গত ১৮ সেপ্টেম্বর রবিবার ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরিতে ব্রিগেড সেনা দপ্তরের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলায় ১৭ জন ভারতীয় সেনা নিহতের পর কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। ভারতীয় সেনাবাহিনী মনে করে, পাকিস্তান সমর্থিত জয়েশ-এ-মুহম্মদ নামে একটি জঙ্গি গ্রুপ ওই হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে ওই সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে বলে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করেছে। যে কারণে ওই হামলার পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি উঠেছে ভারতজুড়ে। ভারতের নিরাপত্তানীতির সঙ্গে জড়িত একটি অংশ মনে করে, পাকিস্তানকে এখনই একটা শিক্ষা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন বিজেপির শীর্ষ নেতা রাম মাধব দাঁতের বদলে চোয়াল খুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু হামলার পর সময় যত গড়াচ্ছে ভারতের পক্ষ থেকে সামরিক অভিযান পরিচালনার সম্ভাবনা ততটা কমে আসছে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সামরিক পন্থায় পাকিস্তানকে পাল্টা আঘাত করার চেয়ে এ মুহূর্তে কূটনৈতিকভাবেই জবাব দেওয়াটা হবে যৌক্তিক।
উল্লেখ্য, ওই হামলার পর ভারতীয় সেনাদের পাল্টা হামলায় চার হামলাকারীও নিহত হয়। উরি ঘাঁটিতে হামলাকারীদের কাছ থেকে চারটি একে-৪৭, চারটি আন্ডার ব্যারেল গ্রেনেড লঞ্চার, ৩৯টি গ্রেনেড, ৫টি হ্যান্ডগ্রেনেড, ২টি রেডিও সেট, ২টি জিপিএস, ২টি মানচিত্র, বিপুল পরিমাণে খাবার, ওষুধপত্র উদ্ধার করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে- এসব সরঞ্জামে পাকিস্তানের ছাপ রয়েছে। হামলাকারীদের কাছে যে মানচিত্র পাওয়া গেছে, তার মধ্যে পশতু ভাষায় লেখা রয়েছে। স্পষ্টভাবেই হামলাকারীরা পাকিস্তান থেকে এসেছে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন এগুলোকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতে চায় ভারত। যদিও বরাবরের মতো এবারের হামলায় জড়িত থাকার ভারতীয় অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান।
২.
উরিতে হামলার পর ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উরিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু গত ৮ জুলাই কাশ্মীরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হিযবুল মুজাহেদিন কমান্ডার বোরহান ওয়ানির প্রশংসা করে বোরহানকে স্বাধীনতাযোদ্ধা এবং কাশ্মীরের চলমান আন্দোলনকে ফিলিস্তিনিদের ‘ইন্তিফাদা’ বা গণ-আন্দোলনের সাথে তুলনা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। বোরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর থেকেই কাশ্মীরের চলমান বিক্ষোভ আরো ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বিপুল অস্ত্রভা-ার গড়ে তুলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা তৈরির জন্য ভারতকে অভিযুক্ত করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছে ভারত। সংবাদমাধ্যমকে ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর বলেছেন, এটি খুবই দুঃখজনক যে একটি স্বাধীন জাতির নেতা (নওয়াজ) একজন আত্মস্বীকৃত জঙ্গিকে (বোরহান) মহিমান্বিত করেছেন। এর মাধ্যমে পাকিস্তান নিজেকেই দোষারোপ করল। আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর ইস্যুর সমাধানের প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তান বাড়তি বহু পথ হেঁটেছে বলে নওয়াজ যে দাবি করেছেন তার জবাবে আকবর বলেছেন, পাকিস্তান হাতে বন্দুক নিয়ে সংলাপ করতে চাইছে। কিন্তু সন্ত্রাস ও আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না। বুধবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে নওয়াজের ভাষণের কয়েক মিনিট পরেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, বোরহান ওয়ানিকে মহিমান্বিত করে নওয়াজ শরিফ সন্ত্রাসের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কটা বুঝিয়ে দিলেন। অথচ তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে উরিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা পুরোপুরি চেপে গেছেন। চলতি বছরে নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে অনুপ্রবেশের অন্তত ১৯টি চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। নওয়াজ তাঁর বক্তৃতায় কাশ্মীরে আদিবাসীরা আন্দোলন করছে উল্লেখ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিকাশ স্বরূপ।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘে ভারতীয় মিশন এক বিবৃতিতে বলেছে প্রাচীন ইতিহাসের শিক্ষার পীঠস্থানকে সন্ত্রাসের আখড়া বানিয়েছে পাকিস্তান। যে জনপদ একসময় শিক্ষার মহান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল তা এখন সন্ত্রাসের আখড়া হয়ে উঠেছে (আইভি লিগ অব টেররিজম)। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশি সাহায্য ব্যয় করে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তান। কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করেছেন, তার জবাবে ভারতের ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সন্ত্রাস সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন। জাতিসংঘে ভারতীয় মিশনের রাহুল নামে একজন টুইট বার্তায় লিখেছেন, জাতিসংঘে নওয়াজ শরিফের ভাষণ সম্ভবত লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা হাফিজ সাইদের লিখে দেওয়া।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, কাশ্মীরের চলমান বিক্ষোভকে ঘিরে ভারত ও পাকিস্তানের পরস্পর সমর-শয্যা শেষ পর্যন্ত আরেকটি কারগিল যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। তবে উরিতে হামলার পর যত সময় গড়াচ্ছে তত মনে হচ্ছে আপাতত কোনো পক্ষেরই যুদ্ধ করার মতো খায়েস নেই। কূটনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দিকেই উভয় পক্ষের আগ্রহ বরং বেশি। ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন। যে ভাষণে ভারতের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আরো সুস্পষ্ট হবে।
৩.
