logo ০১ মে ২০২৫
গুম আতঙ্ক সারাদেশে
আল ফারুক ও আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
০৩ মে, ২০১৪ ১০:৪৪:৪১
image


ঢাকা: নিজ ঘর, ব্যস্ত সড়ক বা আদালত চত্বর- কোথাও যেন নিরাপদ নয়। কেউ আসে র‌্যাব পরিচয়ে, কেউ পুলিশ, কেউ বা গোয়েন্দা পরিচয়ে। এসেই বলে গাড়িতে উঠতে। না  উঠতে চাইলে অস্ত্রের মুখে জোর জবরদস্তি। পরে কখনও কখনও এখানে-সেখানে পাওয়া যায় মরদেহ। কেউ ফিরে আসে, কেউ আসে না। কেউ ফিরলেও জানা যায় না কারা তুলে নিয়েছিল।

এভাবে অপহরণকে সাম্প্রতিক সময়ে বলা হচ্ছে গুম। আর এ কারণে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। এই অপহরণ, গুমের শিকার রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, বেকার, চাকরিজীবী, শিক্ষক এমনকি ছাত্রছাত্রীও। আছে নারী এবং শিশু। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভিযোগ আসছে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে, কখনও কখনও তাদের নামে সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসীরাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার না করলেও কারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের কাউকে আটক করতে না পারায় থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন।

অপহৃত রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে আছে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে জড়িতরা, আছে সরকার দলের কর্মীরাও। কেন এই প্রবণতাÑজানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘একের পর এক অপহরণ হলেও দোষীরা শনাক্ত হচ্ছে না, ঠিকমতো হচ্ছে না তদন্তও। ফলে বিচার হচ্ছে না বেশিরভাগ ঘটনার। তাই অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অপহরণের অভিযোগ উঠেছে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধেও। কিন্তু সরকার এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই সরকার এর দায় এড়াতে পারবে না। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন করে প্রতিটি ঘটনার জন্য দায়ীদের শনাক্ত করলেই অপহরণের এই প্রবণতা কমানো সম্ভব।’  

গুম-অপহরণের ঘটনা ক্ষমতাসীন দলের জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরি করেছে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই অপহরণের পর আইনের শাসনে বিশ্বাসী মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দেখেনি, কিছুই জানে না বা বুঝতে পারছে না এ ধরনের মন্তব্য করে তাতে চলবে না। এটা কোনোভাবে আইনের শাসন নয়। এর পেছনে যারা আছে, তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

বিএনপি অবশ্য এই ঘটনায় সরাসরি সরকারকেই দায়ী করছে। তাদের অভিযোগ, সরকার বিরোধী দলের কর্মীদের দমন করতেই অপহরণ-গুমের কৌশল নিয়েছে। পরে তা বিস্তৃত হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দেশে একের পর এক যেভাবে ভয়াবহ হত্যাকা-, গুম ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে তা থেকে প্রমাণ হয় সরকার দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে তাদের পদত্যাগ করা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে আওয়ামী লীগ বরাবরই বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপিয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ অন্ধ নয়, বিবেকহীন নয়। তারা ঠিকই বুঝতে পারছে এসব কারা করছে।’

গুম-অপহরণ অবশ্য কেবল বাংলাদেশের ঘটনা নয় বা দেশে সাম্প্রতিক কোনো প্রবণতা নয়। তবে ইদানীং গুম-অপহরণের ঘটনা যখন ঘটছে প্রতিদিন তখন আর আতঙ্কিত না হওয়ার উপায় আছে? মানুষের মুখে মুখে তাই এখন ছড়াচ্ছে নানা কথা। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী লাবণী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দেশে হচ্ছেটা কি? দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাই, সেখানেও সবার একটাই কথা। এত গুম করছে কারা? ধরা পড়ছে না কেন তারা?’

