ঈদের পর গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম। সেদিন ছিল শুক্রবার। হবিগঞ্জ জেলার নয়াপাড়া থেকে ঢাকার উদ্দেশে আমাদের নিয়ে যখন বাসটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইসলামপুরে আসে, তখন শুনলাম অদূরেই দুর্ঘটনা হয়েছে। আমাদের বহনকারী বাসও অকুস্থলে গিয়ে থামল। কেননা, রাস্তা থেকে দুর্ঘটনাকবলিত বাস সরানোর কাজে স্থানীয় ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যরা ব্যস্ত থাকায় সেখানে অনেক যানবাহন আটকা পড়ে যায়। অনেক দর্শনার্থীরও ভিড় হয়। তাই আমাদের বাসটি স্বাভাবিক কারণেই আর এগুতে পারেনি। কৌতূহলবশত বাস থেকে নেমে দুর্ঘটনাকবলিত বাস ও মাইক্রোকে দেখলাম।
দুর্ঘটনায় পতিত ‘হেনা’ পরিবহনের বাসটিকে রাস্তার এক পাশে রাখা হয়েছে। আর মাইক্রো বাসটি রাস্তার পাশের খাদে পড়ে রয়েছে। দেখলাম, ওটা দুমড়ানো-মুচড়ানো। এর এতই ক্ষতি হয়েছে যে, ওটাকে মাইক্রো হিসেবে আর চেনা যায় না। ভেতরে কোনো যাত্রীকে দেখা যায়নি। আশপাশের লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলাম, মাইক্রোর যাত্রীদের মধ্যে সাতজন অকুস্থলেই মারা গেছে। বাকিদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বাস ছেড়ে দেবে বলে আমি আর বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে পারিনি।
দুপুরে ঢাকায় ফিরে ফেসবুক খুলে জানতে পারি, আমার দেখা দুর্ঘটনায় মারা গেছে মোট ৮ জন। তারা মাইক্রোবাসে করে সিলেটের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন একটি বিয়েতে। বর ওই মাইক্রোতে ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে যে, বরও ওই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তাদের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলায়। এ দুর্ঘটনা দেখে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে গেল। আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। ২০০২ সালের মে মাসের এক বিকেলে টাঙ্গাইলের অদূরে এলেঙ্গা বাইপাস সড়কের মোড়ে আত্মীয়স্বজন নিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। তখন মাত্র প্রমত্তা যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মিত হয়েছে। বিদেশ থেকে আসা আমার আত্মীয়স্বজনরা সেতুটি দেখতে চাইল। তাদের অনুরোধে এক সকালে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সেতু দেখে বিকালে ফেরার সময় দুর্ঘটনা ঘটল। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা সবাই বেঁচে গেলেও আমার একটি পা এবং আমার এক আত্মীয়ের হাঁটু পুরোপুরি ভেঙে যায়। আমার ডান পা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীরা অনুমান করেছিল যে, হয়ত ওই পা আর আগের মতো ঠিক হবে না। সেই পা ঠিক হয়েছে সত্য, তবে আগের মতো চলাচল আর করতে পারি না।
তখন সড়ক দুর্ঘটনাকে নিয়ে একটি ট্রেলার বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার হতো। সেখানে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাতলুব আহমদকে মন্তব্য করতে দেখা যায়, ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।’ দুর্ঘটনার ব্যাপারে তার এই বক্তব্য একটি সত্য উক্তিই বটে, অন্যরা কি মনে করে জানি না অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়। কেননা, যিনি বা যে পরিবার সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, সেই বুঝে তাদের নিস্তরঙ্গ-নিরুপদ্রব জীবনে আসলে কী ঘটে গেছে। যিনি সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হলেন, তিনি বেঁচে গেলেও নির্জীব হয়ে রইলেন।