উরিতে হামলার পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রশ্নের মুখে পড়েছে পাকিস্তান। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে ফ্রান্স ও রাশিয়া উরিতে হামলার ঘটনায় সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ওই হামলার পর ভারতের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছে। কেবল চীন সরাসরি ইসলামাবাদকে আক্রমণ না করলেও তারা সব রকম সন্ত্রাসের নিন্দা করেছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করছে যে কাশ্মীরে ‘ছায়াযুদ্ধ’ চালাচ্ছে পাকিস্তান। জাতিসংঘে নিজের শেষ বক্তৃতায় সরাসরি পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, যেসব দেশ ছায়াযুদ্ধে মদত দিচ্ছে, তারা তা বন্ধ করুক। এ ছাড়াও জার্মানিসহ একাধিক দেশ ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে। আর পাকিস্তানের অস্বস্তি বাড়িয়ে ভারতের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান বার্তা দিয়েছে। পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতায় আগামী নভেম্বরে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করার ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিবেশী এবং সার্কের সদস্য রাষ্ট্র দুটি। এ ছাড়া কাশ্মীরের উরিতে সেনা সদর দপ্তরে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে আসছে নভেম্বরে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অংশগ্রহণ কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি।
৪.
উরি হামলার যোগ্য জবাব কূটনৈতিক স্তরে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ভারত নিজেকে সামরিকভাবেও প্রস্তুত রাখছে। পশ্চিম সীমান্তের সব ঘাঁটিতে অতিরিক্ত সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে সব ধরনের ছুটি। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বেশ কিছু জায়গায় গ্রামবাসীদের জানানো হয়েছে, অল্প সময়ের নোটিশে তাদের নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে সাউথ ব্লকের ওয়ার রুমে দুই ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন। সেখানে প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালসহ অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা। সামরিকভাবে পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দিতে গেলে কোন কোন ঘাঁটির দিকে নজর দেওয়া দরকার, সেখানে প্রধানত এসব নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সাধারণত যুদ্ধকালীন ও গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে ওয়ার রুমে এমন ধরনের বৈঠক হয়ে থাকে।
ভারতের পশ্চিম নৌকমান্ড মহারাষ্ট্রের উপকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। মুম্বাই থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে উপকূলবর্তী উড়ান অঞ্চলের একটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা কয়েকজন সশস্ত্র ব্যক্তিকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখার পর বৃহস্পতিবার সকালে এই নির্দেশ জারি করা হয়। ওই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে তল্লাশি অভিযান। মহারাষ্ট্রের উপকূলবর্তী মুম্বাই, নবি মুম্বাই, থানে এবং রায়গড় অঞ্চলে ব্যাপক তল্লাশি চালানো শুরু হয়েছে। এ কাজে বাহিনীকে সাহায্য করতে হেলিকপ্টারও নামানো হয়েছে। উড়ানের যে স্থানে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে সেখানে শুধু নৌবাহিনীর ঘাঁটি ছাড়াও উড়ানে জওহরলাল নেহরু বন্দরে রয়েছে ভারতের সবচেয়ে বড় কনটেইনার টার্মিনাল। আর কাছেই রয়েছে ভাবা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র। পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে আসা সন্ত্রাসীরা ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে হামলা চালিয়েছিল। এতে নিহত হয়েছিলেন ১৬৬ জন ভারতীয়। সেই থেকে সমুদ্রপথে নজরদারি বাড়িয়েছে ভারত।
তবে সব রকমের পরিস্থিতির জন্য সামরিকভাবে সতর্ক থাকলেও ভারত অবশ্য কূটনৈতিক স্তরে চাপ বাড়িয়ে পাকিস্তানকে একঘরে করে আরও কোণঠাসা করার যাবতীয় কৌশল নিয়েছে। সেই সঙ্গে ভারত চাইছে জাতিসংঘকে দিয়ে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঘোষণা করিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করাতে।
৫.
