ঢাকা: দলের সব পর্যায় এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেতে চাইছে না বিএনপি। তবে সম্মেলন শেষে কমিটিগুলোর পুনর্গঠন সমাপ্ত করে চলতি বছরের শেষে আন্দোলনে নামতে চায় তারা। ২০১৭ সালের মধ্যেই সরকারকে ফেলে দিতে চান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির বিভিন্ন সারির নেতাদের সূত্র জানিয়েছে, এবার আন্দোলনে নামলে নেতারা সক্রিয় হবেনÑ তাদের কাছ থেকে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন খালেদা জিয়া।
১৯৮৮ সালে একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসার আড়াই বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে পতন ঘটে জাতীয় পার্টি সরকারের। এবার বিএনপি-জামায়াতবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগকে এর আগেই ক্ষমতা থেকে হটানোর পরিকল্পনা করেছে বিএনপি।
ঢেলে সাজবে বিএনপি
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতে তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও প্রস্তুত করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ লক্ষ্যে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকও শুরু করেছেন তিনি। ধাপে ধাপে সব জেলা এবং থানা-পৌর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ এ নেতা।
দলের সাংগঠনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করে সমাধানের নির্দেশনা দিচ্ছেন। পাশাপাশি সংগঠন গুছিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন তৃণমূল নেতাদের।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু ৫ জানুয়ারি ভোটের দিন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সক্রিয় থাকলেও বিএনপি নেতা-কর্মীরা বলতে গেলে ছিল অনুপস্থিত। ফলে সেদিন কেবল আটটি আসনে ভোট করতে পারেনি সরকার। আর ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় বিএনপির জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
ভোটের পর বিএনপিতে হতাশা আরও বাড়ে। তাই আগামি দিনের আন্দোলনেও ব্যর্থ নেতাদেরকে সরিয়ে নতুন মুখ আনতে চান খালেদা জিয়া। এরই মধ্যে ১২ এপ্রিল শ্রমিকদলের সম্মেলনে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, বিএনপির নতুন কমিটিতে তরুণদের ঠাঁই বেশি হবে। সক্রিয় নেতাদের পদ দেওয়ার বিষয়টিও ইঙ্গিত দেন খালেদা জিয়া।
দলের মধ্যে বিভেদ দূর করার উদ্যোগও জোরেশোরে শুরু করেছেন খালেদা জিয়া। সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচনে দলের ভেতর কোন্দলের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। নেতাদের গ্রুপিংয়ের কারণে অনেক উপজেলায় জয় বঞ্চিত হয় বিএনপি। সেই দ্বন্দ্ব-বিভেদ দূর করে তৃণমূলকে ফের চাঙ্গা করতে প্রথম ধাপে ১৩ জেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে গুলশান অফিসে বৈঠক করেন তিনি।
বিভিন্ন সময়ে দলের নীতি নির্ধারণী ফোরামে দলটির চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব বৈঠকে দলীয় প্রধান নেতাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যেকোনোভাবেই হোক, ২০১৭ সালের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। এজন্য যা করা দরকার তাই করতে হবে।
অবশ্য বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা সময় উল্লেখ করে সরকার পতনের কথা বলছেন না। তারা বলছেন, সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন এখন চলছে। ভবিষ্যতে এই আন্দোলন আরও কঠোর হবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন এখনো চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই আন্দোলন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দিন-তারিখ ঠিক করে বিএনপি আন্দোলন করে না। তবে বর্তমান সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। কারণ দেশের মানুষ তাদের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করেছে। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সেজন্য শিগগিরই গণআন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হবে।’
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলন চলমান। সময় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ধারাবাহিক বৈঠকে খালেদা জিয়া
তৃণমূল গোছানোর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে গত ১০ এপ্রিল রাতে পঞ্চগড়, নীলফামারী ও নওগাঁ জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। ১৩ এপ্রিল তিনি কথা বলেন নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নেতাকর্মীদের সঙ্গে।
