ঢাকা: বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ার ও আহসান হাবিব কামালের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছিল। এর ফলও পেয়েছে বিএনপি। তাদের সমর্থিত প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল জিতে যান আওয়ামী লীগ সমর্থিত শক্তিশালী প্রার্থী শওকত হোসেন হিরনের বিপক্ষে। কিন্তু এরপর জেলার শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে বিভেদ দৃশ্যমান না হলে তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়েছে অসন্তোষ। যে কারণে কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচির বাইরে কোনো কর্মসূচি নেই জেলা বিএনপির।
সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনেও বিএনপির অন্তকোন্দল কাজ করেছে। আর এ কারণে বিশাল কর্মী বাহিনী থাকলেও সরকারি দলের কর্মীদের কেন্দ্র দখলের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি বিএনপি। এ নির্বাচন নিয়ে জেলা ও মহানগরীর শীর্ষ নেতাদের নিয়ে অভিযোগের অন্তনেই তৃণমূলের।
তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, সংগঠনের প্রতি মন দিচ্ছেন না জেলার শীর্ষ নেতারা। শুধু দায়সারা গোছের রাজনীতি করছেন তারা। কেন্দ্র থেকে কোনো কর্মসূচি থাকলে তাও পালন হচ্ছে নামকাওয়াস্তে। সরকার দলীয় লোকজনের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন জেলার নেতারা। এসব কারণে বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ দিন দিন বাড়ছে।
তবে জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়দুল হক চান মনে করেন, নেতা-কর্মীরা বরাবরের মতোই সক্রিয় আছে। কিন্তু সরকারের দমন-পীড়নের মুখে তারা মাঠে দাঁড়াতে পারছে না। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘হয়ত কিছু জায়গায় সরকারের আচরণের কারণে নেতা-কর্মীরা ওইভাবে মাঠে নামতে পারছে না। কিন্তু এরপরও কেন্দ্রের সব ধরনের কর্মসূচি আমরা সফল করার চেষ্টা করেছি।’
বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ মজিবর রহমান সরোয়ারের দাবি, বরিশালে বিএনপির কার্যক্রম ঠিকই চলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যতদূর সম্ভব সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ আছে।’
বরিশালে বিএনপির অন্যতম কর্ণধার হিসেবে মনে করা হয় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবর রহমান সরোয়ারকে। মূলত বরিশালে বিএনপির রাজনীতি পরিচালিত হয় যে কজন শীর্ষ নেতাকে ঘিরে সরোয়ার তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বরিশাল মহানগরীর সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার ওই অর্থে মহানগর বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে পারেননি। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও খুব বেশি যোগাযোগ রাখেন না। কেন্দ্রের নির্দেশে কর্মসূচি বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই তার। বরং সরোয়ারের অনুসারী-অনুগামীদের বিরুদ্ধে আছে বিস্তর অভিযোগ। সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ঠিকাদারি ব্যবসা করে যাচ্ছেন তারা। এছাড়া সম্প্রতি শেষ হওয়া উপজেলা নির্বাচনে বরিশাল সদরে বিএনপি প্রার্থীর ভরাডুবির জন্যও সরোয়ারকে দায়ী করছেন বিএনপির তৃণমূলের একটি অংশ।
বরিশাল বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘বরিশালের প্রায় সব উপজেলায় নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা কেন্দ্র ত্যাগ করেনি। কোথাও নির্বাচন বর্জন করা হয়নি। অথচ হঠাৎ করে সদর উপজেলায় বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে বসলো। এটা কেন করা হলো এর উত্তর আজও দিতে পারেনি কেউ।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মজিবর রহমান সরোয়ার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে আমাদের পরাজয় হয়েছে এটা আমি মনে করি না। কারণ, সরকার দলীয় লোকজন ভোট শুরু হওয়ার আগেই ব্যালটে সিল মেরে ভোট শেষ করেছে। জনগণ ভোট দিতে পারেনি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক যুবদল নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যারা দলকে কিছু দিতে চায় তারা এখন বিএনপির নেতৃত্বে নেই। যারা দল থেকে নিতে চায় তারাই এখন দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বেগম খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানকে খুশি করার জন্য এখন কেউ রাজনীতি করেন না। যারা সরোয়ার ভাইয়ের অনুসারী তারা মনে করেন খালেদা জিয়াকে খুশি করার দরকার নেই, সরোয়ার ভাইকে খুশি রাখলেই হবে। আবার যারা কামাল ভাইয়ের অনুসারী তারা দলের কথা চিন্তা না করে তাকে খুশি রাখাকেই ধ্যানজ্ঞান মনে করে। এসব কারণে সংগঠন ডুবতে বসেছে।’
জেলার প্রবীণ এক নেতা বলেন, ‘৮০-৯০-এর দশকে নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে আবেগ ও ত্যাগের মানসিকতা ছিল এখন তার বিন্দুমাত্র নেই। এখন রাজনীতিতে এসেই ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন নেতারা। যে কারণে সংগঠনের এই দৈন্যদশা।’