ভারত যেকোনো মুহূর্তে হামলা চালাতে পারে এমন একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে। কয়েকটি বিষয় এই গুঞ্জনের পালে হাওয়া দিয়েছে। পাকিস্তানের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, ভারতের সেনাবাহিনী পাকিস্তান সীমান্তের দিকে এগোচ্ছে। এই খবরের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল রাহিল শরিফের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে থেকে গিলগিট, স্কার্দু ও চিত্রাল এলাকায় বিমানপথ বন্ধ করে দিয়েছে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। এজন্য অবশ্য সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানানো হয়নি। এ ছাড়া ইসলামাবাদ ও পেশোয়ারের মধ্যকার মূল মহাসড়কের কিছু অংশও বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ জরুরি মুহূর্তে এই মহাসড়ক যুদ্ধবিমানের ওঠানামায় ব্যবহার করা সম্ভব।
ভারত যদি সীমিত অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা হবে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি। দু-তিনটি সম্ভাব্য টার্গেট হয়ত ভারতের থাকবে। কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি জায়গাগুলোতে কোনো জঙ্গি শিবির আছে কি না সেটা ভারত খুঁজে ধ্বংস করতে চাইবে। এ ছাড়া লস্কর-ই-তৈয়বার বেশ কিছু সদর দপ্তর হয়ত সম্ভাব্য ভারতীয় টার্গেট হতে পারে। তবে এগুলোর সবগুলোই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এসব নিয়ে প্রস্তুত।
তবে সামরিক হামলা প্রতিরোধের পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার দিকেই পাকিস্তানের আগ্রহ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তান এখন আন্তর্জাতিক ফেরামে বোঝাতে চাইছে যে, কাশ্মীরে ভারত যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তার থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে উরির এই ঘটনা ভারত নিজেই সৃষ্টি করেছে। আর তা নিয়ে এখন তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চেঁচামেচি করছে। পাশাপাশি এ মুহূর্তে চীন এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ করে সৌদি আরব ও তুরস্কের কাছে পরামর্শ পাওয়ার জন্য শরণাপন্ন হচ্ছে। এ ছাড়া আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশীদের সাথেও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করছে। কারণ, পাকিস্তানের ভেতরে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর অবস্থান এবং তৎপরতা একটি বাস্তবতা। আর সে কারণে আান্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের বিশ্বাসযোগ্যতার কিছুটা সংকট রয়েছে।
৬.
ভারত ও পাকিস্তান দুটি দেশই এখন পারমাণবিকভাবেও শক্তিশালী। চলমান কাশ্মীর ইস্যুতে যদি দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে উভয় দেশেরই পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা রয়েছে। যে কারণে উভয় দেশের নীতিনির্ধারক মহল চাইছে, কূটনৈতিকভাবে যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে। কোনো ধরনের সামরিক হামলায় না জড়াতে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে এখন কাশ্মীরের মতো বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলন চলছে। যদি পাকিস্তান ভারত থেকে কাশ্মীরকে আলাদা করার জন্য নিজে থেকেই যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে বেলুচিস্তানকে ধরে রাখাটা কঠিন হবে। কারণ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যখন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে, তখন মাঝখান থেকে বেলুচিস্তান নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে। কারণ, ভারত তখন আফগানিস্তানের সহযোগিতায় বেলুচিস্তানে সহযোগিতার হাত বাড়াবে। যে কারণে পাকিস্তানের এ মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার তেমন আগ্রহ নেই।
অন্যদিকে ভারত সেনাবাহিনী দিয়ে কাশ্মীরের চলমান বিক্ষোভকে আরো কঠোরভাবে দমনের নীতি গ্রহণ করতে পারে। কারণ কাশ্মীরকে শান্ত করতে না পারলে ভারতের অন্য প্রদেশগুলো বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় সেভেন সিস্টারখ্যাত অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মনিপুরকে ধরে রাখাটা কঠিন হবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের পূর্বাঞ্চলের এই সাতটি প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। তাই কাশ্মীরকে ভারত কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইবে না। আর কাশ্মীরকে ঘিরে এ মুহূর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সেই সুযোগে চীন ভারতের এই সাতটি প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে আবার নতুন করে উসকে দিতে পারে। তখন একক ভারতকে অখ- রাখাই ভারতের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যেতে পারে। যে কারণে ভারত নিজে থেকে এ মুহূর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে চলার দিকেই সব ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখবে বলেই কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
তবে সব কিছু ছাড়িয়ে পাকিস্তান যদি পাল্টা ভারতে হামলা করে এবং ভারত যদি পাকিস্তানের ভেতরে কিছু সৈন্য হারায়, তাহলে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হবে- সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কারণ ভারত এই মুহূর্তে কোনো ধরনের সামরিক অ্যাডভেঞ্চারে যাবে, এখনো তেমন কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। বরং যত দিন যাচ্ছে সেই সম্ভাবনা তত দূরে সরে যাচ্ছে। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারত বরং এখন চাইছে কাশ্মীরের এ ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করে ফেলতে। কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে পারমাণবিক হামলার আশঙ্কাকে ভারত খুব গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করছে।
৭.
ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধ শুরু না হলেও দুই দেশের গণমাধ্যম এই মুহূর্তে একধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সরকারি পর্যায়ের প্রতিক্রিয়ার ভাষা দিন দিন যতটা ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে, তার বিপরীতে উভয় দেশের গণমাধ্যম যেন এক গায়ে পড়ে যুদ্ধ করার পর্যায়ে অবস্থান নিয়েছে। উভয় দেশের কূটনৈতিক যুদ্ধের বিপরীতে গণমাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং সংবাদপত্রেও যুদ্ধের ভাষা ব্যবহার শুরু হয়েছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলো থেকে পাকিস্তানকে একটি উচিত শিক্ষা দেওয়ার আহ্বান আসার পর থেকে পাকিস্তানের গণমাধ্যম থেকেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মনোভাব দেখা যাচ্ছে। ভারতের গণমাধ্যম যেভাবে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছে, ঠিক তার পাল্টা বক্তব্য দিচ্ছে পাকিস্তানের গণমাধ্যম। দুই দেশের গণমাধ্যমের বিশেষ কিছু অংশের এমন উসকানিমূলক অবস্থানের বিষয়টির দিকে এখন বরং কড়া নজর রাখতে হচ্ছে উভয় দেশের সরকারগুলোকেও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমা মোড়লদের গোপন উসকানিতে ভারত ও পাকিস্তানের গণমাধ্যমের কিছু অংশ এ কাজটি করছে। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া যুদ্ধে আইএসের অবস্থান নাজুক হওয়া এবং তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ানের হঠাৎ মার্কিন ব্লক থেকে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে যাওয়ায়, পশ্চিমা গোষ্ঠী এখন যুদ্ধের নতুন ময়দান খুঁজছে। ভারত ও পাকিস্তানের কিছু গণমাধ্যমকে উসকানি দিয়ে কাশ্মীর ও বেলুচিস্তানে দুটি স্থায়ী যুদ্ধ বা সরাসরি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারলেই পশ্চিমা মোড়লদের অস্ত্র-ব্যবসার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে। তাই কৌশলে তারা উভয় দেশের গণমাধ্যমকেই ব্যবহার করছে।
৮.
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এখন অনেকটা নিয়মরক্ষার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী নভেম্বর মাসের নির্বাচনে ডোনাল ট্রাম্প ও হিলারি ক্লিনটনের মধ্যে যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন, তাঁর কাছে আগামী ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তর করাই ওবামার দায়িত্ব। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওবামার খুব ভালো বন্ধু। ওবামা এখন বন্ধুর জন্য একটি যুদ্ধ উপহার দিয়ে বাকি জীবন সেই খোটা নিয়ে কাটানোর দিকে যেতে চাইছেন না। তাই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধটা এ মুহূর্তেই শুরু হোক সেটি যেভাবেই হোক ওবামা প্রশাসন কূটনৈতিক চালের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল নিয়েছে। পাকিস্তানকে নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের যে গোপন নীতি রয়েছে, সেখানেও কিছুটা আস্থার সংকট রয়েছে। আর সেই সংকটের প্রধান কারণ চীন। উপমহাদেশে একটি অনিবার্য যুদ্ধ শুরু হলে সেটি বন্ধ করে এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয়। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আরো শক্তিশালী না করে চীনকে ক্ষেপিয়ে তোলার নীতি থেকে একটু ধীরে চলো কৌশলে রয়েছে মার্কিনরা। তাছাড়া ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অনিবার্য হলে ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়ার দিকেই ভারতের ঝুঁঁকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। যা ভারতের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ককে আরো শীতল করে তুলবে। যে কারণে ওবামা প্রশাসন এ মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে এড়িয়ে চলার দিকেই আগ্রহ দেখাবে- এটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা, খোদ ভারত ও পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা পারমাণবিক হামলার আশঙ্কার কথা ভেবেই যুদ্ধ এড়িয়ে বরং কূটনৈতিকভাবে সমাধানের দিকেই হাঁটবেন বলে প্রত্যাশা করা যায়। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা