ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় পছন্দনীয় বিষয়ের একটা তালিকা জমা দিতে হতো। ১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষে মৌখিক পরীক্ষার দিন। সেদিন আম্মা আর আমি গেছি কলাভবনে। মৌখিক পরীক্ষার রুম থেকে পছন্দনীয় তালিকা লেখার একটা কাগজ দেয়া হয়েছিল - পূরণ করে জমা দিতে হবে। ওই ফরমটা হাতে নিয়ে কাছাকাছি একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে গেলাম পূরণ করার জন্য।
ওই ক্লাসরুমের টেবিলকে কেন্দ্র করে কয়েকজন ছেলে আড্ডা দিচ্ছিল। আম্মা আর আমার কথোপকথনে উনারা বুঝে গেছেন আমি বিষয়ের নাম লিখছি। ওই গ্রুপের একজন ডেকে জিজ্ঞেস করলেন ‘ছোট আপু কী কী বিষয়ের নাম দিলেন?’
আমি বললাম, প্রথম পছন্দ সাংবাদিকতা, পরে আইন ও ইংরেজি সাহিত্য। সাংবাদিকতা শুনেই উনারা হো হো করে হেসে উঠলেন। একজন বললেন- ‘সাংবাদিকতা কিন্তু সাংঘাতিকতা’।
তারপর তাদের মধ্যে একজন বললেন - আমরাও ‘সাংঘাতিকতায়’ পড়ি। (পরে এই দলের দুই একজনের সাথে আমার বেশ সখ্য হয়েছিল)।
ওই রুম থেকে বের হয়ে ইতিহাস বিভাগের সামনে দিয়ে যেতে আমাদের এক দুই মিনিট হাঁটতে হয়েছে। আম্মার মনে খচখচানি, কয়েকবার বললেন, আমি পছন্দের বিষয়গুলো আরেকবার ভেবে লিখবো কি না। মানে – ‘সাংঘাতিকতায় ভর্তি হবো কি না?’
গত কয়েকদিন ধরেই একটা খবর নিয়ে আমার বারবার মনে পড়ছে ‘সাংবাদিকতা কিন্তু সাংঘাতিকতা’।অনেকবারই এই উপলব্ধি হয়েছে যে ‘সাংবাদিক আসলেই সাংঘাতিক’। এইবার আবার হলো, ভবিষতেও নিশ্চয় হবে। যুগে যুগে আমাদের এই অনুভূতি হতেই থাকবে - যতদিন না সাংবাদিকতার সঙ্গে সচেতনতা, সততা, নৈতিকতা ও সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই পরিপূরক হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবস্থান (স্ট্যাটাস) ও মন্তব্যে বিভিন্নজন ওই খবরের প্রতিবাদে এই কথা লিখছেন। খবরটি ময়মনসিংহের সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ্ ফারুকীকে নিয়ে (লুৎফর রহমান হিমেল, পরিবর্তন ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)। ‘রাজার বেশে বিদায়’ বলে যেয খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেটা পুরোপুরি ভুল।
ওটা কোনো বিদায় অনুষ্ঠান ছিল না। ময়মনসিংহের তরুণদের নাট্য সংগঠনের অনুষ্ঠান ছিল ওটা। জেলা প্রশাসক "অনসাম্বল" নামে একটি নাট্য সংগঠনের সদস্য ছিলেন। তরুণ নাট্যকর্মীরা তাকে বরণ করে নিয়ে শখ করে ও অতি আবেগে রাজার পোশাক পরিয়েছিল।
ময়মনসিংহের মানুষ উনাকে ভালোবেসে অনেকগুলো (৩০/৩৫ টি) বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে ফারুকী সাহেবকে ফুল, কলম, পাঞ্জাবি একটি সোনার পিন উপহার দেয়া হয়েছে।