জানতে চাইলে বরিশাল জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ বিলকিস জাহান শিরিন মনে করেন, সাংগঠনিক দুর্বলতার যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে তার মূল কারণ জেলা ও মহানগরীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকা। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কদিন আগে কেন্দ্র থেকে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটির ব্যাপারে কোনো ধরনের তৎপরতা চোখে পড়ছে না। তাছাড়া এর আগেও আড়াই বছর দুটি পদ দিয়ে জেলা কমিটি চলেছে। একই অবস্থা মহানগর কমিটিরও। তবে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি যে, মহানগরীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয়েছে। দলের মহাসচিবের সই করা কোনো কাগজপত্র পাইনি।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এই সদস্য আরও বলেন, ‘তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার যে কথা প্রায়ই শোনা যায় তা আমাদের মতো নেতাদের কারণেই। আমাদের নিষ্ক্রিয়তা নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়। কেন্দ্র থেকে যদি এসব বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা হয় তবে হয়ত এসব সমস্যা দূর করা সম্ভব। ব্যক্তি বিবেচনায় যদি নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হয় তবে সংগঠন কোনোভাবে উপকৃত হতে পারবে না। ব্যক্তির চেয়ে দলকে সব সময় বড় করে দেখতে হবে।’
এবায়দুল হক চান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জেলা কমিটি কেন্দ্র থেকে দেওয়া হয়েছে দেড় মাসের মতো। এর মধ্যে উপজেলা নির্বাচনসহ নানা ব্যস্ততা ছিল। কিন্তু এরপরও সব থানার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি। যতদ্রুত সম্ভব পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হবে।’
মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘মহানগরীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়ে গেছে। কেন্দ্র থেকে এই কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কমিটি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।’
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, মেয়র কামাল ও সরোয়ার সব বিভেদ ভুলে এক হয়ে গেলেও তাদের ওপর তৃণমূলের ক্ষোভ মেটেনি। কারণ, তারা নিজেদের মধ্যে পদ ভাগাভাগির সমঝোতায় আসার পর এক হয়েছেন। অথচ দলের ত্যাগী ও তরুণরা নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের কারণে। তারা নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টা করেন, তৃণমূল ও তরুণ নেতৃত্বের কথা ভাবেননি।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় যুবদলের সদস্য শাহ আমিনুল ইসলাম আমিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বরিশালে দলের শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্বে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অতীতেও আমরা মাঠে ছিলাম। ভবিষ্যতে সরকার পতনে বরিশালে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে কাজ করে যাব।’
সরোয়ার-কামাল-চান দ্বন্দ্বের গোড়ার কথা
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সরোয়ার ও কামালের দ্বন্দ্বের শুরু নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল সদর আসনে নির্বাচিত হন আবদুর রহমান বিশ্বাস। তিনি পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে এই শূন্য আসনের উপনির্বাচনে সাংসদ হন সরোয়ার। কিন্তু ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে ওই আসনে রহমান বিশ্বাসের ছেলে এহতেশাম উল হক নাসিম বিশ্বাস বিএনপির মনোনয়ন পেলে রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে সরোয়ারের দীর্ঘদিনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। ১৯৯৮ সালে নাসিম বিশ্বাসের আকস্মিক মৃত্যুতে রহমান বিশ্বাস ওই আসনে তার আরেক ছেলে জামাল বিশ্বাসের মনোনয়নের জন্য চেষ্টা করেন।
শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাসিম বিশ্বাসের মনোনয়নে সমর্থন এবং জামাল বিশ্বাসের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টায় যুক্ত থাকায় আহসান হাবিব কামালের সঙ্গে মজিবর রহমান সরোয়ারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে দলীয় সমর্থন পান সরোয়ার। ওই নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন কামাল এবং চান। নির্বাচনে বিজয়ী সরোয়ার পান ৪২ হাজার ৬২১ ভোট। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এনায়েত পীর খান ৩২ হাজার ৬৫৫, কামাল ২০ হাজার ২৪৮ এবং চান ১৩ হাজার ৮৫৬ ভোট পান। ওই নির্বাচনের পর কামাল ও চানকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে রাজনীতিতে প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন কামাল। ২০০৯ সালে তাকে দলে ফিরিয়ে নেওয়ার পর কেন্দ্রীয় মৎস্য বিষয়ক সম্পাদক ও বরিশাল জেলা বিএনপির সভাপতি করা হয়। দলে ফেরার পর তার সঙ্গে আবার দ্বন্দ্ব শুরু হয় সরোয়ারের। এ দুই জনের দ্বন্দ্বের জেরে এ পর্যন্ত দুই নেতা-কর্মী নিহত এবং দুই জন নিখোঁজ হয়েছেন। পরে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কামাল ও সরোয়ারের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আপাতত নিরসন হয়। ওই নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন চান। তাকে জেলা সভাপতি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। কামাল মেয়র নির্বাচিত হন। পরে চানকে জেলা সভাপতি করা হয়।
(ঢাকাটাইমস/০৯ মে/এইচএফ/ এআর/ ঘ.)