ঢাকা: ১০ ই মুহররম কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ) শাহাদাতের রক্ত বইয়ে দিয়ে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন,তা ছিল মহান এক বিপ্লব। যে বিপ্লবের তাৎপর্য উপলব্ধি করে কবি বলেছিলেন, ‘ইসলাম যেন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ’ অর্থাৎ প্রতিটি কারবালার পর ইসলাম তার প্রাণ ফিরে পায়। এখন তো বিশ্ব মুসলমানের জন্যে প্রতিটি দিনই আশুরা আর প্রত্যেক ভূণ্ডখ-ই কারবালা। তাই ফিরে ফিরে আসে আমাদের সামনে ইমাম আলী (আ) এর সুযোগ্য উত্তরাধিকার ইমাম হোসাইন (আ) এর কারবালার ট্র্যাজিক বিপ্লবের স্মৃতি। যিনি ছিলেন শাহাদাৎকামিতা আর মানবিকতার মহান শিক্ষক। এই শিক্ষকের প্রদর্শিত আশুরা বিপ্লব নিয়ে কিছু কথা রইল আজ
ইরাকের মোসুল শহরের মুফতি আল-উবাইদি বলেছেন- ‘মানব ইতিহাসে কারবালা বিপর্যয় একটি বিরল ঘটনা। একইভাবে বিপর্যয়ের কারণগুলিও বিরল। হোসাইন ইবনে আলী (আ) জনস্বার্থ এবং মজলুমের অধিকার রক্ষা করার সুন্নাতকে নিজের দায়িত্ব বলে মনে করলেন এবং এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি কোনোরকম অলসতা করেন নি। তিনি কারবালার মহান ত্যাগের ময়দানে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। এ কারণে তিনি আল্লাহর দরবারে শহীদদের নেতা হিসেবে পরিগণিত হলেন এবং পৃথিবীর ইতিহাসে তাই তাঁকে সংস্কারকামীদের নেতা বলে অভিহিত করা হয়।’
বিশিষ্ট চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ ইদ্রিস হোসাইনী এ প্রসঙ্গে বলেছেন: একদিন আমার এক ঘনিষ্টজন আমার কাছে জানতে চাইলো কী কারণে আপনি আহলে বাইতের আদর্শ গ্রহণ করলেন? আমি বললাম, ‘ইমাম হোসাইন (আ) আশুরার দিনে তাঁর শাহাদাতের অপ্রীতিকর যে ঘটনা এবং দুঃখজনক যেসব দৃশ্যাবলি বিশেষ করে ইমাম ও তাঁর বংশধরদের সাথে যেসব আচরণ করা হয়েছে তা কোনো সুস্থ কিংবা হেদায়েতপ্রাপ্ত মানুষের চিন্তার পরিণতি হতে পারে না। নবীজীর আহলে বাইতের পবিত্র যে রক্তধারা কারবালার বালিকণার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তা কোনো মামুলি জলের প্রবাহ ছিল না। ঐ রক্ত ছিল এমন একজন শ্রেষ্ঠ ও অভিজাত ব্যক্তির যাঁর সম্পর্কে নবী (সা:) বারবার প্রশংসা করেছেন। তাই এরকম একজন মানুষ কক্ষণো ভ্রান্ত পথে থাকতে পারে না এবং তাঁর হত্যাকারীরাও কোনোভাবেই সঠিক পথে থাকতে পারে না।’
ইমাম হোসাইন (আ) তাঁর পিতা ইমাম আলী (আ) এর মতোই ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মজলুমদের একজন। বর্তমানে আশুরা এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর স্মৃতিময় ইতিহাসকে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্মরণ করা হয়। এর কারণটা হলো মানুষ সবসময়ই স্বাধীনতাহীনতা এবং ন্যায়নীতিহীনতার মুখোমুখি হয়েছে এবং অত্যাচারীদের নির্যাতনে পিষ্ট হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ইমাম হোসাইন (আ) হলেন জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক, মুক্তি ও স্বাধীনতার ডাক প্রদানকারী এবং ন্যায়নীতির পতাকা বহনকারীদের প্রতীক। আশুরা ঘটনা বা ইতিহাস তাই নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠিকে অত্যাচারী ও বলদর্পী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের মুক্তি ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রেরণা জোগায়। কেননা বিশ্বের স্বাধীনতাকামীদের মহান নেতার ওপর জুলুমের সেই ইতিহাস যতোই উচ্চারিত হবে ততোই মজলুমদের ন্যায়কামী আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে, যার পরিণতিতে বলদর্পীদের প্রাসাদের ভিত্তিতে কম্পন সৃষ্টি হবে।
ইতিহাস সৃষ্টিকারী মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম হোসাইন (আ) ৫৭ বছর জীবিত ছিলেন। মদীনায় রাসূলে খোদা (সা) এর পবিত্র সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন ছয় বছর। ত্রিশ বছর কাটিয়েছেন পিতা ইমাম আলী (আ) এর চড়াই-উৎরাইময় জীবনের সাথে। ভাই ইমাম হাসান (আ) এর শাহাদাতের পর দশ বছর উম্মাতের ইমামতির গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এই কয় বছরে তাঁর প্রজ্ঞা, বীরত্ব, মহত্ব এবং বাস্তববাদী চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ছিল লক্ষ্যনীয়। তবে মানব সমাজে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং বিখ্যাত হলেন আশুরা বা ঐতিহাসিক কারবালা ট্যাজেডির জন্যে। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে আশুরার দিনে তিনি যে মহান আত্ম কোরবানী করলেন তা-ই তাঁকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহীদের মর্যাদায় ভূষিত করেছে। ইরানের বিশিষ্ট কবি ফুয়াদ কেরমানী বলেছেন:
‘শত্রুরা তোমাকে মেরেছে, কিন্তু নেভে নি তো নূর তোমার
হ্যাঁ, ওই নূর তো নেভার নয়, কেননা সে নূর যে খোদার ।’
ইমাম হোসাইন (আ) এর যুক্তি অনুযায়ী জীবন মানুষের সম্মান ও মর্যাদার ওপর প্রতিষ্ঠিত এক অর্থপূর্ণ ও সুন্দর ব্যাপার। এই জীবনটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা বিশেষ দান। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মানবীয় পূর্ণতায় পৌঁছা। এই লক্ষ্যে পৌঁছার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো স্বাধীনতা এবং ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা। মানব সমাজের জন্যে ন্যায়নীতি এবং স্বাধীনতা হলো অক্সিজেনের মতো যা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। এরকম একটি সুষ্ঠু পরিবেশের জন্যেই তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করেছেন। সম্মানজনক মৃত্যুকে তিনি মহান সৌভাগ্যের বলে মনে করেন। ইমাম হোসাইন (আ) হলেন হযরত ইব্রাহিম (আ:) ,হযরত মূসা (আ:), হযরত ইসা (আ) এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর মতো বিখ্যাত নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকারী। তাঁরা সবসময় মানবীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোর জাগৃতির ব্যাপারে ছিলেন সৎ এবং ন্যায়ের মানদ-ের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
তিনি তাঁর সুমহান আত্মাকে মানবতার মুক্তির জন্যে ওয়াক্ফ করে দিয়েছিলেন এবং মানুষের সমুন্নতির জন্যে সংগ্রাম করেছিলেন। এ বিষয়টি উপলব্ধি করে এক আরব কবি বলেছিলেন:
আত্মা যখন মহান হয়,
দেহ তখন নিরুপায়
কিছুই করার থাকে না তার
কেবল আত্মার অনুসরণ করার।
কিন্তু ছোটো আত্মার লোকেরা কেবল দেহের পেছনে ছুটে বেড়ায়। বিবেক-বুদ্ধির তোয়াক্কা না করে দুর্দশার পেছনে ঘুরে বেড়ায় আর পরিণতি ভোগ করে নির্দ্বিধায়। এধরনের লোকেরা সর্বপ্রকার অন্যায়-অত্যাচার চালাতে দ্বিধা করে না।
ইসলামের সংস্কৃতিতে শাহাদাত হচ্ছে ইমানের নূরের দীপ্তির উৎস এবং জাতীয় জীবনোন্নয়নের চাবিকাঠি। এ কারণেই মানব সমাজ সত্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবসময় আত্মত্যাগী অর্থাৎ প্রাণ উৎসর্গকারী জনগোষ্ঠির প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছে। শহীদেরা নিজেদের রক্ত দিয়ে পরিবেশকে পবিত্রতা দেয় যাতে অন্যেরা সেই পবিত্র পরিবেশে বিকশিত হতে পারে এবং স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। শহীদেরা তাই মৃত্যুকে ভয় পায় না এবং জেনেশুনেই শাহাদাতের পথ বেছে নেয়। ইমাম সাজ্জাদ (আ) বলেছেন , হোসাইন (আ) এবং তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারীগণ কারবালার ময়দানে ছিলেন নির্ভীক। তাঁদের চেহারা উজ্জ্বল ছিল। তাঁদের দেহের প্রতিটি অঙ্গ ছিল দৃঢ় ও অবিচল। তাঁদের আত্মা বা প্রাণ ছিল প্রশান্ত। শত্রুরা তাঁদেরকে দেখে বলাবলি করছিলো, দেখো দেখো! হোসাইন মৃত্যুভয়ে বিন্দুমাত্র শঙ্কিত নয়।
সংঘর্ষ চলার কিছুক্ষণ পর উত্তপ্ত কারবালায় ইমাম পানির পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাই সামান্য থামলেন। শত্রুপক্ষের একজন এ সময় ইমামের দিয়ে একটি পাথর ছুঁড়ে মারলো। ঐ পাথরের আঘাতে ইমামের কপাল থেকে রক্ত ঝরছিল। ইমাম তাঁর জামা দিয়ে রক্ত পরিস্কার করছিলেন। এমন সময় নিষ্ঠুর হৃদয় একজন রাসূলে খোদার সন্তানকে লক্ষ্য করে তীর মারলো। তীর গিয়ে ইমামের বুকে বিঁধে যায়। তাঁর পবিত্র দেহ থেকে দরদর করে রক্ত বইতে থাকে। ইমাম হোসাইন (আ:) আকাশের দিকে মাথা তুলে বলেন, হে খোদা! তুমি জানো এই সেনারা এমন একজনকে হত্যা করছে যে ছাড়া এই পৃথিবীর বুকে রাসূলের আর কোনো সন্তান অবশিষ্ট নেই।
(ঢাকাটাইমস/৭নভেম্বর/ইসলাম/এসএ/ঘ)