logo ০২ মে ২০২৫
খাদের কিনারে গণজাগরণ মঞ্চ

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
১৭ এপ্রিল, ২০১৪ ১০:৪৫:২৬
image


ঢাকা: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ কী শেষ হয়ে যাওয়ার পথে? গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতি ও প্রচার-প্রচারণায় এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। জবাবে মঞ্চের কর্মীদের দাবি, গণজাগরণ মঞ্চ ভাঙেনি, ভাঙবেও না। যে আদর্শ বা চেতনাকে সামনে রেখে অরাজনৈতিক গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে তোলা হয়েছিল সেই আন্দোলন চলবে। তবে এর নেতৃত্ব নিয়ে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে।

ইমরান এইচ সরকারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলে এরই মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রের পদ থেকে তাকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে গণজাগরণ মঞ্চের একটি অংশ সংবাদ সম্মেলন করে ইমরান এইচ সরকারকে অব্যাহতি দেন। সংবাদ সম্মেলনে কামাল পাশা চৌধুরী গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও সংগঠক বলে পরিচয় দেন।

গণজাগরণ মঞ্চের শুরু থেকে ছিলেন ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু। জানতে চাইলে তিনি ঢাকাটাইমস বলেন, ‘যখন আমরা দেখেছি মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার গণজাগরণ মঞ্চের মূল চেতনা থেকে বাইরে চলে গেছেন, তখনই আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। কারণ, আমরা চাই না কারো স্বেচ্ছাচারিতা বা একক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে গণজাগরণ মঞ্চে ভাঙন নেমে আসুক।’

তরুণ এই ছাত্রনেতা বলেন, ‘আমরা যারা শুরু থেকে মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চকে দাঁড় করালাম তাদেরকেও এখন বিভিন্ন কর্মসূচি বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। মঞ্চের মুখপাত্রের আশপাশে ঘোরাফেরা করা একশ্রেণির সুবিধাভোগী মঞ্চ নিয়ে নোংরা খেলায় মেতেছে। আমরা চাই না এদের জন্য আমাদের প্রাণের দাবি নষ্ট হয়ে যাক।’

গোড়ার দিকে সরকারের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা ছিল গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি। মঞ্চের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিতেও কাজ করেছে পুলিশ-র‌্যাবসহ অন্যান্য সংস্থা। কিন্তু এখন সরকারও চাচ্ছে না এ মঞ্চ আর দীর্ঘায়িত হোক।

আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গণজাগরণ মঞ্চের কারণেই হেফাজতে ইসলাম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। মৌলবাদী ওই গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির জল ঘোলা করতে চেয়েছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরাও হেফাজতকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকার শক্ত হাতে বিষয়টি মোকাবিলা করায় তা আর বেশিদূর গড়াতে পারেনি। এখন গণজাগরণ মঞ্চের একটি অংশ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। এ নিয়েই মূলত সরকারের সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চের ওই অংশের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

মঞ্চের সঙ্গে শুরু থেকেই ছিল এমন কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলনের শুরুর দিন থেকে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সার্বিকভাবে মঞ্চের সঙ্গে ছিল। কিন্তু পরে যখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর ও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধসহ ৬ দফা দাবির বাইরে গিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সরাসরি সরকার ও সরকারপ্রধানের সমালোচনা করতে শুরু করল তখন থেকেই ছাত্রলীগ নিজেদের মঞ্চ থেকে সরিয়ে নিয়েছে। এছাড়া মঞ্চের মুখপাত্রের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতার বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসেন তারা।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, ছাত্রলীগের কথা যখন মঞ্চ রাখেনি, তখন সাংগঠনিক কারণে তারা নিজেদের মঞ্চ থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আর যখন ইমরান এইচ সরকার হামলার জন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে দায়ী করেন, তখন অবস্থান ¯পষ্ট করার জন্য ছাত্রলীগ তাদের বক্তব্য দিয়েছে। মঞ্চের বিরোধ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে ছাত্রলীগ কোনোভাবে জড়িত নয়।

জানতে চাইলে ইমরান এইচ সরকার ঢাকাটাইমস বলেন, ‘গণজাগরণ মঞ্চ ভাঙেনি। একটি অংশ উদ্দেশ্যমূলকভাবে মঞ্চের অর্জনে ঈর্ষান্বিত হয়ে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকারের নৈতিক অবস্থানের পরিবর্তন ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে মঞ্চের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়েছে। এ জন্যই মঞ্চ বিভিন্ন বাধার মুখে পড়ছে।’



দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে যেভাবে...

গত কয়েক মাস ধরেই ভেতরে ভেতরে মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের কর্মকা-ের সমলোচনা চলতে থেকে গণজাগরণ মঞ্চের ভেতরে। ২৬ মার্চ মহাসমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে যাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা এবং সরকারবিরোধী কিছু স্লোগানকে কেন্দ্র করে মঞ্চের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি সামনে আসে। পরে গত ৩ এপ্রিল শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ যেখানে অনুষ্ঠান করে সেখানে ‘গৌরব-৭১’-এর নামে একটি মঞ্চ করলে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের মধ্যে দুই দফা মারামারি হয়। অবশ্য গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রের দাবি, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা তাদের ওপর হামলা করেছে। ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে সরকারের টাকা নেওয়ার বিরোধিতা করায় তাদের ওপর এই হামলা করা হয়েছে।

তবে ছাত্রলীগের দাবি, নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত নন। জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জমান সোহাগ ঢাকাটাইমস বলেন, ‘ছাত্রলীগের যে দুই নেতার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তারা কোনোভাবেই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।’



ইমরান এইচ সরকারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

গণজাগরণ মঞ্চ শুরু থেকেই অরাজনৈতিক একটি সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। যে কারণে এই আন্দোলনের আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর ভর করে গড়ে তোলা এ আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পাশে এসে দাঁড়ায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। যে যার মতো আর্থিক অনুদান দিয়ে আন্দোলনে সমর্থন জানায়। তাই শুরু থেকেই কোথা থেকে টাকা আসছে, কীভাবে খরচ হচ্ছে এসব নিয়ে খুব বেশি কথা হয়নি। কিন্তু এখন যখন গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে দুইপক্ষ দ্বন্দ্বে জড়ায় তখন এর আর্থিক লেনদেনের বিষয়টিও সামনে এসেছে। গণজাগরণ মঞ্চের একটি অংশের অভিযোগ, মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার মঞ্চের জন্য আসা আর্থিক অনুদান নেওয়া ও ব্যয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখেননি। তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও তুলেছেন গণজাগরণ মঞ্চের এক অংশের কর্মীরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে তারা।

তালিকায় বলা হয়েছে : ১. পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা এসপি মাহবুব ইমরান এইচ সরকারকে ৪ লাখ টাকা দিয়েছেন বাপ্পাদিত্য বসুর সামনে। বাপ্পাদিত্য বসু এই লেনদেনের কথা স্বীকার করেছেন। ২. কানাডা থেকে জিয়াউল হক প্রবাসীদের পক্ষ থেকে গণজাগরণ মঞ্চের জন্য একটি তহবিল গঠন করে দিয়েছিলেন। জিয়াউল হক বাপ্পাদিত্য বসুর পরিচিত। ৩. ইনসেপটা ৫ লাখ টাকা দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ সংশ্লিষ্ট একজনকে। ৪. বসুন্ধুরা গ্রুপ ২০ লাখ টাকা দিয়েছে। ৫. রেনেটা ফার্মা ৪ লাখ টাকা দিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি জামায়াতের। ৬. ল্যাবএইড হাসপাতাল স্বাচিপ মহাসচিব ইকবাল আর্সলানের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা দিয়েছে। ৭. ইস্পাহানি গ্রুপের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। ৮. এফবিসিসিআইর পক্ষ থেকে সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন। ৯. একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক আড়াই লাখ টাকা ইমরান এইচ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন। ১০. হামীম গ্রুপ ২০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। ১১. যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসীরা মঞ্চের জন্য অনুদান তুলে পাঠিয়েছিল। ১২. হানিফ পরিবহন ১০ লাখ টাকা ইমরান এইচ সরকারকে নগদ চেকের মাধ্যমে দিয়েছে। ১৩. অটবির পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খাবার  দেওয়া হয়েছে। ১৪. প্রথম আলোর মাধ্যমে ওঠানো ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা তহবিল দেওয়া হয়েছে। পরদিন এ নিয়ে খবরও ছেপেছে প্রথম আলো। ১৫. ফরিদুর রেজা সাগর ৬০ হাজার টাকা দিয়েছেন ইমরানকে  প্রতিবেদক সোমার মাধ্যমে। ১৬. আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ তোলা হয়েছে। ১৭. ওয়াইপিডির মাধ্যমে টাকা তুলেছেন কানিজ এ সুলতানা। ১৮. ৬ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ থেকে চাঁদা উঠেছে ৪৩ হাজার। ১৯. ৬ ফেব্রুয়ারি কানিজ এ সুলতানার মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা অনুদান এসেছে। ২০. সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দুটি ল্যাপটপ দিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চকে। ২১. বেস্টওয়ে গ্রুপ ৫ লাখ টাকা দিয়েছে। ২২. ওয়াল্টন গ্রুপ ইলিয়াস কাঞ্চনের মাধ্যমে ১০ লাখ দিয়েছে।

জানতে চাইলে ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘তারা কখনো টাকা জমা করে রাখেননি। কমিটি টাকা দিয়ে খাবার, মাইক বা অন্যান্য জিনিসপত্রের ভাড়া মিটিয়েছে।’ আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট আয়-ব্যয়ের হিসাব তিনি দিতে পারেননি।



রাজনৈতিক দল গঠনের অভিলাষ

গণজাগরণ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ইমরান এইচ সরকার অনেক দিন থেকেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তাভাবনা করছেন বলে সূত্রে জানা গেছে। মঞ্চের শুরু থেকে ছিলেন এমন একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমস বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এ চিন্তা জোরালো হয়। এ সময় ইমরান মঞ্চের ৬ দফার বাইরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। পেছন থেকে এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট তিনজন ব্যক্তি কাজ করছেন বলে সূত্র দাবি করেছে। তবে এ বিষয়টি অস্বীকার করে ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, দল গঠনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ভবিষ্যতের ব্যাপার বলা কঠিন। তবে সত্যিকারভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে এমন সব শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চান।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বানে শাহবাগে এ আন্দোলন শুরু হয়। পরে তা গণজাগরণ মঞ্চ হিসেবে পরিচিতি পায়। এর মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পান সরকারি দলের সমর্থক চিকিৎসক ইমরান এইচ সরকার। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ছাড়া সব কটি ছাত্রসংগঠন এই আন্দোলনে যোগ দেয়। সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের নানাভাবে সহায়তা দেওয়া হয়। আর এখন কার্যত ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্টের একাংশ ছাড়া আর কোনো ছাত্রসংগঠন ইমরানের সঙ্গে নেই।

(ঢাকাটাইমস/ ১৭ এপ্রিল / এইচএফ /এআর / ঘ.)