এছাড়া প্রথম ধাপে সিলেট, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ (উত্তর), চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরা জেলার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। আগামী ২০ এপ্রিল খুলনা ও নড়াইল জেলা নেতৃবৃন্দের বৈঠকের মধ্যদিয়ে এই পর্ব শেষ হবে।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের তোপের মুখে সাবেক পিপি এডভোকেট নুরুল হককে আহবায়ক করে সিলেট জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। পঞ্চগড় জেলার আহ্বায়ক হিসেবে এ হাসান প্রধান এবং সৈয়দপুর জেলার আহ্বায়ক হিসেবে আবদুল গফুর সরকারকে মনোনীত করা হয়েছে। এছাড়া দেড় মাসের মধ্যে নীলফামারী জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে তৃণমূল কর্মীদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে কিছু কিছু জেলা নেতাদের মধ্যে মনোমালিন্য ও বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন ফের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছেন। তাদের সমস্যার কথা শুনছেন। যেখানে কমিটি নেই সেখানে কোন্দল মিটিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করে দিচ্ছেন। সব ভুলে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। এতে অবশ্যই আন্দোলনের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হবে।’
সরকার পতনের আন্দোলনে একবারে যাবে না বিএনপি। তবে এর আগে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। বিশেষ করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ ও তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ লক্ষ্যে আগামী ২২ এপ্রিল তিস্তা অভিমুখে রোডমার্চ করতে যাচ্ছে বিএনপি। এতে নেতৃত্ব দেবেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পাশাপাশি নীলফামারীতে একটি সমাবেশ করার কথা রয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা ও আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি বিশেষ কিছু জেলায় খালেদা জিয়া সফরে বের হবেন। এসব বিষয় নিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সমন্বয়ে গঠিত টিম কাজ করছে। ইতিমধ্যে ওই টিম কয়েকটি জেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সমঝোতা না থাকায় কিছু কিছু জেলায় সাংগঠনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। আমরা সেসব জেলার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়গুলো চিহ্নিত করে সমাধান করার চেষ্টা করছি। প্রাথমিকভাবে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দিচ্ছি। পরে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনও তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ম্যাডামের সঙ্গে বৈঠকের পর নেতাদের সব কোন্দলই মিটে যায়। আশা করি, এবারের আন্দোলনে তৃণমূল নেতাকর্মীরা জোরালো ভূমিকা রাখবে।
তবে বিএনপির এই আন্দোলনের পরিকল্পনা আর প্রস্তুতিকে পাত্তা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। তারা বলছেন, ২০১৩ সালের শেষ দিকে সরকারের শেষ বছরে যারা আন্দোলন করে সুবিধা করতে পারেনি তারা সরকারের মেয়াদের প্রথম বছরেই আন্দোলনে চিন্তা করলে সেটা তাদের ভাবনার দৈন্য ছাড়া কিছু নয়।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেলিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিএনপি আন্দোলন করে কতটুকু যেতে পারে সে সম্পর্কে দেশের মানুষ জানে। এসব তাদের মুখের বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। বিএনপি আন্দোলন করে সরকারের কিছুই করতে পারবে না। অতীতে এটা বার বার প্রমাণ হয়েছে।’
ভোট বর্জন নিয়ে বিরোধ প্রকাশ্যে
অবশ্য বিএনপির আন্দোলনের পরিকল্পনা আদৌ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যেই আছে সংশয়। দলটির একজন সহসভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের দলের অনেক নেতা আকাশ কুসুম কল্পনা করছেন। কিন্তু ৫ বছর অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই বলেই আমার ধারণা। আমাদের উচিত এসব আন্দোলনের কথা না ভেবে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
আন্দোলন আর গত নির্বাচন বর্জন নিয়ে বিএনপির মধ্যে বিরোধ এখন প্রকাশ্যে এসেছে। গত ১০ এপ্রিল রাজধানীতে বিএনপিপন্থি পেশাজীবীদের এক আলোচনায় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্কে নামে দুই পক্ষ। কবি ফরহাদ মজহার সেদিন বলেন, বিএনপির অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে দলটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরুল্লাহও সমর্থন করেন তার এই কথা। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে থাকা বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, বিএনপি কখনো বিলুপ্ত হবে না। বিএনপি সম্পর্কে কথা বলার আগে দলের ইতিহাস জেনে কথা বলার তাগিদ দেন রফিকুল ইসলাম মিয়া।
পরদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে আরেক আলোচনায় গত নির্বাচন বর্জন নিয়ে বিতর্কে জড়ান বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন। নাজমুল হুদা মনে করেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তবে খন্দকার মাহবুব বলেন, বিএনপির সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক।
(ঢাকাটাইমস/ ১৭ এপ্রিল / এমএম/ এআর/ ঘ.)