শঙ্কা বাড়াচ্ছে ঘটনা দুটি

তবে সম্প্রতি ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ‘নিখোঁজ’ সাতজনকে তুলে নেওয়ার এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পর তা স্বীকার করেছে র‌্যাব। ১৯ এপ্রিল সোহেল রানা, মোর্শেদ আলম, বাছির উদ্দিন, ইউসুফ আলী ও ইলিয়াস উদ্দিনকে তুলে নেওয়ার পর তাদের স্বজনরা শুরু থেকেই এই ঘটনার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করে এলেও এতদিন তা স্বীকার করেনি কেউ। যদিও গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই পাঁচজন ও দুই স্কুল শিক্ষক কামাল হোসেন ও আবু বকরকে আটকের কথা জানায় র‌্যাব। যদিও এর আগে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল তারা।

৩০ এপ্রিল রাতে কুড়িগ্রামে এনজিও কর্মকর্তা মাইদুল ইসলামকে অপহরণের ঘটনায় আটক হয়েছেন ডিবি পুলিশের কনস্টেবল আতিকুজ্জামান, জেলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কর্মরত কনস্টেবল মামুনুর রশিদ, ডিবির সোর্স মনু। একই ঘটনায় পালিয়ে গেছেন পুলিশের আরেক কনস্টেবল শাহ আলম। এরা ওই এনজিও কর্মকর্তাকে অপহরণ করে তার ছোটো ভাইয়ের কাছে মুক্তিপণ আদায় করতে চেয়েছিলেন।

পুলিশ সদস্যদের আটক করলেও কুড়িগ্রামে বাহিনীটির কর্মকর্তারা এ নিয়ে কিছুই বলতে চান না। তবে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও অপহরণের মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।

নারায়ণগঞ্জ যেন মৃত্যুপুরী

গত ২৭ এবং ২৮ এপ্রিল কেবল গাজীপুর,  ময়মনসিংহে অপহৃত হয়েছে ১১ জন। এর মধ্যে রবিবার নারায়ণগঞ্জে চার সহযোগীসহ অপহৃত হয়েছেন সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা নজরুল ইসলাম। একই দিন এক সঙ্গীসহ অপহৃত হন আইনজীবী চন্দন সরকার।

অপহরণের রাতেই নজরুলের গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয় গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার হোতাপাড়া থেকে। সোমবার গভীর রাতে চন্দন সরকারের গাড়িটি পাওয়া যায় ঢাকার গুলশানের নিকেতন আবাসিক এলাকা থেকে।

নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের উদ্ধারে তার সমর্থকরা এরপর থেকে সড়ক অবরোধ, মিছিল-সমাবেশ করে আসছিলেন। আর চন্দন সরকাররের খোঁজ দেওয়ার দাবিতে নারায়ণগঞ্জ আদালত বর্জন করেছেন আইনজীবীরা। ঘটনার তিনদিন পর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় পাওয়া যায় ছয়জনের অর্ধগলিত মরদেহ। খুনের পর মরদেহ লুকাতে সবার শরীরে ৩২টি করে ইট বেঁধে নদীতে ফেলেছিল খুনিরা। কিন্তু শুক্রবার ভেসে উঠে ছয়জনের মরদেহ।  পরদিন পাওয়া যায় বাকি একজনের।

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ১ মে নারায়ণগঞ্জে হয় আরও একটি অপহরণের ঘটনা। রাত ১০টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের ব্যবসায়ী সৈয়দ সাইফুল ইসলাম অপহৃত হন। তার স্বজনরা জানিয়েছেন, অপহরণের পর ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছে অপহরণকারীরা।

সোমবার ভোরে গাজীপুরের কালিয়াকৈর সূত্রাপুর গ্রামে নিজ বাড়ি থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় দুই ভাই কেদারী চন্দ্র সরকার ও ঝিলমোহন চন্দ্র সরকারকে। এরপর সোমবার রাত সাড়ে আটটার দিকে অবশ্য তাদের খোঁজ মেলে একই উপজেলার একটি সড়কের ধারে। অচেতন অবস্থায় তাদেরকে ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা।

