নয় বছর পূর্বে মাহফুজের এর সাথে বিয়ে হয় মালার। বিয়ে সামাজিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এবং পবিত্র বন্ধন হিসেবে চিহ্নিত হলেও বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। অসচেতনতা ও পারিপার্শ্বিক জ্ঞান না থাকার কারণে সমাজে অনেক দুর্ঘটনা আজকাল ঘটতে দেখা যায়।
মাহফুজ-মালার এ সুদীর্ঘ নয় বছর বিবাহিত জীবনে তাদের ছয় বছরের একটি ছেলে সন্তান আছে। ছেলের নাম আরাফ। আরাফকে তারা আদর-যতেœ লালন-পালন করে ভবিষ্যতে ভাল মানুষ গড়ার স্বপ্ন দেখে। শহরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরাফকে ভর্র্তি করে দেন তার বাবা-মা। বাবা মাহফুজ বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। মা গৃহিনী। তাই মাই ছেলেকে স্কুলে আনা-নেয়া করেন।
মাহফুজ যখন মালাকে বিয়ে করে তখন শশুর বাড়ি থেকে তেমন উপঢৌকন পায়নি। তাই সে শশুরবাড়ি থেকে অনেক কিছু পাওয়ার কথা বলে প্রায়ই মালার সাথে ঝগড়া করে। মালা মানসিকভাবে সব সময় খুব কষ্টে থাকে। তারপরও মালা ধৈর্যের সাথে নয় বছর সংসার জীবন প্রতিপালন করে চলেছে। মাহফুজ অফিসে বের হয়ার সময় মালাকে বলে তোমার শুধু ছেলেকে স্কুলে আনা নেয়ার কাজ আর স্কুল থেকে ফিরে এসে সারাদিন শুয়ে শুয়ে টিভি সিরিয়াল দেখা। আর প্রতিদিন আমাকে সকালে অফিসে যেতে হয় আর বাসে ঝুলে সেই সন্ধায় ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরতে হয়। মালার সংসার জীবনে মাহফুজের সাথে ঝগড়া নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিদিনের মত মালা সকালে মাহফুজের অফিসে যাওয়ার পূর্বে নাস্তা তৈরি করে দেয় কিন্তু প্রায়ই ঝগড়া বিবাদ করে মাহফুজ নাস্তা না খেয়ে অফিসে চলে যায়। মালা মাহফুজের কথায় মনে কষ্ট নিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ছেলেকে গুছিয়ে স্কুলে রওনা দেয়। এভাবেই চলছে তাদের দাম্পত্য জীবন।
দাম্পত্য জীবনে মানসিক নির্যাতন যে কত কষ্টের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এ ধরনের যৌতুকের ঘটনা আমাদের সমাজে প্রায়ই ঘটে থাকে। পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝি ও অসচেতনার কারণে সংসার জীবন ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে পারে। বর্তমান শিক্ষিত সমাজে কিছু যৌতুকলোভী পুরুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে অহেতুক ঝগড়া বিবাদ করে, স্ত্রীকে মানসিক নির্যাতন করে। এ ধরনের নির্যাতনের ফলে একসময় স্ত্রী একটি গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। ফলে পারিবারিক জীবনে নেমে আসে চরম অশান্তি। এ সমস্যা সফলভাবে মোকাবিলার জন্য যেমন প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা তেমন দরকার মানসিকতার পরিবর্তন।
নিউরোলজী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। পারিবারিক নির্যাতন একটি ব্যক্তিগত বিষয় মনে করে লজ্জা, সংকোচ, ভয়ভীতি ও পারিবারিক মান-সম্মানের কারণে যত ঘটনা ঘটে তার খুব কম সংখ্যাই প্রকাশ পায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী নিজেও নির্যাতনকে নিয়তি বলেই মেনে নেয়। তাই তারা পারিবারিক নির্যাতন নিরবেই সহ্য করে। পারিবারিক নির্যাতনে অনেক নারী মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে ডাক্তারের সরণাপন্ন হচ্ছে। পারিবারিক নির্যাতন নারীর স্বাধীনতা, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্যতম অন্তরায়।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৭ শতাংশ নারী বিবাহিত জীবনে স্বামী অথবা নিকট আত্মীয় দ্বারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমাদের দেশে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকে ছেলে ও মেয়েদের শিশুদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি কারা হয়। মেয়েরা থাকবে ঘরের চার দেয়ালের ভিতর এবং সেভাবেই তাদের শিক্ষা দেয়া হয়। অন্যদিকে ছেলেরা খেলাধুলা করবে পরিশ্রমী হবে এ সকল বিষয়ে উৎসাহিত করা হয়। অথাৎ বৈষম্যগুলো নিজ পরিবার থেকেই তৈরি করে দেয়া হয়। বর্তমানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানা প্রতিবন্ধকতা সত্বেও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নে তারা এখন আর পিছিয়ে নেই, এগিয়েছে অনেক দুর।
দাম্পত্য নির্যাতন অনেক সংসারের দৈনন্দিন ঘটনা হলেও একে সবসময় আড়াল করে রাখা হয়। উপরন্তু পারিবারিক ছোটখাটো যন্ত্রনা অধিকাংশ সংসারে তথাকথিত ব্যক্তিগত বিষয়ের গন্ডীতে আবদ্ধ করে ফেলার প্রবণতা থাকায় তা হয়ে ওঠে আরো প্রতিরোধহীন। দাম্পত্য জীবনে মানসিক নির্যাতন একজন নারীর জীবনকে নিরব ঘাতকের মত দুর্বিষহ করে তোলে, তার সক্ষমতার অপমৃত্যু ঘটায়। এজন্য গোটা পরিবারকেই এর মাশুল দিতে হয়।
দাম্পত্য জীবনের মানসিক নির্যাতন ঠেকাতে হলে মানবিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। সরকার নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক আইন প্রণয়ন করেছে। নারীদের উচিত আইনের আশ্রয় নেওয়া। গ্রামাঞ্চলে অনেকেই এসব আইন সম্পর্কে অবগত নয় তাদের এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি নির্যাতন প্রতিরোধে ও নারীর অধিকার সংরক্ষণে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় এবং তৃণমূল পর্যায়ে নারী নির্যাতনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে সবাইকে সচেতন করতে হবে। এ ব্যাপারে সভা সমাবেশ, উঠোন বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া নারী নির্যাতন বিরোধী ফিচার, কার্টুন, বিজ্ঞাপন, অডিও-ভিজ্যুয়ল, টিভি স্পট, নাটক, গান গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নারী নির্যাতন পরিহার করে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সচেষ্ট হতে হবে।
পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার