দাফনের সময় কেঁদে উঠা শিশু গালিবা হায়াত ‘হায়াত’ পায়নি। হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। মাত্র চার দিন বয়সী শিশুটি মারা গেছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও অপরিণত গঠনে।
জন্মের পরপরই ১২ ঘণ্টা অস্বাভাবিক টানা-হেঁচড়ার কারণে গালিবার শরীরে অনেক জখম হয়। ফরিদপুরে বেসরকারি ডা. জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতালে জন্ম নেয়ার পর চিকিৎসক রিজিয়া আলম শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন। শিশুটির দাদা আবুল কালাম নবজাতককে একটি কার্টনে ভরে স্থানীয় আলীপুর কবরস্থানে দাফনের জন্য নিয়ে যান। রাতে কবর দিতে না পেরে কার্টনটি দেওয়ালে ঘেরা একটি কবরের মধ্যে রেখে আসেন। খুব সকালে গোরস্থানে লোকজন ও পরিবারের সদস্যরা নবজাতককে দাফনের জন্য কার্টন থেকে বের করতে গেলে শিশুটি নড়াচড়া ও শব্দ করে। তখন শিশুটিকে উদ্ধার করে ওই হাসপাতালেই ফিরিয়ে নিয়ে ইনকিউবেটরে রাখা হয়। এই যে এমন করে নবজাতককে, তার পরিবারকে অবহেলা আর হয়রানি করা হলো এর জন্য ডাক্তার রিজিয়াদের কিছু হয় না। তাঁর মতো চিকিৎসকদের একবারও সমনে হয় না এসব সাধারণ মানুষও এদেশের নাগরিক, এদের করের অর্থে সরকার চলে, তাদের বেতন হয়।
এরপর নিয়ম করে তদন্ত কমিটি ইত্যাদি হবে। কিন্তু, যে মায়ের কোল খালি হয়ে গেল স্রেফ একজন ডাক্তারের অবহেলা এবং গাফিলতিতে, তাঁর শাস্তি আদৌ হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো অজানাই থেকে যাবে। আমাদের মেনে নিতে হবে যে, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কারণ চিকিৎসক সমাজের সমিতি আছে, পরিষদ আছে, সংগঠন আছে আর সেসব সংগঠনের পেশীর জোর আছে।
বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বটে। তবে আমাদের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের দ্বারা এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনার সংখ্যা কেবল বাড়ে। এতে করে একদিকে চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর লোকজন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, মারধর করে ডাক্তারদের, ভাঙচুর হয় হাসপাতালে। অন্যদিকে, জুনিয়র ডাক্তাররা নেমে পড়েন আন্দোলনে। বন্ধ করে দেন চিকিৎসা এবং যাবতীয় কাজকর্ম। মূল রোগের সমাধান কিন্তু অধরাই থেকে যাচ্ছে।
স্বল্প পয়সায় চিকিৎসা এবং ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে যত বেশি সরকারি হাসপাতালমুখি করার চেষ্টা হোক না কেন, সংকট কখনোই কমছে না। আর বেসরকারি হাসপাতালে যত অর্থ ব্যয় হয় চিকিৎসার পেছনে সে তুলনায় চিকিৎসা কতটুকু হয়, তা এক উত্তরহীন প্রশ্ন।
হয়তো আসল রোগটাই দলা পড়ছেন। সবক্ষেত্রেই একটা সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়ানোর প্রবণতাই যেন বেশি। জেলা উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা মেলে না, এই অভিযোগে দলে দলে মানুষ শহরমুখী হয়। আমাদের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত যে ধরনের স্বাস্থ্য কাঠামো আছে তা খুব কমই আছে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোয়। কাঠামো আছে, চিকিৎসা নেই, ডাক্তার নেই। ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলো করা হলো, সিস্টেমে গলদ থাকায় তা ফলপ্রসূ হয়নি।
তাই তুচ্ছ কারণে বা সাদামাটা কোনো রোগ নিয়ে শহরের নামি হাসপাতালে ভিড় করার সেই পুরানো প্রবণতা বন্ধ করা যায়নি। আবার শহরেও যে চিকিৎসা ঠিকভাবে হচ্ছে তাও বলা যাচ্ছে না। শহরের হাসপাতলাগুলোয় রোগীর চাপ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, অনেকসময় চিকিৎসকেরও কিছু করার থাকে না। একই বেডে চার চারজন রোগী স্বাভাবিক ঘটনা। মেডিকেলে গেলেও দেখা যাবে, মেঝে রোগীতে ভরতি। কিন্তু, এত যখন রোগী, তখন সেই অনুপাতে ডাক্তারের সংখ্যা কি বেড়েছে? উত্তরটা হলো, না। এরই পাশাপাশি ডাক্তারদের মধ্যে সঠিকভাবে চিকিৎসা করা এবং সেবার মানকিসতাতেও কোথায় যেন একটা ঘাটতি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। সরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন, আর বাইরে রোগী দেখছেন, এমন ডাক্তারের সংখ্যাই বেশি। ফল যা হওয়ার হচ্ছে। হাসপাতালে বাঁধা বেতনে চাকরি করে অগুনতি রোগী দেখে কেনই-বা একজন ডাক্তার সময় নষ্ট করবেন। তাঁদের মন পড়ে থাকছে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে, যেখানে ঘণ্টা দুই বসলেই মোটা টাকার হাতছানি।
এ যেন শাঁখের করাত। অসহায় মানুষ লাখ লাখ টাকার বিল মেটাতে পারবেন না জেনে সরকারি হাসপাতালে একটু চিকিৎসার আশায় হত্যে দিচ্ছেন। আর হাসপাতালে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হচ্ছে না। পরিচিত লোক না থাকলে সরকারি হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া দুঃস্বপ্নই থেকে যাচ্ছে।
এরকম একটা অবস্থায় সরকারের উচিত, চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল রোগটা ধরে আগে ধাপে ধাপে তার চিকিৎসা করা। তা না-হলে হাজার হাজার অসহায় মানুষকে সুষ্ঠু চিকিৎসা দেওয়ার ইচ্ছা বাস্তবায়িত করা কঠিনই হয়ে দাঁড়াবে।