ময়মনসিংহের ভালুকার পাঁচগাঁও গ্রাম থেকে সোমবার ভোরে আবু বক্কর ও কামাল হোসেন নামে দুই শিক্ষককে তুলে নেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে। সম্পর্কে তারা চাচাতো ভাই। স্বজনরা জানান, তুলে নেওয়ার সময় তাদের দুইজনের হাতে হাতকড়াও পরানো হয়। অপহৃত দুইজন ভালুকায় একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। দুই দিন পর র‌্যাব স্বীকার করে এই দুইজনকে তুলে আনে তারা।

পরিসংখ্যানটা ভয়াবহ

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ২৬৮টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ৪৩ জনের। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ২৪ জনকে, আর পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে ১৪ জনকে। বাকি ১৮৭ জনের কোনো খোঁজই নেই।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গুমের এই প্রবণতা ভয়াবহ আকার নিয়েছে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে। জানুয়ারি থেকে মার্চÑএই তিন মাসেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি। এর মধ্যে ছাত্রলীগের চারজন, ছাত্রদলের তিনজন, জামায়াত-শিবিরের দুইজন, বিএনপির ১১ জন, তিনজন ব্যবসায়ী, চারজন চাকরিজীবী এবং ১১ জন সাধারণ মানুষ আছেন। এই ৩৯ জনের মধ্যে মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ১২ জনের। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীসহ চারজনকে। আর ২৩ জনের কোনো খোঁজ নেই।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, গত এপ্রিলে গুম-অপহরণের প্রবণতা বেড়েছে আরও বেশি। এই মাসে সারাদেশে অপহৃত হয়েছে ৩৪ জন। এদের মধ্যে ২৫ জন পুরুষ, চারজন নারী ও পাঁচটি শশু। এ ছাড়া নিখোঁজ আছেন ২৬ জন।

২০১৩ সালে ৬৮ জনকে অপহরণের তথ্য আছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে। এর মধ্যে মরদেহ উদ্ধার হয়েছে পাঁচজনের। ছয়জন ছাড়া পেলেও ৫৫ জনের কোনো হদিস নেই।

২০১২ সালে অপহৃত হয়েছেন ৫৬ জন। এর মধ্যে ৩৪ জনের কোনো খোঁজ নেই। এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ইলিয়াস আলীর গুম। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল নিখোঁজ হন তিনি। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণে তার স্বামীকে অপহরণ করা হয়েছে।

২০১১ সালে অপহৃত ৫৯ জনের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ১৬ জনের মরদেহ। ছেড়ে দেওয়া হয় চারজনকে। আর ৩৯ জনের কোনো খোঁজ নেই।

২০১০ সালে ৪৬ জনকে অপহরণের তথ্য আছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে। এদের মধ্যে ৩৩ জনের খোঁজ নেই। নিখোঁজদের মধ্যে আছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম। তাকে ওই বছরের ২৫ জুন ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানা থেকে অপহরণ করা হয়। র‌্যাবের বিরুদ্ধে এই অপহরণের অভিযোগ ওঠে সে সময়, যদিও একে ভিত্তিহীন দাবি করেছে বাহিনীটি।  

এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে ‘ক্রসফায়ারে’ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ব্যাপক হারে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রবণতা কমলেও শুরু হয় গুমের প্রবণতা। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি বাহিনীর নামে মানুষকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় সরকারকেই এর দায় নিতে হবে বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘যদি দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকে তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র এবং সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের নিরাপত্তা দেয়া। সেটা দিতে না পারলে সরকারের প্রতিও দেশের মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হবে৷’

মেলে মরদেহ, কিন্তু ধরা পড়ে না অপরাধীরা

গত ২৫ এপ্রিল ঢাকার উত্তরার ছয় নম্বর সেক্টর থেকে অপহৃত হন লক্ষ্মীপুর জেলা যুবদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক শামসুল ইসলাম। পরদিন লক্ষ্মীপুরের বসুরহাট এলাকায় পাওয়া যায় তার মরদেহ।