এই খবরটা যে সঠিক নয় - তা কয়েকদিন আগেই আমেরিকার ফিরোজ ভাই তার টাইমলাইনে দিয়েছিলেন। আমি অবিশ্বাসের মতো করেই বিশ্বাস করেছিলাম। ভেবেছিলাম কি জানি - এরকম একটা বিষয় নিয়ে এতো বড় বড় সাংবাদিকরা ভুল করবেন? আবার এটাও ঠিক যে তাদের দুই একজন সাংবাদিককে পছন্দ করতাম বলে মনে হচ্ছিলো – ‘খবরটা যেন কিছুটা হলেও সত্যি হয়’।
প্রভাষ আমিন ভাইয়ের লেখা ‘সবার আগে সংবাদ, নাকি সবার আগে সঠিক সংবাদ?’ এ উল্লেক্ষিত কয়েকটা ঘটনার মতোই। উনি যেখানে খুব সুন্দর করে লিখেছেন – ‘সাংবাদিকরা যখন কোন খবর (ভুল হলেও) দেয় তখন মনে মনে জপে - ভুল খবরটা যেন সত্যি হয়। কোন সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ জন মারা গেছে - কোনো রকম ক্রসচেক না করেই হয়ত আমরা লিখে দেই ১০ জন মারা গেছেন এবং এইরকম নির্মম মিথ্যেগুলো সত্যি করার জন্য উঠে পরি।’
সাংবাদিকদের জন্য সব খবরের মত একটা মিথ্যে খবরও খবর; ভুল হলে হউক - আগামীকাল ভুলের একটা প্রতিবাদ ভেতরের পাতায় ছেপে দিলেই হবে (যদি কেউ সেই ভুলের প্রতিবাদ করে)। কিন্তু এই একটা মিথ্যে খবর – যাকে কেন্দ্র করে করে তার সামাজিক-পারিবারিক জীবনের যে ক্ষতি আপনি করলেন, তার দায় আপনাকে নিতেই হবে।
এখনো সময় আছে, আমাদেরকে এই সব বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার। দয়া করে ভালো করে ক্রসচেক করে খবর ছাপুন।দায়িত্ববান হয়ে উঠুন আপনার এই মহান পেশা নিয়ে। কত ক্ষমতা আপনার হাতে - আপনি চাইলেই অনেক ভালো কাজ করতে পারেন - যা সমাজের অন্য দশ জনের নাই।
এই রকম বিভ্রান্তিকর খবর দিয়ে - সাংবাদিক সমাজ তাদের ‘শক্তিশালী কলম’ অথবা ‘কম্পিউটারের কী বোর্ড’ এর যে অপব্যবহার করছেন, তার মাসুল হয়ত দিতে হবে, হয়ত হবে না। কিথ আপনারা কে কোথায়-কত টাকার বিনিময়ে কোন খবর লিখেন অথবা লিখেন না, তা অনেকেই জানেন।
আপনাদের মূল্য যে ১০০ থেকে কোটি টাকা সেগুলো অনেকেই জানেন। কে নিপুণ তদবিরবাজ (তদবির আর্টিস্টও বলা চলে!), কাকে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা বিদেশি বোতল দিয়ে সামাল দেয়া যায়। কাকে কোথায় প্লট বা পদ দিতে হবে। এইসব অনেকেই জানেন - শুধু ওই যে ‘সাংবাদিকতার সাংঘাতিকতার’ ভয়। তাই কাকের সাবান চুরির মত ভাববেন না - কেউ জানে না। অনেকেই দেখেন ও জানেন – ‘সাংবাদিকতার সাংঘাতিক’ দিকটার ভয়ে কেউ এখনো কিছু বলছেন না।
আপনাদের কাজের সম্মান কিন্তু আপনাদেরকেই রাখতে হবে। আমি জানি এবং বিশ্বাসস করি - অনেক সৎ সাংবাদিক আছেন আমাদের সমাজে। যাদের সততা ও নিষ্ঠার কাছে পেরে না উঠে তাদেরকে অনেকেই কোণঠাসাও করে রাখেন।
পাদটীকাঃ এটা কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, মিথ্যে সাংবাদিকতার প্রতিবাদ।