় না! এরকম অবস্থায় কী করতে হবে আমাদের বাংলাদেশের বাঙালি পুলিশ অফিসার সেটা শিখিয়ে দিল।) বিদেশের মাটিতে নামার পর নানারকম আশংকায় সব সময় আমার বুক ধুকপুক করতে থাকে। এবারে মূহূর্তের মাঝে সব দুশ্চিন্তা, সব আশংকা দূর হয়ে গেল। মনে হল এই শহরটি বুঝি অপরিচিত, নির্বান্ধব, স্বার্থপর নিঃসঙ্গে একটি শহর নয়– এই শহরে আমার দেশের মানুষ আছে, দেশের বাইরে তারা দেশ তৈরি করে রাখে।
আমার ধারণা যে ভুল নয় সেটি কয়েক ঘণ্টার মাঝে আমি আবার তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম। যারা খোঁজ-খবর রাখে তারা সবাই জানে, সারা পৃথিবীতেই এখন উবার কিংবা লিফট নামে নূতন সার্ভিস শুরু হয়েছে। স্মার্ট ফোনে তার ‘এপস’ বসিয়ে নিলেই সেটা ব্যবহার করে গাড়ি ডাকা যায়। ভাড়া নিয়ে দরদাম করতে হয় না। ক্রেডিট কার্ড থেকে সঠিক ভাড়া কেটে নেয়, তাই কোনো টাকা-পয়সার লেনদেন করতে হয় না। স্মার্ট ফোনের ম্যাপে গাড়িটা কোনদিকে আসছে সেটা দেখা যায়, গাড়িটার নম্বর কত, ড্রাইভার কে, তার নাম কী, টেলিফোন নম্বর কত সেটাও টেলিফোনের স্ক্রিনে উঠে আসে।
নিউইয়র্কে পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টার মাঝে আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে বলে আমার মেয়ে এরকম একটা গাড়ি ডেকে পাঠিয়েছে। সেটাতে ওঠার আগেই টের পেলাম গাড়ির ড্রাইভার বাংলাদেশের তরুণ। আমাকে দেখে তার সে কী আনন্দ! গাড়ি চালাতে চালাতে তার কত রকম কথা। গাড়ি থেকে নামার পর সে আমার মেয়েকে বলল, তার কোম্পানিকে সে জানিয়ে দেবে যেন আমাদের কাছ থেকে কোনো ভাড়া কেটে নেওয়া না হয়। আমি অনেক কষ্ট করে তাকে থামালাম।
আমি দুই সপ্তাহের মতো নিউ ইয়র্ক শহরে ছিলাম। যখনই ঘর থেকে বের হয়েছি দেশের মানুষের সাথে দেখা হয়েছে। কখনও ফল-বিক্রেতা, কখনও রেস্টুরেন্টের কর্মচারী, কখনও ট্রাফিক পুলিশ, কখনও মিউজিয়ামের গার্ড, কখনও সাবওয়ের সহযাত্রী। পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে এসে দেশের মানুষ এবং তাদের মমতাটুকু হৃদয়টা অন্যভাবে পরিপূর্ণ করে তুলে।
২.
আমেরিকা দেশটি হচ্ছে গাড়ির দেশ। এই দেশে গাড়িটি চালিয়ে শুধুমাত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়নি। আমেরিকায় গাড়ি হচ্ছে সেই দেশের কালচারের একটা অংশ।মাঝখানে পেট্রোলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে তেল-বান্ধব ছোট গাড়ির প্রচলন হতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখন পেট্রলের দাম আবার কমেছে বলে বিশাল বিশাল বিলাসী গাড়িও আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। খাঁটি আমেরিকানদের সম্ভবত নিউ ইয়র্ক শহরে গাড়ি চালাতে সমস্যা হয় না। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টা রীতিমতো দুঃস্বপ্ন মনে হয়।
তবে যারা নিউ ইয়র্ক শহরে থাকে তারা অবশ্যি গাড়ি ব্যবহার না করেই দিন কাটাতে পারে। কারণ পুরো শহরের মাটির নিচে মেট্রো ট্রেন মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে আছে। আমি যে দুই সপ্তাহ নিউ ইয়র্ক শহরে ছিলাম, এই মেট্রো ট্রেনেই চলাফেরা করেছি।
নিউ ইয়র্ক শহরের নূতন প্রজন্ম অবশ্যি চলাফেরার জন্যে নূতন আরেকটি সমাধান খুঁজে পেয়েছে। সেটি হচ্ছে বাইসাইকেল। আমি যখন প্রথম জানতে পারলাম আমার মেয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছে, আমি তখন জানতে চাইলাম সাইকেলটি সে কোথায় রেখেছে। রাস্তার পাশে কোনো একটা ল্যাম্প পোস্টে সাইকেলটি বেঁধে রেখে এলে কিছুক্ষণের মাঝেই সাইকেলের ফ্রেম ছাড়া বাকি সব কিছু হাওয়া হয়ে যায়। (আমার ধারণা এই ব্যাপারে নিউ ইয়র্কের মানুষের দক্ষতা আমাদের দেশের মানুষ থেকে বেশি!)