শামসুল ইসলামের পরিবারের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা শামসুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে শুক্রবার উত্তরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন তার স্ত্রী সামলা ইসলাম মায়া। এর তদন্তেও নেই কোনো অগ্রগতি।

গত ১৫ এপ্রিল একটি হত্যা মামলায় হাজিরা শেষে মুন্সিগঞ্জ আদালত থেকে বের হওয়ার পর গাড়িতে করে তুলে নেওয়া হয় হাফিজ উদ্দিনকে। পরদিন তার হাত-পা বাঁধা গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে জালকুড়ির কড়ইতলা এলাকায়। কিন্তু কারা হাফিজ উদ্দিনকে অপহরণ করে হত্যা করেছে, তা বের করতে পারেনি পুলিশ।

নোয়াখালী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকম-লীর সদস্য ও সদর উপজেলা সভাপতি মফিজুর রহমানকে অপহরণ করা হয় গত ২৭ এপ্রিল। পরদিন সুবর্ণচর উপজেলার আল আমিন বাজারের সড়কের পাশে একটি ধানক্ষেত থেকে উদ্ধার হয় তার মরদেহ। অপহরণের আগে একটি মোটর সাইকেলে করে বের হয়েছিলেন মফিজুর। সেটিও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

ফিরেও এসেছে কেউ কেউ তবে আগায়নি তদন্ত

সোমবার ভোরে গাজীপুরের কালিয়াকৈর সূত্রাপুরে নিজ বাড়ি থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া দুই ভাই কেদারী চন্দ্র সরকার ও ঝিলমোহন চন্দ্র সরকার ফিরে এসেছেন ১৮ ঘণ্টা পর। সোমবার রাত সাড়ে আটটার দিকে নন্দন পার্কের পাশে তাদের ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে।

দুই ভাইকে খুঁজে পাওয়ার পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে গাজীপুরের পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন দাবি করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই তাদের পরিচয়ে এই দুই ভাইকে তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। তবে কারা এই ‘ভাবমূর্তি’ নষ্টের কাজ করছে, তা বলতে পারেননি তিনি।

জানতে চাইলে কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওমর ফারুক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই দুই ভাইকে কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে টাকা পয়সা লেনদেন নিয়ে বিরোধে এই ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে হচ্ছে। তদন্ত চলছে, শেষ হলে বিস্তারিত বলা যাবে।’

পরিবেশ আইনজীবী সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী এ বি সিদ্দিক অপহরণ নিয়েও দেশজুড়ে হয়েছে তোলপাড়। ১৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহরণের দুই দিন পর ঢাকার মিরপুরে এ বি সিদ্দিককে ফেলে যায় অপহরণকারীরা। এখনও জানা যায়নি কেন এবং কারা এই ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে নিয়েছিল। পুলিশ জানিয়েছে তদন্ত চলছে। কিন্তু এ পর্যন্তই। আর কিছুই জানাতে পারেনি বাহিনীটি।    

৫ মার্চ ময়মনসিংহের ভালুকায় নিজ বাড়ি থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় পোশাক শ্রমিক আবু হানিফ এবং তার দুই ভাই কৃষক নাজমুল হক ও দশম শ্রেণির ছাত্র সানোয়ার হোসেনকে। অপহৃতের স্বজন এবং ফিরে আসারা স্পষ্টতই জানিয়েছেন, তাদেরকে তুলে নিয়েছে পোশাক ও অস্ত্রধারী র‌্যাব সদস্যরা। কিন্তু তারা ফিরে আসার পরও তাদের বক্তব্য আমলে নেয়নি পুলিশ। এই অপহরণের পর স্বজনদের পরিবারের পক্ষ থেকে ভালুকা থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল। এরপর ডায়েরির সূত্র ধরে তদন্তের কথা জানিয়েছিলেন ভালুকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু এ তদন্তও আর আগায়নি।

জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘তিন ভাই ফিরে আসার পর বিষয়টি নিয়ে তাদের পরিবার আর চায় না আইনি কোনো পদক্ষেপ নিতে। এ কারণে সাধারণ ডায়েরিটি নিষ্পত্তি করে দেওয়া হয়েছে।’