একজন পঙ্গু ব্যক্তির পক্ষে আগের মতো কর্মক্ষম থাকা সম্ভব নয়। যিনি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, কিন্তু তেমন কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হননি, তিনিও মানসিকভাবে ব্যাপক আঘাতপ্রাপ্ত হন। পরবর্তী সময়ে তার জীবনে ওই দুর্ঘটনা ফিরে ফিরে আসে। আর যিনি মৃত্যুবরণ করেন, তার পরিবারই কেবল তার শূন্যতা উপলব্ধি করতে পারে। আবার কোনো মৃত্যুর আঘাত সমাজও বহন করতে পারে না। নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া একটি সড়ক দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যুকে আমরা মেনে নিতে পারিনি। এর একজন হলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং অন্যজন একাধারে সাংবাদিকতার শিক্ষক ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্র গ্রাহক আশফাক মুনীর চৌধুরী যিনি সবার কাছে মিশুক মুনীর নামেই পরিচিত। এর আগে এরশাদ জমানায় তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. এম এম মতিনের ছেলের গাড়িতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন উদীয়মান ছড়াকার বাপ্পী শাহরিয়ার। সড়ক দুর্ঘটনায় এমন আরও অনেক মেধাবীর মৃত্যুর উদাহরণ দেওয়া যাবে যে মৃত্যু পরিবারও মেনে নিতে পারেনি, তেমনি সমাজও পারে না।
কেন হয় সড়ক দুর্ঘটনা? এর কোনো এক কথায় উত্তর নেই। লেখার শুরুতে যে সড়ক দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই দুর্ঘটনার জন্য যে পরিবহনকে দায়ী করা হয় তা হচ্ছে ‘হেনা পরিবহন’। এই পরিবহনের একজন যাত্রী সাংবাদিক জহির উদ্দিন বাবর ওই দুর্ঘটনার পরই তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন এই বলে যে, হেনা পরিবহন এত তীব্র গতিতে চালানো হয় যে, এক সময় এই গাড়িকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তিনি আর ওই পরিবহনে যে দ্বিতীয়বার চড়বেন না, এই সিদ্ধান্তও জানিয়েছেন। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সড়কে নির্ধারিত গতিবেগের বেশি গতিতে গাড়ির চালালে দুর্ঘটনা ঘটবেই। সড়কে খানাখন্দ থাকলে দুর্ঘটনা হয়, তবে সড়ক ভালো থাকলেও বেশি গতিবেগে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটে।
ড্রাইভার তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকার কারণে আমাকে বহনকারী লাইটেসটিকে দুর্ঘটনায় পতিত হতে দেখেছি। দুপুরের খাওয়ার পর ঝির ঝির বৃষ্টির মধ্যে রওনা দেওয়ার একটু পর যখন ড্রাইভারের দিকে তাকালাম, দেখি সে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। তখন সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, গাড়ি নিজের লেইন ছেড়ে বিপরীত দিকের লেইনে ঢুকে পড়েছে। তখন বিপরীত দিক থেকে আসা বাসের সঙ্গে আমাদের অনিবার্য সংঘর্ষ। পরিণতিতে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। দক্ষ ড্রাইভারের পাশাপাশি তাদের শারীরিক সক্ষমতার অভাবও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
সড়কে চলাচলকারী পরিবহনের মধ্যে ওভারটেক করার প্রবণতা, ফিটনেসহীন গাড়ি চলাচল ইত্যাদি কারণেও দুর্ঘটনা হয়। এখন পথে বের হলে আর নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাওয়া যাবে কি না তার ব্যাপারে কোনো ভরসা পাওয়া যায় না। ঈদের আগে-পরে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে হাইওয়ে ও জেলা সড়কগুলোতে। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এআরসি) গবেষণা অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হয় ৩৫ হাজার। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি দশ হাজার যানবাহনে মৃত্যুর হার ৮৫ দশমিক ৬। এই সমস্যা একটি সোশ্যাল বা সামাজিক ট্রাজেডিতে পরিণত হয়েছে। এখনই এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে দুর্ঘটনা বাড়বে বৈ কমবে না।
বাছির জামাল : সাংবাদিক [email protected]
ঢাকাটাইমস/২৯সেপ্টেম্বর/বিজে/এমএইচ