আমার মেয়ে বলল, সে নিউ ইয়র্ক শহরে এসে কোনো বাইসাইকেল কিনেনি। যখনই দরকার হয় একটা ভাড়া নিয়ে নেয়। বিষয়টা আমার কাছে যথেষ্ট বিদঘুটে মনে হল। সাইকেল ভাড়া নিলেও ফেরৎ না দেওয়া পর্যন্ত সেটাকে কোথাও না কোথাও নিজের হেফাজতে রাখতে হয়। পুরো সাইকেল ভাড়া নিয়ে শুধু তার কংকালটা ফেরৎ দেওয়া হলে সাইকেল ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা দুইদিনে লাটে উঠে যাবে।
আমার মেয়ের কাছ থেকে বাইসাইকেল ভাড়া দেওয়া-নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটির বর্ণনা শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। সিটি বাইক নাম দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের অসংখ্য জায়গায় সাইকেল স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। যার যখন দরকার হয় এক স্ট্যান্ড থেকে ভাড়া নেয়। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর অন্য স্ট্যান্ডে জমা দিয়ে দেয়। কোথাও কোনো মানুষ নেই, পুরো ব্যাটারটা ইলেকট্রনিক। কে কোথা থেকে ভাড়া নিয়েছে, কোথায় ফেরৎ দিয়েছে, সব কিছু ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে হিসাবে রাখা হচ্ছে এবং ক্রেডিট কার্ড থেকে ভাড়ার টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে।
পুরো শহরে অল্প কয়েকটা জায়গায় সিটি-বাইকের স্ট্যান্ড থাকলে এই প্রক্রিয়াটা মোটেও কাজ করত না কিন্তু যেহেতু শহরের প্রায় কোনায় কোনায় সিটি বাইক স্ট্যান্ড বসানো হয়েছে, কাজেই এখন কাউকেই বাইসাইকেলটা কোথা থেকে ভাড়া নিয়ে কোথায় ফেরৎ দেবে সেটা নিয়ে ভাবনা করতে হবে না। কাছাকাছি কোথায় সিটি বাইক স্ট্যান্ড আছে সেটা জানার জন্যে দরকার শুধু একটা স্মার্ট ফোন!
নিউ ইয়র্ক শহরের একটা সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে এই সিটি বাইক। তাদের জন্যে আলাদাভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। ডিজাইনটিও চমৎকার। একজন মানুষ চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্যে স্যুট পরেও এই সাইকেল চালিয়ে যেতে পারবে।
নিউ ইয়র্ক শহরের কত বড় বড় বিষয় থাকার পরও আমি ইচ্ছে করে সিটি বাইক নিয়ে আমার উচ্ছ্বাসটুকু প্রকাশ করেছি। আমার মনে হয় আমাদের ঢাকা শহরেও কোনো একজন উদ্যোক্তা এই ধরনের একটা উদ্যোগ নিলে সেটি শহরের মানুষের জন্যে অনেক বড় একটা আশীর্বাদ হতে পারত। (আমাদের দেশের জন্যে হুবহু এই মডেলটি হয়তো কাজ করবে না। একটু অন্য রকমভাবে শুরু করতে হবে। যেমন আমাদের এটিএম মেশিন, সারা পৃথিবীতেই এটিএম মেশিন কারও পাহারা দিতে হয় না, আমাদের দেশে সেখানে সার্বক্ষণিকভাবে কাউকে না কাউকে পাহারা দিতে হয়)।
৩.
