ঢাকা: প্রতিবেশী ও পরিবারের দাবি, দশ বছর কেউ পা দেয়নি এ বাড়িটিতে। দশ বছর পর শুক্রবার বাড়ির দরজা খুলল। ভিতরে ধুলো মাখা চারপাশ, মাকড়সার জালে মোড়া। তার মধ্যেই শোয়ার ঘরের বিছানায় চাদর গায়ে পাশ ফিরে শুয়ে রয়েছেন কেউ। মাথার নীচে রাখা একটা হাত। পেটের উপরে হেলান দিয়ে রাখা অর্ধেক পানি ভর্তি বোতল। পাশে একপাটি জুতো। আর সামনে বাক্সবন্দি নতুন এমপিথ্রি প্লেয়ার।
তিনি কে, তার জানার কোনও উপায় নেই। কারণ, বিছানায় শুয়ে আস্ত একটি কঙ্কাল।
দশ বছর পরে বাড়িতে ঢুকে হাড় শীতল করা এই দৃশ্যই অপেক্ষা করছিল বছর আঠাশের মুনমুন চট্টোপাধ্যায়ের জন্য। মাকে নিয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে মামার বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। এত দিন পরে এক আত্মীয়ের সঙ্গে বাড়িতে ফিরলেন। দোতলার শোয়ার ঘরে ঢুকে যা দেখলেন, তাতে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি ওই তরুণী। এক ছুটে বেরিয়ে আসেন বাইরে। তার কাছ থেকে সব শুনে আঁতকে ওঠেন প্রতিবেশীরাও। খবর দেন পুলিশে। থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ওই তরুণী। এ দিন সকালে এই ঘটনায় তুমুল চাঞ্চল্য ছড়ায় ভারতের পশ্চিবঙ্গের হাওড়া জেলার ব্যাঁটরা থানার বেলগাছিয়া রথতলায়। নটবর পাল রোডের ওই বাড়িটির সামনে উৎসাহী জনতার ভিড়ে এলাকায় শুরু হয়ে যায় যানজট।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মা শেলী চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বছর দশেক আগে বাড়ি ছেড়ে মামাবাড়ি চলে যান মুনমুন। তার বাবা তড়িৎ চট্টোপাধ্যায় নৌবাহিনীতে চাকরি করতেন। অবসরের পরে ট্রেকিং-এর সরঞ্জাম ভাড়া দেয়ার ব্যবসা করতে গিয়ে প্রচুর ঋণ হওয়ায় পাওনাদারদের ভয়ে কয়েক বছর আগেই স্ত্রী-কন্যাকে রেখে বেপাত্তা হয়ে যান। গত ১০ বছর এলাকার কেউ তাকে দেখেননি। তার পরিবারের কাউকেও আর ওই পাড়ায় দেখা যায়নি। কিন্তু শুক্রবার বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ এক আত্মীয়ের সঙ্গে তড়িৎবাবুর মেয়ে মুনমুন হঠাৎ ওই বাড়িতে ফিরে আসেন। স্থানীয় এক বাসিন্দাকে ডেকে কোল্যাপসিবল গেটের তালা কেটে ভিতরে ঢোকেন তারা।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কঙ্কালটি কার?
এলাকাবাসীর মধ্যে দিনভর চলেছে নানা জল্পনা। বাসিন্দাদের একাংশের ধারণা, কঙ্কালটি তড়িৎবাবুরই। পাওনাদারদের ভয়ে হয়তো তিনি একদিন গোপনে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন।
পুলিশের ধারণা, এ ভাবে থাকতে থাকতেই হয়তো কোনও ভাবে তড়িৎবাবুর মৃত্যু হয়েছিল।
মুনমুন বলেন, “দশ বছর ধরে বাবার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। তাই এটা বাবার কঙ্কাল কি না, বুঝতে পারছি না।”
এলাকার বাসিন্দা ও চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্নিগ্ধকর বসু বলেন, “তড়িৎকে শেষ দেখেছিলাম ২০০৪ সালে, একটি শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে। এরপর থেকে ওকে বা ওর পরিবারের কাউকেই দেখিনি। তবে আমার ধারণা, তড়িৎ কোনও এক সময়ে গোপনে বাড়ি ফিরে এসেছিল। হয়তো স্ত্রী-মেয়েকেও তা জানায়নি। ওই কঙ্কাল ওরই!”
কিন্তু একটা মানুষের মৃত্যুর পরে দেহে পচন ধরল, অথচ এলাকায় গন্ধ ছড়াল না? স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানী দীনবন্ধু হাজরা বলেন, “বছর পাঁচেক আগে টানা এক মাস ধরে দুর্গন্ধে ছড়িয়েছিলো। পুলিশকে খবরও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ বন্ধ বাড়িতে জন্তু জানোয়ার মরেছে বলে দায় এড়ায়।”
হাওড়া সিটি পুলিশের এডিসি (দক্ষিণ) জয়িতা বসু বলেন, “বাড়ির লোকেরা জানিয়েছেন, বাড়ির মালিক গত ১০ বছর ধরে নিখোঁজ। যদিও পুলিশের কাছে কোনও নিখোঁজ ডায়েরি হয়নি। তাই ডিএনএ পরীক্ষার আগে কঙ্কালটি কার, এখনই বলা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে তদন্তের জন্য ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের খবর দেয়া হয়েছে।”
ফরেন্সিক তদন্তের আগে পর্যন্ত কঙ্কাল-সহ ওই বাড়িটিকে একই অবস্থায় রেখে দেয়া হবে। দেখা গিয়েছে, কঙ্কালটির কিছু হাড় ধুলোমাখা, কিছু হাড় পরিষ্কার, যেন কেউ সাফ করেছে। তাই মুনমুনের আগে কেউ ওই বাড়িতে এসেছিলো কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কিন্তু প্রায় দশ বছর পরে হাওড়ার বাড়িতে কেন ফিরলেন মুনমুন?
মুনমুনের দাবি, স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট নিতেই এ দিন বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। কিন্তু এত দিন বাদে সেই সার্টিফিকেট প্রয়োজন পড়ল কেন, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
মুনমুনের বরাত দিয়ে পুলিশ জানান, তড়িৎবাবু সব সময়ে আশঙ্কিত থাকতেন, পাওনাদারেরা স্ত্রী-মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে। এই ভয়েই তারা মা-মেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালান। দশ বছর আগে কয়েক বার বাবার সঙ্গে মোবাইলে তাদের যোগাযোগ হয়েছিল। তার পরে মোবাইলটি সুইচড অফ হয়ে যায়। আর তড়িৎবাবুর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়নি বলে দাবি করেছেন মুনমুন। তার বক্তব্যও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
(ঢাকাটাইমস/১৪ডিসেম্বর/জেএস)