মায়ের কোনো বিকল্প নেই। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ এটি একটি শাশ্বত বাণী। এ প্রমাণিত সত্যকে যেমন এড়ানো যায় না, তেমনি সন্তান পালনে মায়ের অতুলনীয় ভূমিকা বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। নারী ও পুরুষের স্বভাবসুলভ আচরণ জন্মগত। তবে কিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়ে সেটা নিতান্তই নগণ্য।
একটি শিশুর জীবনে মায়ের গুরুত্ব সবচাইতে বেশি। জন্মের পর তার পরিচর্যা থেকে শুরু করে তাকে মানুষ করার বেশির ভাগ দায়িত্ব মায়েরই। বাবারা অর্থ উপার্জনের সাথে সম্পৃক্ত বলে দায়িত্বের ধরণ একটু ভিন্ন। মা-হারা সন্তান বাবার সাহচর্যে, লালনপালনে প্রকৃত মানুষের মতো মানুষ হয়েছে এ রকমটিও অবশ্যই হয়। স্বভাব চরিত্রে, চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে, ধ্যান-ধারণায় একে অন্যের থেকে উল্লেখ করার মতো কিছু পার্থক্য নিয়েই নারী ও পুরুষ পৃথিবীতে আসে।
শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে, জীবনে গতি আনে, নতুন পথ দেখিয়ে জীবন গড়তে সহায়তা করে। সন্তান জন্মের পর সে একেবারেই কাদামাটির মতো থাকে, তাকে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করতে হয়। সন্তান গড়ে তোলার জন্য জ্ঞান অর্জন আবশ্যক, যা তাকে সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করে। মায়ের মন অত্যন্ত কোমল প্রকৃতির যা সন্তানকে আকৃষ্ট করে। মায়া-মমতায় ঘিরে সন্তানকে মাতা-পিতা এগিয়ে যেতে পথ দেখায়। একজন শিক্ষিত মা-ই পারে তার সন্তানের সুপ্ত মনোবৃত্তির বিকাশ ঘটাতে। তা ছাড়া জন্মগতভাবে সন্তান মায়ের প্রতি দুর্বল থাকে, যা তাকে মায়ের চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত করে।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, অশিক্ষিত মায়েরা অজ্ঞতার কারণে সন্তানের জীবন গঠনে খুব একটা সহায়তা করতে পারে না। তখন বেশির ভাগ সময়ই সন্তান অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। শিক্ষিত মায়েদের সন্তান স্বাভাব-চরিত্রে, শিক্ষায়, ভদ্রতা-নম্রতায় আদর্শবান হয়, আবার এর ব্যতিক্রমও ঘটে। যে দেশের মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষায় যত উন্নত সে দেশের জনগণও সর্বক্ষেত্রে উন্নত ও সে জাতিই বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অগ্রগামী।
শিশুর জন্মগ্রহণের পর ৪-৫ বছর সবচেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত করে তার মায়ের সাথে। মায়ের সাহচর্যে শিশু দিনে দিনে বড়ো হয়। আস্তে আস্তে নড়াচড়া, হামাগুড়ি দেয়া, কথা বলা থেকে শুরু করে প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শেখে। এক সময় তাকে সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে বড়ো হতে হয়। এই সময় তার আশপাশের বড়োদের ভূমিকা জীবন গড়তে অপরিহার্য। বড়ো ভাই-বোন, খেলার সাথী, পাড়া প্রতিবেশী, মা-বাবা, আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে সকলের কাছে তার শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা না থাকায় সে যাই দেখে সেটা শিখতে চেষ্টা করে। অভিভাবকহীন শিশুরা সঠিক দিক-নির্দেশনার অভাবে ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারে না। তাদের বেড়ে ওঠার মধ্যে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। সব ক্ষেত্রেই মায়ের উপস্থিতি শিশুর জীবনে পূর্ণতা আনে যদি সে মা সুশিক্ষিত হয়।
আমরা বয়সের সাথে দিনে দিনে বড়ো হই। প্রকৃত বড়ো হওয়া আর বেড়ে ওঠা দুটি ভিন্ন বিষয়। আদর্শ মানুষ হিসেবে বড়ো হতে চাই উপযুক্ত শিক্ষা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মানুষের শিক্ষার স্থান একথা সত্য কিন্তু জীবনের শুরুতে শিশুবয়সের শিক্ষার বিষয়টি মানুষের জীবনের ভিত্তি হিসেবে মুখ্য ভূমিকা রাখে যা পরবর্তী জীবনকে প্রস্ফুটিত করে। আর এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন একজন মা। জীবন গড়তে মায়ের ভূমিকা লিখে শেষ করা যাবে না। আমরা যারা জীবনের সব স্তর পেরিয়ে এসেছি তাদের কাছে বিষয়টি স্বচ্ছ। মা-বাবার অবদান কখনো পরিশোধযোগ্য নয়।
দুই.
শিশুকে গড়ে তুলতে যিনি নিজের অজান্তেই দায়িত্ব কাঁধে নেন তার শিক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই উন্নত জাতি গড়তে মা যাতে উপযুক্ত শিক্ষিত হন সে বিষয়টি সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়েছে। এতদিন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েদের বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি এ সুযোগ আরও কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগে সাড়া দিয়ে আজ অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়েরাও উপযুক্ত শিক্ষা নিতে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়েছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাস মেয়ে ঘরে ঘরে। তারা চাকরির সুযোগ পাচ্ছে, যোগ্যতা অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যা মূলত সরকারেরই অবদান।
আমরা নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে অবদান রাখতে পারি। ইভ-টিজিং বন্ধে আরো সোচ্চার হতে পারি, সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারি। দেশের উন্নয়নে ছোটো-বড়ো সবারই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই আমাদের সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। শিক্ষিত উন্নত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই বিশ্ব দরবারে। নারীকে শিক্ষিত হতে একান্তভাবে সচেষ্ট হতে হবে। তার জন্য সরকারের পাশাপাশি সবার সাহায্যের হাতে বাড়িয়ে দিতে হবে, তাহলেই উন্নয়ন জাতি গঠন সম্ভব।