এটি আমেরিকার নির্বাচনী বছর। আমেরিকার ইতিহাসের যে কোনো নির্বাচন থেকে এটি অন্য রকম। কারণ এবারে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামে একজন ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে আমেরিকার প্রধান দুই দলের একটি, রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচন করছেন। আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে আমি যখন আমেরিকাতে ছিলাম তখন থেকে এই মানুষটিকে চিনি। তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, স্থূল রুচির বাকসর্বস্ব একজন ব্যবসায়ী।
প্রথম যখন আমি শুনতে পেয়েছিলাম যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টি থেকে নমিনেশান পাবার চেষ্টা করছের, তখন পুরো বিষয়টা একটা উৎকট রসিকতা হিসেবে ধরে নিয়ে আমি উড়িয়ে দিয়েছিলাম। এখন যখন নির্বাচন প্রায় চলে এসেছে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প সত্যি সত্যি একজন প্রার্থী, তখন পুরো ব্যাপারটা রসিকতার পর্যায়ে না থেকে বিভীষিকার পর্যায়ে চলে এসেছে। আমেরিকায় সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি বিদ্বেষ কিংবা সাম্প্রদায়িকতা, আতংক এবং ঘৃণা এগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেকশনে জিতে গেলে অন্ধকার জগতের এই সব গ্লানি হঠাৎ করে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার মাঝে চলে আসবে!
আমি যতদিন ছিলাম তার মাঝে একদিনও একটি মানুষকে পাইনি যে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে ইতিবাচক কোনো কথা বলেছে। সত্যি কথা বলতে কী, একজন অধ্যাপককে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা জিজ্ঞেস করার পর তাকে আমি আক্ষরিক অর্থে শিউরে উঠতে দেখেছি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নানা রকম প্রচারণা চলছে। সবচেয়ে মজার প্রচারণাটা শুনেছি একজন গৃহহীন ভিক্ষুকের কাছ থেকে। সে পথের মোড়ে একটা কাগজ নিয়ে বসে থাকে। কাগজে লেখা, “আমাকে যদি এক ডলার না দাও তাহলে আমি কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে দেব!”
আমি যতদূর জানি এই হুমকি কাজে দিয়েছে! প্রচুর মানুষ এই ভিক্ষুককে এক ডলার করে দিয়ে যাচ্ছে।
৪.
একদিন বিকেলে আমার ছেলে আমাদেরকে জানাল সে একটি বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে যাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন এই ব্যাপারগুলো বুঝি শুধু আমাদের দেশের জন্যে একচেটিয়া, আমেরিকাতেও যে বিক্ষোভ মিছিল হতে পারে সেটা অনুমান করিনি। আমি জানতে চাইলাম, ‘কীসের বিক্ষোভ মিছিল?’ উত্তরে সে আমাকে যে কাহিনি শোনাল সেটি অবিশ্বাস্য!
তার একজন সহকর্মী (ঘটনাক্রমে এই সহকর্মীর সাথে আমারও পরিচয় হয়েছে) লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটি এট ব্রুকলিন নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। আমেরিকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদ মোটামুটি সোনার হরিণ, সেখানে যোগ দিতে পারা কঠিন। কাজেই এ রকম একটি পদে যোগ দেওয়ার পরই একজন তাদের জীবন শুরু করার পরিকল্পনা করতে পারে। লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে একটি নূতন বেতন স্কেল তৈরি করেছে। শিক্ষকদের সেটা পছন্দ হয়নি। তাই তারা সেটা গ্রহণ করতে রাজি হননি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট কলমের এক খোঁচায় চারশত শিক্ষককে বরখাস্ত করে দিলেন!
মূহূর্তের মাঝে একজন নয় দুইজন নয়, চারশত শিক্ষক বেকার। সবাই একেবারে পথে বসে গেছেন। যেহেতু আমেরিকার একাডেমিক জগতে অসংখ্য মানুষ চাকরির খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভালো চাকরি না পেয়ে ছোটখাটো কাজ করে সময় কাটাচ্ছে, তাই এই চারশ শিক্ষকদের বদলে নূতন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া খুব যে অসম্ভব ব্যাপার তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার জন্যে সে রকম শিক্ষকদের নেওয়া শুরু হয়েছে। অনেকেই খণ্ডকালীন নিয়োগ পেয়ে কাজও করতে শুরু করেছে।
বলাবাহুল্য, চাকরি হারানো চারশত শিক্ষক, তাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এই অবিশ্বাস্য ঘটনার প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে! যে জন্যে বিক্ষোভ মিছিল এবং আমার ছেলেও সেই বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে যাচ্ছে। আমার সময় খাকলে আমিও যোগ দিতাম।
শেষ খবর অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত বরখাস্ত করে দেওয়া চারশত শিক্ষককে আবার ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট (আমাদের দেশে আমরা বলি ভাইস চ্যান্সেলর)– যে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন– তাকে প্রচুর গালমন্দ শুনতে হয়েছে। সাধারণ শিক্ষক এবং ছাত্রেরা বিক্ষোভ মিছিলে তাকে একটা ‘ধাড়ি ইদুঁর’ বলে ডাকছে। আমি যতদূর জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এখনও তার নিজের পদে বহাল আছেন।
হার্ভাডের প্রেসিডেন্টকে শুধুমাত্র ছেলে এবং মেয়ের মেধার তুলনা করতে গিয়ে একটি বেফাঁস কথা বলার জন্যে চাকরি হারাতে হয়েছিল। আমার ধারণা লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির এই ‘ধাড়ি ইদুঁর’ও সেখানে খুব বেশি দিন থাকতে পারবেন না। আমরা আমাদের ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরদের নিয়ে মাথা চাপড়াই। মনে হচ্ছে সমস্যাটি দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক!