১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে র‌্যাব ও ডিবি পুলিশ পরিচয়ে অপহরণের ছয়দিন পর কুমিল্লার বুড়িচং থেকে উদ্ধার হন স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরী। তার পরিবারের অভিযোগ, এক র‌্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৮০ ভরি স্বর্ণ লুটের মামলা করার কারণেই তাকে তুলে নেয় র‌্যাব। মুক্তির পর মৃদুল চৌধুরীও জানান, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কেন র‌্যাবের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছেন তা জিজ্ঞেস করে পেটানো হয়।

মৃদুল চৌধুরীকে উদ্ধারের পর এই অপহরণ তদন্তে একটি কমিটি করে পুলিশ। কিন্তু এই অপহৃতের সঙ্গে কথা না বলেই তদন্ত শেষ করে কমিটি। আর এই অপহরণে র‌্যাবের কোনো সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে না পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিটি।

সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসীরাও

বেশিরভাগ অপহরণের অভিযোগ উঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেও। একাধিক বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের নকল পোশাক পরে এবং ভুয়া নম্বর প্লেটের গাড়ি ব্যবহার করে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণের ঘটনা ঘটে অহরহ। কিন্তু একটি বাহিনীর নাম ছড়ানোর পর স্বভাবতই অন্য বাহিনী এ নিয়ে তেমন কোনো মাথা ঘামায় না।

২৭ এপ্রিল গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে পোশাক শ্রমিক মোবারক হোসেনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ৩০ এপ্রিল রাতে টাঙ্গাইল শহরের বেবিস্ট্যান্ড এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় আটক করা হয় পাঁচজনকে।

গত ২৪ এপ্রিল রাতে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নুরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নের কামারবাড়ি গ্রামে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে প্রবাসী শফিকুল ইসলামের গাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা টাকা, বিদেশি মুদ্রা, স্বর্ণালংকার ও পাসপোর্ট নিয়ে যায়। ডাকাতরা মালিগ্রাম বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশকে দেখে পালাতে চেষ্টা করে ও গুলি ছোঁড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছুঁড়লে একজন আহত হয়। এ সময় ডাকাতদের ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস, একজন ভুয়া ডিবি পুলিশসহ দুইজন আটক হয়। অন্যরা পালিয়ে যায়।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের জিরানীর মাদবপুর এলাকায় এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির চেষ্টার সময় একদল দুর্বৃত্ত ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। পুলিশ ধাওয়া দিলে ডাকাতরা পেট্রল বোমা  ছোঁড়ে। পরে জনতা ধাওয়া দিয়ে এক ডাকাতকে আটক করে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের  নির্ধারিত দোকান থেকে প্রায়ই ভুয়া পরিচয়ে পোশাক নিয়ে যায় অন্যরা। নানা সময় ভুয়া পোশাক, হাতকড়াসহ প্রতারকরা আটক হয়েছে যারা র‌্যাব এবং পুলিশ পরিচয়ে নানা অপকর্ম করেছে।

সরকার যা ভাবছে

ঘটছে একের পর এক অপহরণ, গুম। আতঙ্ক দেশজুড়ে। সরকারের জন্যও বিব্রতকর হয়ে যাচ্ছে বিষয়টি। এটাকে কি বিশেষ পরিস্থিতি হিসেবে ভাবছে সরকার?Ñএ ধরনের একটি প্রশ্নের জবাবে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, তারা একে বিশেষ পরিস্থিতি না ভাবলেও গুম-অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করবেন। মোড়ে মোড়ে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হবে।   

এর বাইরে গাড়ি ব্যবহার করে কেউ যেন ধরে নিতে না পারে, সে জন্য ১০ মে থেকে মাইক্রোবাসে কালো কাচ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এরই মধ্যে এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

(ঢাকাটাইমস/ ০৩ মে/ এলএফ/এএ/ এআর/ ঘ.)