৫.
শিক্ষক হওয়ার প্রধান আনন্দ হচ্ছে সারা পৃথিবীতে তার ছাত্রছাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। কাজেই নিউ ইয়র্ক যাবার পর এই ছাত্রছাত্রীরা যে আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সেটি এমন কিছু অবাক ব্যাপার নয়। সে কারণে একদিন বিকেলে তাদের সাথে দেখা করার জন্যে আমাদের ‘জ্যাকসন হাইট’ নামে একটা জায়গায় যেতে হল। (যারা জ্যাকসন হাইটের নাম শুনেননি তাদের বলা যায়, এটি হচ্ছে নিউ ইয়র্কের মিনি বাংলাদেশ!)
জ্যাকসন হাইট জায়গাটি আমি যেখানে আছি সেখান থেকে অনেক দূর, কিন্তু মেট্রো ট্রেনে খুব সহজেই যাওয়া যায়। আমি সেভাবেই যাব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। আমার ছাত্রছাত্রীদের তাতে প্রবল আপত্তি এবং তারা গাড়ি না করে আমাদের নেবে না। এর মাঝে নিশ্চয়ই যথাযথ সম্মান দেখানোর ব্যাপার আছে, যেটা আমি জানি না। কাজেই যে দূরত্বটা অল্প সময়ে অতিক্রম করতে পারতাম, গাড়ি করে ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে অনেক সময় নিয়ে অতিক্রম করতে হল।
যাই হোক, ছাত্রছাত্রীদের সাথে গল্পগুজব করে, খেয়ে-দেয়ে, ছবি তুলে চমৎকার একটি সন্ধ্যা কাটিয়ে আমরা ফিরে আসতে প্রস্তুত হয়েছি। আমরা আবার ছাত্রছাত্রীদের বলছি, আমাদের মেট্রো ট্রেনে তুলে দিতে তারা আবার রাজি হল না, গাড়ি করে আমাদের এপার্টমেন্টে ফিরিয়ে দেবে। যখন মাঝামাঝি এসেছি, তখন হঠাৎ করে আমার ছেলে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কোথায়?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম “কেন, কী হয়েছে?”
আমার ছেলে বলল, “ম্যানহাটানের মাঝখানে বোমা ফেটেছে, খবরদার ঐ পথে ফিরে আসার চেষ্টা কর না।”
শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। দেশে জঙ্গি এবং তাদের উৎপাতের খবর পড়তে পড়তে আমাদের সবার জীবন অতীষ্ঠ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম নিউ ইয়র্ক এসে অন্তত দুটি সপ্তাহ জঙ্গিদের উৎপাতের খবর পড়তে হবে না। কিন্তু আমাদের কপাল! এখানেও সেই একই জঙ্গি একই উৎপাত!
ছাত্রছাত্রীরা আমাদের কথা না শুনে মেট্রো ট্রেনে তুলে না দেওয়ার কারণে আমরা খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম। কারণ বোমা ফাটার সাথে সাথে মেট্রো রেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অসংখ্য মানুষ অন্য কোনোভাবে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছিল বলে ট্যাক্সি বা ক্যাবও পাওয়া যাচ্ছিল না। কাজেই আমাদের হয়তো পুরো পথটুকু পায়ে হেঁটে ফিরে আসতে হত। আমাদের ছাত্রেরা তাদের গাড়িতে করে নিরাপদে একেবারে আমাদের এপার্টমেন্টের দরজায় পৌঁছে দিয়ে গেল। আমার ছেলের অবশ্যি এত সৌভাগ্য হয়নি। পায়ে হেঁটে এবং একজন দয়ালু ক্যাব ড্রাইভারের সহযোগিতায় অনেক কষ্টে গভীর রাতে বাসায় ফিরে আসতে পেরেছিল।
যখনই আমাদের দেশে একটা জঙ্গি হামলা হয় বাংলাদেশ সরকার তখন ঘোষণা দেয়, এটি স্থানীয় ঘটনা, আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এখানেও তাই হল। নিউ ইয়র্কের মেয়র ঘোষণা দিলেন, এটি স্থানীয় ঘটনা, আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।